মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী: শাওয়াল হিজরি বছরের দশম মাস, এটি হজের তিন মাসের প্রথম মাস, যার প্রথম তারিখে ঈদুল ফিতরের নামাজ ও সাদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। এ মাসে সংশ্লিষ্ট রয়েছে হজের মাস এবং তার আগে পবিত্র রমজানুল মুবারক।
যাতে রয়েছে এক মাস পূর্ণাঙ্গ সিয়াম সাধনা, সদকা, জাকাত ও বরকতময় লাইলাতুল কদরসহ দিনরাতের নির্ধারিত ইবাদত। শাওয়াল আরবি শব্দ, যার অর্থ উঁচু করা, উন্নত করা, পূর্ণতায় পৌঁছে দেওয়া, পরিপক্বতা ও স্থিতি লাভ করা। একে শাওয়ালুল মুকাররম বলা হয়। এ মাসে বিশেষ চারটি আমল রয়েছে।
প্রথম আমল : রমজানুল মুবারকের ছুটে যাওয়া রোজা সবার আগে এ মাসেই কাজা আদায় করে নেওয়া।
দ্বিতীয় আমল : শাওয়ালের ছয়টি রোজা। কেননা প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা পালনের পর শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখবে, সে যেন সারা বছরই রোজা রাখল এবং সে পরিমাণ সওয়াব লাভ করবে।’ (মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ)
ইবনে রজব (রহ.) বলেন, শাওয়ালের রোজা রাখার তাৎপর্য অনেক। রমজানের পর শাওয়ালের রোজা রাখা রমজানের রোজা কবুল হওয়ার আলামতস্বরূপ। কেননা আল্লাহ কোনো বান্দার আমল কবুল করলে তাকে পরেও অনুরূপ আমল করার তৌফিক দেন। নেক আমলের প্রতিদান বিভিন্ন রূপ। তার একটি হলো পুনরায় নেক আমল করার সৌভাগ্য অর্জন করা।
তাই নামাজ-রোজার আমলগুলো অন্যান্য মাসেও চালু রাখা চাই। যা একমাত্র শাওয়ালের ছয় রোজা রাখার দ্বারাই সম্ভব। তবে ইবাদতের মোকাবিলায় সারা বছর সব রকমের গুনাহে লিপ্ত হওয়া থেকে বেঁচে থাকা জরুরি। কেননা এতে নাফরমানি ও অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়।
হজরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘রমজানের রোজা ১০ মাসের রোজার সমতুল্য আর শাওয়ালের ছয় রোজা দুই মাসের সমান। সুতরাং এ হলো এক বছরের রোজা। যে ব্যক্তি রমজানের রোজা শেষ করে শাওয়ালের ছয় রোজা রাখবে, সেটা তার জন্য পুরো এক বছরের রোজা রাখার সমতুল্য।’ (আহমদ, দারেমি)
তৃতীয় আমল : শাওয়ালে বিয়ে করা। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, শাওয়ালে বিয়ে করা সুন্নত। শুক্রবার জামে মসজিদে ও বড় মজলিসে বিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া সুন্নত। কারণ আয়েশা (রা.)-এর বিয়ে শাওয়ালের শুক্রবারে মসজিদে নববিতে হয়েছিল। বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।
এ সম্পর্কে রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘বান্দা যখন বিয়ে করল তখন তার দীনদারি অর্ধেক পূর্ণ হয়ে গেল, অবশিষ্ট অর্ধেকের ব্যাপারে সে যেন আল্লাহকে ভয় করতে থাকে।’ (মিশকাত)
বিয়ের মাধ্যমে আল্লাহর রসুলের নির্দেশ পালন করা হয়। কেননা তিনি ইরশাদ করেন, ‘বিয়ে করা আমার সুন্নত।’ অন্য হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে তারা বিয়ে কর। কারণ এর দ্বারা দৃষ্টি ও লজ্জাস্থানের হেফাজত হয়।’ (মিশকাত) নবীজি ফরমান, ‘তিন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর সাহায্য আবশ্যক হয়ে যায়। এক. ওই দাস-দাসী যে নিজের মুক্তিপণ আদায় করতে চায়। দুই. ওই বিয়েকারী যে আপন চরিত্র রক্ষা করতে চায়। তিন. ওই মুজাহিদ যে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে।’ (মিশকাত)
রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মহিলাকে তার আভিজাত্যের কারণে বিয়ে করবে, আল্লাহ তার অপমান অপদস্থতা অধিক হারে বৃদ্ধি করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মহিলাকে তার ধনসম্পদের লোভে পড়ে বিয়ে করবে, আল্লাহ তাঁর দরিদ্রতাকে বৃদ্ধি করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মহিলাকে বিয়ে করবে তার বংশ কৌলীন্য দেখে, আল্লাহ তার উচ্চতা ও হেয়তা বাড়িয়ে দেবেন।
আর যে ব্যক্তি কোনো মহিলাকে শুধু এজন্য বিয়ে করবে যে সে তার স্ত্রীকে দেখে চক্ষু শীতল করবে, দৃষ্টি অবনত রাখবে এবং লজ্জাস্থান হেফাজত করবে অথবা আত্মীয়তা রক্ষা করবে; আল্লাহ সেই নারী-পুরুষের দাম্পত্য জীবনে সুখ-শান্তিময় জান্নাতি নিয়ামত ও বরকত দান করবেন। যা দুনিয়া আখিরাতের উভয় জগতে চিরস্থায়ী সুখ-শান্তির পথ সুগম করবে।’ (তাবারানি)
নবীজি আরও ইরশাদ করেছেন, ‘গোটা দুনিয়াই হলো সম্পদ, আর দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো নেককার স্ত্রী।’ (মুসলিম) নবীজি ইরশাদ করেন, ‘যে বিয়ের মোহরানা কম হবে, সে বিয়ে বরকতময় হবে।’ কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা ও পাত্রীপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যে কোনো ধরনের যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া উভয়ের জন্যই হারাম।
তদরূপ পাত্রীপক্ষের ওপর বিয়ের খরচপাতি চাপিয়ে দেওয়াও নাজায়েজ। ইসলামী বিয়েতে বিজাতীয় কালচার অনুসরণ করে নাচ-গান বেপর্দা ইত্যাদি হারাম। বিয়ের পর পাত্রপক্ষের ওপর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে সাধ্যমতো ওলিমা করা সুন্নত।
চতুর্থ আমল : শাওয়ালে হজের প্রস্তুতি নেওয়া। কেননা যারা হজের নিয়ত করেছেন তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো তারা যেন হজের যাবতীয় মাসলা-মাসায়েল শিক্ষা করেন, আল্লাহর হক ও বান্দার হক যথারীতি সমাধান করেন এবং মহান রব্বুল আলামিনের দরবারে বেশি বেশি কায়মনোবাক্যে দোয়া করতে থাকে। আল্লাহ আমাদের বায়তুল্লাহ জিয়ারত করার তৌফিক দান করুন।
লেখক : ইমাম ও খতিব কাওলারবাজার জামে মসজিদ দক্ষিণখান, ঢাকা।
-কেএল