ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী।।
এক.
শতো বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে কওমি শিক্ষা এগিয়ে চলেছে সগৌরবে মহিমায়। দারুল উলুম দেওবন্দের চেতনা নষ্ট করার অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে হচ্ছে সামনেও হয়তো হবে, কিন্তু দুশমন বুঝতে পারে নি, এ চেতনা নষ্ট হওয়ার জন্যে জন্ম নেয় নি। কিছু কিছু চেতনা জন্ম নেয় শুধু বেঁচে থাকার জন্যে। ইলমে ওহীর সঠিক রাহবারী চলবে, চলতেই থাকবে। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে, কেউ না- চাইলেও।
ভারত উপমহাদেশসহ এই পুণ্যধারা যেখানে যেখানে চলমান, আল্লাহ সেখানে নাজিল করুন রহমতের ফল্গুধারা। এর বরকতে পৃথিবী থেকে দূর হয়ে যাক অশিক্ষা ও কুশিক্ষার সকল কালো। গড়ে ওঠুক এ শিক্ষার ছায়ায় এমন এক প্রজন্ম, যাদের চিন্তা চেতনা সরাসরি প্রতিবিম্বিত হবে মাদরাসাতুস সুফ্ফার চিন্তা চেতনার আলোকধারা থেকে। যারা মৌমাছি হয়ে মধু আহরণ করবে শুধুই নবুওত উদ্যানের চিরসজীব উৎস থেকে।
দুই.
বছরের শুরুতে হঠাৎ মনে হলো, কওমি মাদরাসার সন্তান হিসাবে এবং নগণ্য একজন খাদেম হিসাবে ছাত্রদের উদ্দেশে মনের কিছু কথা বলি। সবাইকে যদি একজন একজন করে পাশে পেতাম আর মাথায় হাত রেখে এ কথাগুলো বলতে পারতাম তাহলে খুব তৃপ্তি অনুভব করতাম। কিন্তু পৃথিবীর নিয়ম এটাই, সবাই সবাইকে এক সঙ্গে কাছে পাবে না। এই যে কথাগুলো মাঝে মাঝে মাথায় ঘোরে, ছাত্রদেরকে বলতে ইচ্ছে করে, এগুলো মুলত আমার নিজের কোনো কথা নয়— বড়দের কাছ থেকে পাওয়া আলোর ছটা। গর্বের উত্তরাধিকার। নইলে আমি নিজে কিছু বলবো সে যোগ্যতা ও সাহস— কোনোটাই আমার নেই।
তিন.
বছরের শুরুতেই যে বিষয়টা ছাত্রদের মাথায় রাখা উচিত তা হলো— একটি সুন্দর সূচনা। সূচনাটা ভালো ও সুন্দর হলো মন ভালো থাকে। উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। অনুসন্ধিৎসায় সমৃদ্ধি ঘটে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্রোতে সৃষ্টি হয় চমৎকার একটা গতি। কিন্তু সুন্দর সূচনা মানে কী? সুন্দর সূচনা হলো— বছরের প্রথম দিন থেকেই স্থির সংকল্পে বুক বেধে পড়াশুনা আরম্ভ করা। ‘আজ না কাল’ কিংবা ‘এখন না পরে’— এ সব থেকে বেরিয়ে আসা। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, শুরু থেকে যারা পড়াশুনায় ষোলো আনা মন দেয় না, তাদের পরের সময়গুলো কেমন যেনো এলোমেলো হয়ে যায়। আর এ-ধারাটা শুরু হলে অবিচ্ছিন্নধারায় অনিচ্ছাতেই চলতে থাকে।
চার.
দরসে অনেক বিষয় থাকে। যেমন মাদানী সিলেবাসে প্রথম বর্ষে একাধিক বিষয় থাকলেও প্রধান ও প্রথম বিষয় হলো আরবী— এসো আরবী শিখি ভালো করে পড়া। এ বিষয়ে কেউ যদি বিন্দুমাত্র অবহেলা করে এবং প্রথম বর্ষে আরবী ভাষায় কাঁচা থেকে যায়, তাহলে আমার তো মনে হয় সে নিজের অনেক বড় ক্ষতি করে ফেললো, যে ক্ষতি সত্যিই অপূরণীয়।
অনুরূপ ধাপে ধাপে সামনে বাড়লে প্রতি বছরেই নতুন কিতাব আসবে .. নতুন বিষয় আসবে। আরবী ব্যাকরণ যখন প্রথম কোনো ছাত্রের সামনে আসবে, তখন এ বিষয়ে তাকে শ্রম দিয়ে ঘাম দিয়ে বিষয়টা রপ্ত করতেই হবে। নইলে আরবী ব্যাকরণে শূন্যতা থেকেই যাবে। একই কথা প্রযোজ্য ইলমুল বালাগাহ, ফিকহ, উসূলুল ফিকহ ইত্যাদির ক্ষেত্রে।
পাঁচ.
দরসী পড়াশুনার বাইরে আর কী পড়া যায়? এ প্রশ্নটা আজকাল অনেক শুনতে হয়। এখানে এসে অনেক ছাত্র বিভ্রান্ত হয়ে যায়। কখন কী পড়বে— এ ব্যাপারে উস্তায ও মুরুব্বীর পরামর্শ এড়িয়ে হাতের নাগালে যা পায় তাই পড়তে থাকে— সাহিত্য চর্চার নামে। লেখক হওয়ার অভিলাষে। কবি হওয়ার দুঃস্বপ্ন মাথায় নিয়ে। কিন্তু এটা ভুল পথ।
দরসী বিষয়কে এটা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেক সময় দরসের মূল স্রোত থেকে তাকে অনেক দূরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তখন উস্তাযের বারণ শুনতেও সে অপারগ হয়ে যায়। অশ্বস্বি বোধ করে। বরং উস্তাযকে এড়িয়ে সে একা একাই হয়ে যায়— ছাত্র ও শিক্ষক। এটা ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার দরকার, কী ভুল সে করছে। আল্লাহ হেফাজত করুন।
ছয়.
অনেক মাদরাসায় বর্তমানে সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ পাচ্ছে ছাত্রদের উদ্যোগ ও আয়োজনে, জামাতভিত্তিক। কোথাও-বা সম্মিলিতভাবে। এটাকে আমি অভিনন্দন জানানোর আগে একটু সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে চাই। লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চা কিংবা কাব্যচর্চা— নিঃসন্দেহে একটি ভালো কাজ।
এ ময়দানে আমরা অনেক পেছনে। এগিয়ে আসতে হবে, বামপন্থীদের পেছনে ফেলে। লেখার চমৎকারিত্বে এবং সাহিত্যের সুন্দর উপস্থাপনায় ইসলামের চিরন্তন নন্দনতত্ত্বকে ও মহিমাগাথাকে সব শ্রেণীর মানুষের মাঝে .. পাঠকের ঠিকানায় পৌঁছে দিতে হবে— এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমি ও আমরা এ ময়দানে কখন কীভাবে নামবো, কাজ করবো, সেটা হাজারবার ভেবে দেখতে হবে।
প্রয়োজনে পরম শ্রদ্ধেয় আসাতিযায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করতে হবে। তাঁদের মতামতকে চূড়ান্ত মনে করতে হবে। তাদের দেখানো পথকেই সরল সোজা সঠিক পথ মনে করতে হবে। এ মানসিকতা না-থাকলে এবং নিজেদের ‘ইচ্ছেমতো চলার’ পাগলা ঘোড়ায় সওয়ার হলে বিপদ এড়ানো মুশকিল হয়ে যাবে। আল্লাহ পানাহ।
সাত.
অনেক ছাত্র উস্তাযের সাথে সম্পর্ক রাখে শুধু ক্লাসে, দূর থেকে। পরে আর যোগাযোগ রাখে না। না মাদরাসায়, না বাড়িতে গিয়ে। এটা একদম ঠিক না। উস্তাযের সান্নিধ্যে যেতে হবে। বসতে হবে। থাকতে হবে। অনেক দু‘আ নিতে হবে। এগিয়ে যাওয়ার জন্যে এ হলো এক অব্যর্থ দাওয়া। বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা সৃষ্টির জন্যেও উস্তাযের একান্ত সান্নিধ্য জরুরি। উস্তায হলেন বিশাল এক কানন, এখানে থেকে মধু আহরনে লজ্জা সংকোচ— সব ঝেড়ে ফেলতে হবে। এ ব্যাপারে উস্তাযের উদারতাও কাম্য।
আট.
সময় নষ্ট করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সময় একবার নষ্ট করা শুরু করলে আর নিয়ন্ত্রণ রাখা যায় না। ছোট ছোট প্রহরগুলো কাজে লাগালে অল্প দিনেই অনেক অর্জন সামনে চলে আসে। বড় বড় বুযুর্গানে দীনের জীবনী পড়লে দেখা যায়, প্রতিটি মুহূর্তকেই তারা কাজে লাগাতেন।
সময়কে কাজে লাগিয়েই তাঁরা বড় হয়েছেন। মহান হয়েছেন। সুযোগ্য হয়েছেন। আল্লাহর গভীর নৈকট্যে পৌঁছেছেন। আর সময় নষ্ট করলে অনেক সম্ভাবনা তীলে তীলে চাপা পড়ে যায়। আগামী দিনে যে-চারাটির হওয়ার কথা ছিলো একটি বিশাল মহীরুহ, সে চারাটি অঙ্কুরেই ঝরে পড়ে। যে ছাত্রের উচিত ছিলো হিমালয়ের চূড়ায় ওঠার, সময় নষ্ট করার কারণে সে ছাত্রই ময়নামতির ছোট্ট চূড়াটাও স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। সময় পাশে থাকলে শুধুই অগ্রগতি। আর সময় নষ্ট হলে শুধুই দুর্গতি। বাগদাদের এক মন্ত্রী ইয়াহইয়া ইবনে হোবায়রা সময় নিয়ে বলেছেন বড়ো চমৎকার। সে কথা বলেই শেষ করছি আপাতত।
লক্ষ্য করো তাঁর ভাষায়—
ﺍﻟﻮﻗﺖُ ﺃﻧﻔﺲُ ﻣﺎ ﻋﻨﻴﺖَ ﺑﺤﻔﻈﻪ *** ﻭﺃﺭﺍﻩُ ﺃﺳﻬﻞَ
ﻣﺎ ﻋﻠﻴﻚَ ﻳﻀﻴﻊُ
কতোকিছুই তো তুমি সংরক্ষণ করে রাখতে চাও! শোনো, সময়
হলো সবচে’ বেশি সংরক্ষণযোগ্য সম্পদ! আবার চাইলে তুমি একদম
অবলীলায় তা নষ্টও করে দিতে পারো!