মাওলানা যুবায়ের আহমাদ: পবিত্র মাহে রমজান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এক বিশেষ উপহার। রমজান মানেই জীবনের গুনাহসমূহ ক্ষমা করিয়ে নিজেকে জান্নাতি করে তোলার অবারিত সুযোগ। রমজান আসার আগে রমজানকে পাবার জন্য মু’মিনের হৃদয় যেমন ব্যাকুল হয়ে থাকে, রমজানের দিনগুলো যখন ফুরিয়ে যেতে থাকে মুমিনের হৃদয়ে ইমানী এক ব্যথা অনুভূত হয়।
মুমিনের হৃদয় যেন রমজানকে বিদায় দিতে নারাজ। তবুও রমজান চলে যায়। ইতোমধ্যে বিদায় নিয়েছে এবারের (১৪৪৩ হিজরি) রমজান। রমজান হলো অন্যায়, অপরাধ ও গুনাহ ছেড়ে দিয়ে নেক আমলগুলোতে নিজেকে প্রশিক্ষিত করার এক বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্স। রমজানের সে প্রশিক্ষণ জীবনভর ধরে রেখে সব ধরণের গুনাহের কাজ থেকে নিজেদের বিরত রেখে নেক আমলের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে পারলেই সে প্রশিক্ষণ স্বার্থক। জীবনভর রমজানের শিক্ষা ধরে রাখা যেতে পারে যেভাবে:
গুনাহে প্রত্যাবর্তন না করা: রোজার মূল লক্ষ্য হল প্রতিটি মুসলিমকে গুনাহমুক্ত জীবন গড়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া। রোজার সংজ্ঞার দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। রোজার সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘পানাহার, সহবাস ও সব ধরণের গুনাহের কাজ ছেড়ে দেয়াই রোজা’। শুধু পানাহার ত্যাগ করে গুনাহের কাজ না ছাড়লে তা রোজা হয় না। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘শুধু পানাহার বর্জনের নাম সিয়াম নয়; সিয়াম হলো অনর্থক ও অশ্লীল কথা এবং কাজ বর্জন করা।’ বায়হাকি। অর্থাৎ রোজার মাধ্যমে পবিত্র কোরআনে নিষিদ্ধ জিনিসগুলো ছেড়ে দেয়ার প্রশিক্ষণ নিতে হয়। নিজেকে বিরত রাখতে হয় সব ধরণের মিথ্যা ও পাপাচার থেকে। কোরআনের শান্তির সমাজ গড়ার মিশন বাস্তবায়নের মতো যোগ্য ও তাকওয়া সম্পন্ন (মুত্তাকি) নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হয়।
আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পাপ, মিথ্যা কথা, অন্যায় কাজ ও মূর্খতাসুলভ কাজ ত্যাগ করতে না পারবে তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহ তায়ালার কোনো প্রয়োজন নেই।’ বুখারি। রোজা অপরাধের হাত-পা মজবুতভাবে বেঁধে দেয় তাকওয়ার রশি দিয়ে। রোজা পানাহারকে নিয়ন্ত্রণ করে আর অপরাধ প্রবণতাকে করে সমূলে উৎপাটন। রমজান শেষে পানাহার চালু হবে বটে কিন্তু অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার যে বাস্তব প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা হয়েছিল তা চলবে সারা বছর।
সুতরাং রমজানে যেসব গুনাহের কাজ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাকে কিছুতেই ফিরে না যাওয়াই রমজানের মূল শিক্ষা। এ শিক্ষা ধরে রাখতে হবে জীবনজুড়ে। যেসব গুনাহের কাজ ও বদভ্যাস রমজানে আমরা ত্যাগ করেছিলাম সেগুলো যে রমজানের পর আবার চালু না হয়ে যায় সেদিকেই গুরুত্বের সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে। রমজানে রোজাদার ঝগড়া করবে না, সে বলে ‘আমি রোজাদার’। রমজানের পরও ঝগড়া-ফাসাদে লিপ্ত না হওয়াই রোজার শিক্ষা। চাইলেই যে আমরা বদভ্যাস ছেড়ে দিতে পারি এর অনন্য এক প্রমাণ ছিল রমজান। যেমন একজন ধূমপায়ী কিন্তু রোজা রাখতে গিয়ে রোজার দিনে ধুমপান করেননি। তার মানে তিনি চাইলেই ধুমপান ছেড়ে দিতে পারেন। গুনাহের কাজ, বদভ্যাস ছেড়ে দেওয়ার যে প্রশিক্ষণ রমজানে আমরা নিয়েছি, তা অবশ্যই ধরে রাখতে হবে।
নেক আমলগুলো চলমান রাখা: রমজানে যেসব অতিরিক্ত নফল আমল শুরু আমরা শুরু করেছিলাম, সেগুলো যেন রমজানের পরই বন্ধ না হয়ে যায় বরং সারাজীবন চলমান থাকে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। রমজানের মূল আমল হলো রোজা। এ রোজা ছিল ফরজ। কিন্তু শাওয়ালের ছয় রোজা, সোমবার-বৃহস্পতিবারের রোজা, আইয়ামে বীজের রোজা, জিলহজের প্রথম ৯ দিনের রোজা, আশুরার রোজা এবং শা’বান মাসের রোজাসহ বছরজুড়েই যে নফল রোজা রয়েছে সেগুলো রেখে নেক আমলের ধারাবাহিকতা চালু রাখতে হবে।
রমজানে তারাবিহসহ বেশকিছু সুন্নাত ও নফল নামাজ আদায় করা হয়েছে। রমজানের পরও তাহাজ্জুদ, আওয়াবিন, ইশরাক ও দুহাসহ বিভিন্ন প্রকার নফল নামাজ চালু রাখতে হবে। কিছু কিছু করে হলেও প্রতিদিনি কোরআন তিলাওয়াত করতে হবে। রমজানে শ্রমিকের সঙ্গে সদয় হওয়ার শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। সে শিক্ষাও বছরজুড়ে ধরে রাখতে হবে। রোজা মানেই না খেয়ে থাকা।
রোজায় মুমিনগণ না খেয়ে থেকে অভাবী মানুষগুলো খাবার না পেয়ে যে কষ্ট করেন তা বুঝতে পেরে সাধারণ দান ও ফিতরার মাধ্যমে ক্ষুধার্ত মানুষের ক্ষুধা মেটানোর চেষ্টা করেন। এ চেষ্টাও অব্যাহত রাখতে হবে বছরজুড়ে। রমজানে আমরা মানুষের সঙ্গে সুন্দর আচরণের শিক্ষা নিই। রোজায় ক্ষুধার্ত অবস্থায় বেশি বেশি রাগান্বিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর সে সময়েও রাগ নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের সঙ্গে সুন্দর আচরণের প্রশিক্ষণ দেয় রোজা।
আর একজন মানুষ যখন ক্ষুথার্ত (রোজা রাখা) অবস্থায় নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সে তো রোজা ছাড়া অন্য সময় আরো সহজে নিজের রাগকে আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তাই রমজানে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের সঙ্গে সুন্দর আচরণের যে প্রশিক্ষণ মুমিনরা নিয়েছেন তা-ও ধরে রাখতে হবে জীবনভর। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন!
লেখক: খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ ও পরিচালক, বাইতুল হিকমাহ একাডেমি, গাজীপুর
-কেএল