সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ঈদ: সাম্য ও সম্প্রীতির উৎসব

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

এনায়েতুল্লাহ ফাহাদ: ঈদ একটি উৎসব। একটি ইবাদত। একটি পবিত্র খুশির দিন। সাম্য ও সম্প্রীতির চিহ্ন। মুমিন হৃদয়ের আনন্দ। যেই উল্লাসে মাতোয়ারা প্রতিটি মুমিন হৃদয়। হৃদ মাঝে বয়ে যায় ঈদ বসন্তের হিমেল হাওয়া। শিউরে ওঠে দেহের প্রতিটি পশম কোণা। আনন্দে মেতে ওঠে নগর থেকে শহর। পল্লী থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল। ঈদ উৎসবের মাঝে নেই কোন ভেদাভেদ। আমরা সবাই সমান। ধনী-গরীব,কৃষক-শ্রমিক, কুলি-মজুর সবাই মোরা ভাই ভাই। আনন্দ অধিকারে সকলেই এক। এই আনন্দ হবে নিজের মনের হিংসা, ঘৃণা, লোভ, অহংকার, অহমিকা, আত্মম্ভরি, আত্মশ্লাঘা, রাগ-ক্রোধ, বিদ্বেষসহ যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করার। এই উৎসব হবে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ঐক্য, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির। মোরা মুসলিম। আমাদের বাৎসরিক উৎসব ঈদ।

ঈদ’এটি আরবি শব্দ। শব্দমূল ‘আউদ’। এর অর্থ হলো বারবার ফিরে আসা। ‘ফিতর’ শব্দের অর্থ ভেঙে দেওয়া, ইফতার করা। খন্ডিত দুটি শব্দ মিলে ঈদুল ফিতরের অর্থ, সে আনন্দঘন উৎসব, যা বারবার ফিরে আসে। যেহেতু উৎসবটি মুসলমানদের জীবনে বছর ঘুরে ফিরে আসে। সবাই একত্র হয়ে উদযাপন করে। তাই দিনকে বলা হয় ঈদ। ঈদ শব্দ চয়নে এ উৎসবের নাম রাখার তাৎপর্য হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ উৎসবে তাঁর বান্দাদেরকে নিয়ামাত ও অনুগ্রহ দ্বারা বারবার ধন্য করেন। দান করেন অশেষ রহমত। অপরদিকে ঈদ শব্দের অন্য একটি অর্থ খুশি বা আনন্দ উৎসব। আর মুসলমানদের জন্য রয়েছে বছরে দুটি আনন্দের দিন। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আদ্বহা। এ দু’টি দিবসই অত্যন্ত মর্যাদাশীল। আনন্দ ও খুশির। দীর্ঘ একমাস সিয়ামের পর মুসলিম উম্মাহর জন্য খুশির সওগাত নিয়ে আসে 'ঈদ"।

ঈদুল ফিতর। এটি একাধারে যেমন আনন্দোৎসব তেমন ইবাদতও।
ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদ মানেই হাতে হাত রেখে মুসাফাহা। এই আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ত্যাগ মহিমার শিক্ষা। ভেদাভেদ ভুলে যাওয়ার মনোবল। শ্রেণিবৈষম্যের মূলোৎপাটন। বুকে বুক রেখে কোলাকুলি । হাসিমুখে ঈদের শুভেচ্ছা,তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা। এ আনন্দ যেন আল্লাহর রহমত ও ক্ষমাপ্রাপ্তির। জাহান্নাম থেকে মুক্তির। এ আনন্দ সিয়াম-কিয়ামের শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতার। এ আনন্দে নেই কোনো অশ্লীলতা ও পাপ-পঙ্কিলতা। এ আনন্দে আছে শুধুই সওয়াব আর পুণ্যময়তা। পর্যায়ক্রমে এ আনন্দ সংক্রমিত হতে থাকে হৃদয় থেকে হৃদয়ে। সদ্যঃপ্রসূত শিশু থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ-বৃদ্ধ-বনিতা পর্যন্ত । ঈদের ছোঁয়ার পরশ লাগে সকল মুমিনের দেহে। হতদরিদ্র, এতিম, দুস্থ, নিঃস্ব ও শত শত ছিন্নমূল মানুষের মুখেও হাসি ফোটে কিছু ঈদ সামগ্রী পেয়ে। তাই মুসলমানরা গরীব আত্মীয় স্বজনের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ান। খবর নেন নিজের পরিবারের পাশাপাশি তাদেরও । কেনাকাটা করেন ঈদের নতুন পোশাক। বছরজুড়ে খোঁজ না নিলেও ঈদের সময় বাদ পড়ে না। ছুটে যান শহর ছেড়ে পল্লীগ্রামে। যেখানে আছে মমতাময়ী মা-বাবা, ভাই-বোন সহ আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা। ভুলে যান সকল মান-অভিমান, ঝগড়া বিবাদ হিংসা-বিদ্বেষের কথা। একসাথে পায়ে হেঁটে যান ঈদগাহে। বসে যান সারিবদ্ধ জায়নামাজে। সেজদারত হয় সৃষ্টিকর্তা মহান রবের তরে। সাম্য ও সম্প্রীতির কি এক অপূর্ব দৃশ্য। এ যেন একই পাখির দুটি ডানা। ঐক্যের অটুট বন্ধন। এভাবেই মুসলিম সম্প্রদায়ের সর্বশ্রেণির মানুষ এ উৎসবে মেতে ওঠে অনাবিল আনন্দে। প্রাণে প্রাণে বহে খুশির জোয়ার। উচ্ছ্বাসমুখরতা ও জান্নাতি খুশির আবহ ঘিরে এত সব আয়োজন। এমনকি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ী ও কর্মজীবীরাও ব্যস্ত হয়ে পড়েন ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে। ঈদ উপলক্ষে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করেন তারাও। এভাবেই সর্বজনীন হয়ে ওঠে ঈদ।

বছর ঘুরে আবারো ফিরে এলো ঈদুল ফিতর। এটি মুসলিম জাতির প্রধান উৎসব। যা ধর্মীয় শিক্ষা ও তাৎপর্য একটি সুস্থ ও কল্যাণমুখি সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে। প্রথমত, দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনা ও কোরআন তিলাওয়াত-অধ্যয়ন ও ইবাদত-উপাসনার রোজাদার স্রষ্টার নৈকট্য অনুভব করেন। এর ফলে রোজাদার অতীতের তুলনায় অনেক পরিবর্তন হয়, আত্মশুদ্ধির জন্য এই পরিবর্তনের কোন বিকল্প নেই। আমরা অনেকেই সমাজ বিনির্মানের কথা বলি, দিন বদলের কথা বলি। কিন্তু দিন বদলের জন্য সবার আগে যেটি প্রয়োজন, আর সেটিই যদি আমরা ভুলে যাই। তাহলে তো ফলাফল শূন্য। পবিত্র মাহে রমজান এই দিল বদলের শিক্ষাই দিয়েছে। তাই আমরা বলতে পারি ঈদুল ফিতরের আনন্দ-উৎবের সাথে সিয়াম সাধনার একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মাসব্যাপী আত্মত্যাগ, সংযম, সাধনার পর এই দিনে বান্দাহের পুরস্কার হিসেবে ক্ষমা মিলে। হাদীস শরীফ এর বাণী, হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা ঈদের দিন ফেরেশতাদের মধ্যে রোজাদারদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, ‘হে ফেরেশতারা, আমার কর্তব্যপরায়ণ প্রেমিক বান্দার বিনিময় কী হতে পারে?’ ফেরেশতারা বলেন, ‘হে প্রভু, পুণ্যরূপে পুরস্কার দান করাই তো তার প্রতিদান।’ আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব (রোজা) পালন করেছে। অতঃপর দোয়া করতে করতে ঈদগাহে গমন করেছে। সুতরাং আমার মর্যাদা, সম্মান, দয়া ও বড়ত্বের কসম! আমি তাদের দোয়া কবুল করব এবং তাদেরকে মাফ করে দিব।’ (বায়হাকি : ৩/৩৪৩)

শেষকথা, ঈদ পবিত্র খুশির। ঈদ আনন্দের।ঈদ ক্ষমার।ঈদ সব ভেদাভেদ ভুলে একে অপরকে বুকে জড়ানোর। ঈদ মুমিনের শ্রেষ্ঠ উৎসব। ঈদ সাম্য ও সম্প্রীতি নমুনা। ঈদ আসে সুশৃঙ্খল আচার-আচরণের তীর ঘেঁষে। নৈতিক, আত্মিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধির সীমানা পেরিয়ে সামষ্টিক কল্যাণ নিয়ে। ঈদ আসে কৃচ্ছ্র ও শুদ্ধতার প্রতীক হয়ে। তাকওয়ার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নতুন জীবনে ফেরার অঙ্গীকার নিয়ে। অফুরন্ত কল্যাণের সঙ্গে আলিঙ্গন করে। ঈদ আসে শত্রুতা ও বৈরিতার প্রাচীর ডিঙিয়ে বন্ধুতা ও মিত্রতার হাত বাড়িয়ে। মহামিলনের মহোৎসবে মনকে মাতিয়ে তুলতে। পরিশোধিত হৃদয়কে পরিতৃপ্তি করতে। ঈর্ষা, দ্বেষ, অনৈক্য-দূরত্ব ও বিভাজনের প্রাচীর ভাঙতে। অতএব আমরা এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সাম্য ও সম্প্রীতির সুদীর্ঘ আকাশচুম্বী প্রাচীর নির্মাণ করবো ইনশাআল্লাহ।

লেখক, কবি ও গীতিকার

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ