ওমর ইবনে আখতার
বছর ঘুরে ইতোমধ্যেই আবার মুসলিম উম্মাহর মাঝে উপস্থিত হয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ মাস রমযান। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মহিমান্বিত মাস। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর দীর্ঘ প্রতীক্ষা, পরম কাঙ্ক্ষিত গভীর শ্রদ্ধা-ভক্তিবিজড়িত পবিত্র মাস। মহান আল্লাহ তায়ালার বিশেষ রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বারিধারায় বিধৌত হয়ে পাপের পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত, পরিচ্ছন্ন ও শুদ্ধ হওয়ার মাস।
পবিত্র রমযানের প্রতি দিবারাত্রি ও প্রতি প্রহরে পাপের আবিলতামুক্ত এবং নিখাদ হওয়ার মহৎ ও মহা আয়োজন করে রেখেছেন দয়াময় ও মেহেরবান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা। সেই মহান লক্ষ্যের চূড়ান্ত স্তর হচ্ছে নাজাত তথা জাহান্নাম থেকে মুক্তি, যা হয়ে থাকে রমজানের শেষ দশকে বিশেষভাবে।
আর একারণেই হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রামযানের শেষ দশককে বিশেষ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতেন। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইবাদতের বসন্ত কাল পুরো রমাজনই ছিল আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অত্যান্ত গুরুত্ববহ। কিন্তু প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট রমজানের শেষ দশকের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
এসময় তিনি আপন স্ত্রীদের সঙ্গ ত্যাগ করে ইবাদতের প্রতি মনোনিবেশ করতেন পূর্ণরূপে। পুরোটা সময় কাটাতেন মসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায়। এসময়ে আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইবাদতের বর্ণনা দিতে গিয়ে হযরতে আম্মাজান আয়েশা রাযি. বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শেষ দশকে ইবাদতের মাত্রা এত বেশি বাড়িয়ে দিতেন—যেমনটি অন্য সময় করতেন না।’ (আস সুনানুল কুবরা, হাদিস: ৮৩৫১; মুসলিম, হাদিস : ১১৭৫)
অপর হাদিসে আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত,‘যখন রমযানের শেষ দশক আসত, তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোমরে কাপড় বেঁধে নেমে পড়তেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত জেগে থাকতেন।' (বুখারি শরিফ, হাদিস: ১০৫৩)
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের শেষ দশকে কেবল নিজেই ইবাদতের জন্য জাগরণ করতেন না। বরং জাগিয়ে দিতেন পরিবারের সকল সদস্যদেরকেও। তাহাজ্জুদের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ হতে অন্য কে জাগানোর ব্যাপারে শিথিলতা থাকলেও তা ছিল না রমযানের শেষ দশকে।
এসময় তিনি রাত্রি জাগরণের জন্য নিজের প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা রাযি. দরজায় কড়া নাড়তেন। বুখারি-মুসলিমের এক বর্ণনা মতে, তিনি আলী ও ফাতেমা রাযি. কে ডেকে বলতেন, তোমরা উঠবে না? (নফল) নামাজ পড়বে না?
অন্য এক হাদিসে হজরত আলী ইবনে আবি তালিব রাযি. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক রাতে তাঁর কন্যা ফাতেমা রাযি. এর নিকট এসে বলেন, ‘তোমরা কি সালাত আদায় করছ না?’ (বুখারি, হাদিস : ১১২৭)
আর এই শেষ দশকেই আছে মহিমান্বিত,ফযীলতপূর্ণ, বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত রাত "লাইলাতুল কদর"।যার মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য অপরিসীম। যা উত্তম হাজার মাস অপেক্ষায়। আর এ রাতেই নাযিল হয়েছে মহা গ্রন্থ আল কুরআন।
মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি একে নাজিল করেছি মহিমান্বিত রাতে (লাইলাতুল কদরে)। আপনি কি জানেন মহিমান্বিত রাত কী? মহিমান্বিত রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। সেই রাতে প্রতিটি কাজের জন্য ফেরেশতারা এবং রুহ (জিবরাইল) তাদের প্রতিপালকের আদেশক্রমে অবতীর্ণ হয়। সেই রাতে শান্তিই শান্তি, ফজর হওয়া পর্যন্ত।’ (সুরা : কদর, আয়াত : ১-৫)
বিভিন্ন হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, উল্লিখিত আয়াতে মহিমান্বিত যে রাতের কথা বলা হয়েছে, তা এই শেষ দশকেই লুকিয়ে আছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো। (বুখারি, হাদিস: ২০১৭)
সাহাবায়ে কেরামকে লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি কদরের রাতের সন্ধানে প্রথম ১০ দিন ইতিকাফ করলাম।
এরপর ইতিকাফ করলাম মধ্যবর্তী ১০ দিন। অতঃপর ওহি প্রেরণ করে আমাকে জানানো হলো যে তা শেষ ১০ দিনে। সুতরাং তোমাদের যে ইতিকাফ পছন্দ করবে, সে যেন ইতিকাফ করে।’ এরপর মানুষ তাঁর সঙ্গে ইতিকাফে শরিক হয়। (মুসলিম, হাদিস : ১৯৯৪)
আর এই শেষ দশককে কাজে লাগানোর এবং লাইলাতুল কদর পাওয়ার সবচেয়ে সুশৃঙ্খল আয়োজন হচ্ছে ইতিকাফ। আর একজন মানুষ যতক্ষণ ইতিকাফে থাকেন, ততক্ষণ তার পূর্ণ সময়টাই ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। এর মাধ্যমে প্রকারান্তে ব্যক্তির রমযানের শেষ দশদিন পুরোটাই কাটে ইবাদাতের মধ্য দিয়ে। আর লাইলাতুল কদরও পেয়ে যায় খুব সহজে।
হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, ‘ইন্তেকাল পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন। এরপর তাঁর স্ত্রীরাও ইতিকাফ করেছেন।’ (বুখারি, হাদিস : ১৮৬৮; মুসলিম, হাদিস : ২০০৬)
আসুন, আমরাও রমজান শেষ দশককে কাজে লাগিয়ে নিজেদেরকে পাপের পঙ্কিলতা থেকে বিধৌত করে নেই!
লেখক: শিক্ষার্থী, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ- ঢাকা
-এটি