।।এনায়েতুল্লাহ ফাহাদ।।
ইতিকাফ। ইসলামী শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। মাহে রমজানের বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ইবাদত। কদরের রাত হাসিল করা অন্যতম উপায়।
ইতিকাফের মাধ্যমে মানুষ দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে আক্ষরিক অর্থে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যায়। রমজানের শেষ দশক তথা বিশ রমজান সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে ঈদের চাঁদ তথা শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা পর্যন্ত ইতিকাফ পালন করা।
‘ইতিকাফ’ এটি আরবি শব্দ। অর্থ হলো, অবস্থান করা, আবদ্ধ থাকা বা আবদ্ধ রাখা। শরিয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ বলা হয়, ইবাদতের উদ্দেশ্যে ইতিকাফের নিয়তে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান করা, এটির হুকুম সুন্নতে মুআক্কাদাহ কিফায়াহ। শরিয়তের হুকুম মোতাবেক কোনো মসজিদ মহল্লায় কয়েকজন বা কোনো একজন আদায় করলে সবাই দায়মুক্ত হয়ে যাবে।
আর কেউই না করলে সবাই গুনাহগার হবেন। তবে আদায়ের ক্ষেত্রে যিনি বা যাঁরা আদায় করবেন, শুধু তিনি বা তাঁরাই সওয়াবের অধিকারী হবেন, আর ব্যক্তিজীবনে এ ত্যাগ তিতিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য হলো—লাইলাতুল কদর সন্ধান করা। হাজার রাতের সেরা রাত প্রাপ্তির মাধ্যমে মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভ করা।
ইতিকাফের মাধ্যমে শবে কদর তালাশ করেছেন রাসুলুল্লাহ সা., আর এ কথাটি আবু সায়ীদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত , রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : 'আমি প্রথম দশকে ইতিকাফ করেছি এই (কদর) রজনী খোঁজ করার উদ্দেশ্যে। অতঃপর ইতিকাফ করেছি মাঝের দশকে। অতঃপর মাঝ দশক পেরিয়ে এলাম। তারপর আমাকে বলা হলো, (কদর) তো শেষ দশকে। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ তাকওয়া অর্জন করতে চায় সে যেন ইতিকাফ করে।' (মুসলিম-১১৬৭)
ইতিকাফের আদেশ কোন মানুষের পক্ষ থেকে নয় বরং এটি স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাহর প্রতি বিশেষ সারপ্রাইজ নির্দেশ। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন, আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৫)।
কুরআনুল কারিমে বর্ণনার পরে অসংখ্য হাদিসেও রাসুল সা. এর ইতিকাফ পালন সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আয়েশা রা. বলেন : 'ইন্তেকাল পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ সা. রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন, এরপর তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন।' (বুখারি :১৮৬৮)
আবু হুরাইরা (রা) বলেন—'রাসুল (সা.) প্রতি রমজানে দশ দিন ইতিকাফ করতেন, তবে যে বছর তিনি পরলোকগত হন, সে বছর তিনি বিশ দিন ইতিকাফে কাটান।' (বুখারি : ১৯০৩)
ইতিকাফ একটি সচ্ছ ও নিখুঁত ইবাদত। অতএব ইতিকাফরত অবস্থায় এমন সব কথা ও কাজ না করা , যাতে কোনো গুনাহ হয়। তবে প্রয়োজনীয় সাংসারিক কথাবার্তা বলতে নিষেধ নেই; অহেতুক অযথা বেহুদা অনর্থক কথাবার্তা দ্বারা পুণ্য নষ্ট হয়। ইতিকাফের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহর জন্য নিজেকে আবদ্ধ করে নেওয়া।
মুসলমানের অন্তরের কঠোরতা দূরীভূত করা। দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসার প্রাচীর ছেদ করা।যাতে করে আত্মিক উন্নতির প্রাপ্তি অনুভূত হয়। আর এ নিগূঢ় সম্পর্ক দীর্ঘ সময় মসজিদে অবস্থানের দরুন। বান্দার অন্তর মসজিদের সঙ্গে জুড়ে যায়। আত্মার প্রশান্তি লাভ হয়।
মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। হাদিস অনুযায়ী যে সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের ছায়ার নিচে স্থান দান করবেন তাদের মধ্যে একজন হলেন ওই ব্যক্তি মসজিদের সঙ্গে যার হৃদয় ছিল বাঁধা :'এবং ওই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে বাঁধা।' (বুখারি : ৬২০)
পুরুষদের ইতিকাফ মসজিদে ; নারীদের নির্দিষ্ট ঘরে বা নির্ধারিত কক্ষে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ও একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ওই ঘর বা কক্ষ থেকে বের হওয়া নিষেধ । অজু ইস্তিঞ্জা বা পাক পবিত্রতার জন্য বাইরে বের হতে পারবে তবে কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলবে না।
প্রয়োজন হলে ভেতর থেকে বাইরের কাউকে ডাকতে পারবে এবং কেউ ভেতরে এলে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারবে।
একই কক্ষে বা একই বিছানায় অন্য যে কেউ অবস্থান করেন, তাতেও কোনো ক্ষতি নেই; এমনকি স্বামীও পাশে থাকতে পারবেন; তবে স্বামী-স্ত্রীসুলভ আচরণ ইতিকাফ অবস্থায় নিষিদ্ধ; এর দ্বারা ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ো না, যখন তোমরা ইতিকাফরত থাকবে।’ (সুরা বাকারা- ১৮৭)
ইতিকাফের ফজিলত সম্পর্কে নতুন করে বর্ণনা করার তেমন কিছুই নেই। কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত ইতিকাফের গুরুত্ব অপরিসীম। যুগের পর যুগ পাড়ি দিয়ে আজ অবধি চলছে ইতিকাফ এর মহিমান্বিত ইবাদত।
হাদীসে উল্লেখিত ইতিকাফের ফযিলত:-
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'নিশ্চয় ফেরেশতারা তোমাদের একজনের জন্য দোয়া করতে থাকেন যতক্ষণ সে কথা না বলে, নামাজের স্থানে অবস্থান করে। তারা বলতে থাকে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করুন, যতক্ষণ তোমাদের কেউ নামাজের স্থানে থাকবে এবং নামাজ তাকে আটকে রাখবে, তার পরিবারের কাছে যেতে নামাজ ছাড়া আর কিছু বিরত রাখবে না, ফেরেশতারা তার জন্য এভাবে দোয়া করতে থাকবে।' (মুসলিম : ৬০১১)
ইসলামী শরিয়ত প্রত্যেক ইবাদতের ক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করেছেন।শর্ত হলো ইবাদত সহীহ হওয়ার জন্য। ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য। ঠিক তেমনি ইতিকাফ সহীহ হওয়ার জন্য শর্তসমূহ : ১. মুসলমান হওয়া ২. পাগল না হওয়া ৩. বালেগ হওয়া ৪. নিয়ত করা ৫. ফরজ গোসলসহ হায়েজ নেফাস থেকে পবিত্র হওয়া ৬. মসজিদে ইতিকাফ করা ৭. রোজা রাখা।
মানব জীবনকে সোনার অক্ষরে সাজাতে হলে ইচ্ছাশক্তি প্রবল করা এবং প্রবৃত্তিকে খারাপ অভ্যাস থেকে বিরত রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা।আর তা হতে পারে ইতিকাফের মতো পুণ্যময় ইবাদতের মাধ্যমে । ইতিকাফ তার জন্য সুবর্ণ সুযোগ করে দেয়। ইতিকাফ ধৈর্যের গুণে গুণান্বিত হতে শেখায়।
ইতিকাফ থেকে একজন মানুষ সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে বের হয়ে আসার সুযোগ পায়। যা পরকালে উপকারে আসবে। এ ছাড়াও ইতিকাফের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি আসে। বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াতের সুযোগ পায়। ঐকান্তিকভাবে তাওবা করার সুযোগ লাভ হয়। তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হওয়া যায়।
সময়কে সুন্দরভাবে কাজে লাগানো যায়। আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় হয়। আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট হওয়ায় অন্তর সংশোধিত হয়। ইমানি দৃঢ়তা অর্জনের পথ খুঁজে পায়। আর কেয়ামতের দিন তাঁর মুক্তির পথে এটিই। তাহলে ইতিকাফ হলো এমন একটি ইবাদত, যার মাধ্যমে বান্দা সমস্ত সৃষ্টি জীব থেকে আলাদা হয়ে যথাসম্ভব প্রভুর সান্নিধ্যে চলে আসে।
পরিশেষে ইতিকাফের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর জন্য নিবেদিত করে দেয়। নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির ও দোয়া ইত্যাদির চর্চার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের অফুরান সুযোগের আবহে সে নিজেকে পায়। সুতরাং আল্লাহ তাআলা আমাদের কে খালেস নিয়তে ইতিকাফ পালন করার তৈফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক
-কেএল