বরাবরের মতোই রমজানের আগে আগে দেশের নিত্যপণ্যের বাজার লাগাম ছাড়া হয়ে যায়। প্রায় সব জিনিস চলে যায় সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু আমরা যদি মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে তাকাই দেখতে পাই, সে দেশের ব্যবসায়ীরা রমজান উপলক্ষে তাদের পণ্যে ক্রেতাদের জন্য বিশেষ ছাড় দিয়ে থাকেন। চলে পুরো রমজান জুড়ে নানা অফার।
এদেশের সিংহভাগ মানুষ মুসলিম। রমজান তাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার অন্যতম এক অধ্যায়। কিন্তু কেন এদেশের ব্যবসায়ীরা অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মাঝে রাখতে পারছেন না? অস্থীতিশীল এই বাজার ব্যবস্থার ইসলামী সমাধান কী হতে পারে? এসব বিষয়ে আওয়ার ইসলামের সাব-এডিটর আব্দুল্লাহ আফফান কথা বলেছেন দেশের প্রবীণ চিন্তক আলেম মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদের সঙ্গে। পাঠকের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হচ্ছে:-
দেশে বিভিন্ন সময় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি দেখা যায়। এর কারণ কী?
দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি কয়েকভাবে হয়। প্রথমত, দেশের অর্থনীতি নিম্মমূখির কারণে মানুষের কাছে অর্থ নেই। পন্যের স্বাভাবিক দাম দিয়ে মানুষ কিনতে সক্ষম না। জনগনের হাতে অর্থ না থাকার কারণে বাহ্যিকভাবে পন্যের দাম বেশি মনে হয়। এটা আসলে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি না। এটা মানুষের আর্থিক সংকটের কারণে দ্রব্য কিনার সামর্থ্য না থাকা।
আর্থিক সংকটের সময় মুমিনের করণীয়?
দ্রব্য উৎপাদনকারীদের লস দিয়ে বিক্রি করতে শরিয়ত বলে নাই। যাদের কাছে টাকা নাই, শরিয়ত তাদের বলেছে, তোমার প্রয়োজন কমিয়ে নেও। এক কেজি দরকার হবে, তা কমিয়ে নেও। এতে তার জীবনও চলবে, আবার অবস্থাও ঠিক থাকবে।
জনগনের অর্থনৈতিক সংকট যদি দেখা যায় তখন শরিয়তের ফর্মূলা হলো, অপচয় তো করবেই না বরং প্রয়োজন যতটুকু তার অর্ধেক বস্তু দিয়ে কষ্ট করে প্রয়োজন মিটাও। এতে তোমার জীবন বাঁচবে। তারপরেও সুদের কারবার করে, মানুষকে ধোঁকা দিয়ে, নিম্মমানের পন্য নিয়ে ভালো পণ্যের দাম নেয়া, অন্যায়ভাবে-অবৈধভাবে অর্থ উর্পাজন করে প্রয়োজন পূরণ করো না। হারাম থেকে বেঁচে থাকো। প্রয়োজনকে কমিয়ে আনো। খরচের খাত কমাও।
আমরা প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে অনেক কিছু কিনি। আনন্দ-ফুর্তির জন্য অনেক কিছু কিনি। অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা বাদ দিতে হবে। প্রয়োজনীয় খরচ করতে হবে।
পণ্য গুদামজাত করে দাম বৃদ্ধি বিষয়ে যদি কিছু বলতেন?
মানুষের চাহিদা এবং পন্য সরবারহের ভিত্তিতে পন্যের মূল্য নির্ধারণ হয়। পন্য উৎপাদন থেকে বাজারে সরবরাহ পর্যন্ত, পন্যের পিছনে যত খরচ আছে, বিভিন্ন পার্টির লাভসহ একটি পন্যের যে উচিত দাম হওয়ার কথা। কিন্তু মার্কেটে উচিত দামের চেয়ে দ্বিগুন বেশি। এটা বাস্তবিকভাবে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। কৃষক থেকে শুরু করে পন্য গ্রাহকের হাতে পৌঁছা পর্যন্ত দাম হওয়ার কথা ১০০ টাকা। কিন্তু গ্রহককে কিনতে হচ্ছে ৩০০ টাকায়। এটা দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি।
এ দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির পিছনে কারণ- অসৎ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট। তারা পন্য গুদামজাত করে মার্কেটে সরবারহ কমিয়ে দিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। সংকট দেখিয়ে পন্যের মূল বৃদ্ধি করে। তাদের উদ্দেশ্য, তারা বছরের অন্যান্য সময় নরমালি ব্যবসা করবে। একমাস, দুইমাস বা মৌসুম বুঝে এক সপ্তাহে অধিক মুনাফা কামাবে।
রমজানের আগে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণ কী?
আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রমজানের আগে বেশি হয়। কারণ অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজান মাসে মানুষের চাহিদা বেশি থাকে। রমজানের আগে আগে পন্য বেশি করে কিনে গুদামজাত করে পন্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। পুরো বছরের ব্যবসা তারা রমজান মাসে করে।
লোভ-লালসো থেকে ব্যবসায়ীরা দ্রব্যের দাম বাড়ায়। রমজানে যেহেতু মানুষের চাহিদা বেশি থাকে। তাই তারা রমজানকে ব্যবসার কেন্দ্র বানায়। বেশি মুনাফা লুটার চেষ্টা করে।
কৃত্রিম সংঙ্কট সৃষ্টি করে পন্যের মূল্য যারা বাড়ায় ইসলামে তাদের ব্যপারে কী বলে?
রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে রাখে, সে ব্যক্তি আল্লাহর দায়িত্ব থেকে মুক্ত। আল্লাহ তার দায়িত্ব থেকে মুক্ত।
রাসূল সা. বলেন, ‘কেউ যদি খাদ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেন।’
যদিও সে মনে করছে সে অনেক লাভ করছে। কিন্তু আল্লাহ তাকে দরিদ্র বানিয়ে দিবে। এবং মহামারি দ্বারা তার মৃত্যু হবে। একজন্য সমস্ত ফকিহদের মত হচ্ছে, গুদামজাত করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা হারাম। তাই যারা রমজানকে কেন্দ্র করে এই কাজ করে। তারা এই দুই হাদিসের অভিশাপে পড়বে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহিহ বুঝ দান করুন।
সব ধরণের গুদামজাত করাাই কী হারাম?
না। গুদামজাত করা বৈধ। গুদামজাত করার কারণে পন্য সরবরাহে যদি ব্যাঘাত না হয়। জনগন চাহিদা মতো পন্য পায়। মূল্য বৃদ্ধি হয় না। তখন অতিরিক্ত পন্য সংরক্ষণের জন্য গুদামজাত করা শরিয়তে বৈধ। কিন্তু যে গুদামজাত দ্বারা পন্য সরবরাহে যদি ব্যঘাত ঘটে। জনগন চাহিদা মতো পন্য পায় না। মূল্য বৃদ্ধি হয়। সেটা সম্পূর্ণ হারাম।
অনেক মুসলিম দেশে রমজান উপলক্ষে বিশেষ ছাড়া দেয় বা রমজানের প্রয়োজনীয় দ্রব্যে প্যাকেজ করে ছাড় দেয়- এটাকে কীভাবে দেখছেন?
এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। এক হাদিসে আছে রাসূল সা. বলেছেন, যখন রমজান মাস আসবে তোমাদের গোলামগুলো আজাদ করে দেও। তোমাদের কর্মচারীদের ছুটি দেও। তাদের বেশি বেশি আল্লাহর গোলামী করার সুযোগ দেও। তাদের যদি ছুটি দিতে না পারো তাহলে বেতন বৃদ্ধি করে দেও। বেশি বেশি সহযোগিতা করো।
এমন একটি হাদিস আছে। এ হাদিসে রমজান উপলক্ষে জনগন যেটা প্রাপ্য তার থেকে বেশি দেয়ার জন্য আল্লাহর রাসূল নসিহত করেছেন। কর্মচারীদের ছুটি দেয়ার প্রতি উৎসাহ দিয়েছে। ছুটি দেয়া মানে, বেতন দিবে কিন্তু কাজ বন্ধ থাকবে। কেউ যদি পন্যের উচিত মূল্য থেকে সামান্য লাভ রেখে বাকি লাভটা ছেড়ে দেয়। এটাও ওই হাদিসের অর্ন্তভূক্ত। সেখানে রাসূল সা. বলেছেন, তোমরা কর্মচারীদের কাজ না করিয়ে বেতন দিয়ে দেও। ছুটি দিয়ে দেও।
যারা রমজানে ছাড় দেয়, তারা মূলত ওই হাদীসের উপর আমল করে। সেখানে রাসূল সা. বলেছেন, রমজান উপলক্ষে তোমরা মানুষের প্রতি দয়াশীল হও। কর্মচারীকে ছুটি দেও।
যারা রমজানে ছাড় দেয়। তাদের পুরস্কারের ঘোষণা ইসলামে আছে কি?
আল্লাহর নবীর হাদিসে আছে ছাড় দেয়ার জন্য। ছাড় পেয়ে ওই ব্যক্তি এবাদত বন্দেগি করে যে সওয়াব পাবে। ছাড় দেয়া ব্যক্তিও সমপরিমান সওয়াব পাবে।
কারো মাধ্যমে কোন ব্যক্তি যদি এবাদত করে। এবাদতকারী যে সওয়াব পাবে। যার সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার দ্বারা, পথ প্রদর্শন করার দ্বারা এবাদত করল সুযোগদানকারী ব্যক্তিও সে সওয়াব পাবে। এতে এবাদতকারী ব্যক্তির সওয়াব কমানো হবে না।
দ্রব্যে ছাড় পেয়ে যে ব্যক্তি সেহরী, ইফতার করল। আল্লাহর গোলামিতে লিপ্ত হলো। তার সওয়াবের পূর্ণ অংশ ছাড়দাতাও পাবে।
-কেএল