গৌতম দাস।।
দ্য কাশ্মির ফাইলস -একটা ভারতীয় সিনেমার নাম। আসলে বলা উচিত মুসলমান ঘৃণাবিদ্বেষের বিষ উগড়ে দিয়ে বিজেপির পক্ষে নিজ বাক্সে হিন্দুভোট জোগাড়ের নতুন এক উপায় হলো এই কথিত সিনেমা। ‘কথিত’ বললাম এ জন্য যে, কোনো নির্বাচনী প্রপাগান্ডা বা প্রচারমূলক কাজে গান লিখে গেয়ে তা ক্যাম্পেইনের যেমন রেওয়াজ দেখা যায় এটাও তেমনি; তবে এটা বড় ধরনের প্রপাগান্ডা। তাই পয়সা খরচ করে গানের বদলে সিনেমা বানিয়ে এক বড় প্রপাগান্ডার কাজ। প্রপাগান্ডা মানে সত্য-মিথ্যা ভুলে, কেয়ার না করে কেবল প্রচার আর প্রচার! তাই এটা সিনেমা নয়; না সৌন্দর্যগুণ বিচারে না বিনোদনের বিচারে। এটা একটা প্রপাগান্ডার বস্তু মাত্র।
আর খরচের বিচারে শোনা যায়, এটা প্রায় সাত কোটি রুপিতে বানানো, যেটা ইতোমধ্যে ৩০০ কোটির বেশি অর্থ আয় করেছে। সত্যি হিন্দুত্ববাদ কী না পারে যার মূল কারণ বলা যায়, বিজেপি শাসিত রাজ্যে এর টিকিট করমুক্ত করা হয়েছে, এভাবে হাইপ-জোশ তোলার কারণে আর দলীয় প্রপাগান্ডা যেমন সারা ভারতে নাকি মুসলমানরা হিন্দুদের ওপর হত্যা ও অত্যাচার করছে -ফলে হিন্দুরাই ভিকটিম, তাই ত্রাতা মোদিকে ভোট দিয়ে তার পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান, এটাই এই ছবির মাহাত্ম্য!
আবার ইতোমধ্যে ভারতেই এই সিনেমাকে কেন্দ্র করে আরো যেসব প্রপাগান্ডা শুরু হয়েছে এর বিরুদ্ধে পাল্টা ‘ফ্যাক্ট চেক’ (অর্থাৎ আসল ঘটনাটা কী তা পরীক্ষা ও প্রমাণসহ সেই ফ্যাক্টস তুলে ধরা) রিপোর্টও মিডিয়ায় প্রকাশ করা শুরু হয়েছে। এরই একটা রিপোর্ট দেখা গেল, পয়লা এপ্রিলের দক্ষিণী পত্রিকা ‘দ্য হিন্দু’তে। ওখানে পাঁচটা বিভিন্ন প্রপাগান্ডার ঘটনা তুলে আনা হয়েছে, যার পাঁচটাই ভুয়া বা মিথ্যা বলে প্রমাণ দেখানো হয়েছে। যেমন কাশ্মিরে কতজন হিন্দু কাশ্মিরি পণ্ডিত এ পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে? এতে কোনো এক কথিত আরটিআই (রাইট টু ইনফরমেশন) তথ্যে বলা হয়েছে, তা ১৬৩৫ জন। কিন্তু ওই ফ্যাক্ট চেক মোতাবেক, তা মাত্র ৮৯ জন আর বাকিরা ‘অন্য কেউ’।
সার কথায় সবাই পাল্টা কথা বলছেন যে, এটা একটা বিজেপি দলীয় প্রপাগান্ডা সিনেমা; ফলে নানান উসকানিমূলক তথ্য, ভুয়া তথ্য (অনেক মিডিয়ায় এই সিনেমাটাকে ধান্ধাবাজি বা ম্যানিপুলেটেড তথ্য বলতেও দ্বিধা করা হয়নি) সাথে দিয়ে দলীয় প্রপাগান্ডায় সবটা অসৎ সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এই প্রপাগান্ডার জ্বর বাংলাদেশেও লেগেছে মানে লাগিয়েছে ইংরাজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার। বাংলাদেশে অনেক ব্যক্তি বা তাদের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে, যেমন কোনো ইংরাজি পত্রিকা এদের মধ্যে তারা সেকুলার হয়ে থাকবে ও দেখাবেই এমন ব্রত নিয়ে থাকতে দেখা যায়। কোনো কিছু ব্রত বা প্রতিজ্ঞা হিসেবে থাকা তা হয়তো খারাপ নয়; কিন্তু ফল দেখা যায় উল্টা। কারণ এতে মূল সমস্যা যা দেখা যায় তা হলো, ঠিক কী করলে তাদের আকাক্সক্ষার সেকুলার অবস্থান সেটি হয় বা হতে পারে এটা নিয়ে তাদের কোনো স্পষ্ট ধারণাই নেই। যেমন অনেকেই যদি ভেবে বসে যে, ধর্ম বিশেষত ইসলামকে যদি কষে গালাগাল করে কেউ দিতে পারে তাহলে সে বা ওই আচরণ নিশ্চয় সেকুলার হওয়ার একটা মাপকাঠি মানা যেতে পারে; এমন উদ্ভট সব ধারণা বা গোপন খায়েশ আমাদের অনেকের মধ্যে থাকতে দেখা যায়। এতে পরিণতি দেখা দেয় যে, কখন প্রগতিবাদ আর হিন্দুত্ববাদ এক হয়ে গেছে এরা কেউ টের পায়নি বা খেয়ালই করেনি!
ফেসবুকে ডেইলি স্টারের এক সিনেমা রিভিউ পেজ আছে যার নাম ‘স্টার মুভি রিভিউ’। সেখানে দেখা গেল, দ্য কাশ্মির ফাইলস এই সিনেমা নিয়ে দশ মিনিটের এক ভিডিও বক্তব্য সাঁটা আছে। সঞ্চালকের নাম সৈয়দ নাজমুস সাকিব। তিনি কথা শুরু করেছেন ওই সিনেমার পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীকে সাধুবাদ দিয়ে। কী কারণে? তিনি নাকি ‘এমন একটা ঘটনাকে এই প্রথমবারের মতো বিগ স্ক্রিনে তুলে এনেছেন যা এ পর্যন্ত কেউ তুলে আনেনি; গত ত্রিশ বছর ধরে ঘটনাটা নিয়ে কেউ কথাবার্তা বলেনি। অথচ এটা একটা সত্যি ঘটনা। এই ঘটনাটিতে কোনো মিথ্যার কিছু নেই।’
আসলে এই কথা বলেই সঞ্চালক যে হিন্দুত্ববাদের কবলে পড়ে গেলেন তাই-ই তার হুঁশে নেই। খোদ বিজেপি ও বাজপেয়িও যদি এতে জড়িত থাকেন তাহলে তারা কেন ও কিভাবে এ ঘটনা নিয়ে কথা তুলবে? ঢেকে রাখবে না কেন? প্রথমত, এটা মুম্বাইয়ের কোনো বাণিজ্যিক সিনেমা বলতে যা বুঝায় তা নয়। এটা হিন্দুত্ববাদের পক্ষে দলীয় ভোট জোগাড়ের এক প্রপাগান্ডামূলক সিনেমা। অথচ এটাতে ভান করা হয়েছে যেন এটা একটা সাধারণ বাণিজ্যিক সিনেমাই। আবার এটা হিন্দুদের স্বার্থে করা সিনেমা; অতএব এটা নিশ্চয় ভারতীয় জাতিবাদের স্বার্থের সিনেমা। কাজেই বিজেপি সরকার এ ছবির প্রদর্শন ট্যাক্স ফ্রি করে দিয়ে দেশপ্রেমী জাতি-বোধের জজবা ও জোয়ার তুলুক, আমাদের একে প্রশংসা করতে হবে? এখন লক্ষণীয় কথিত হিন্দুস্বার্থ কিভাবে কোন ফাঁকে ভারতীয় জাতিবাদের স্বার্থ হয়ে গেছে কেউ তা খেয়াল করছে না। হিন্দুস্বার্থ মানেই তা ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থ না-ও হতে পারে, এটাই হলো বটম লাইন। মুসলমান কোপানোকে যদি কেউ হিন্দুস্বার্থ বলে মনে করে তাহলে এটা কি ভারতের স্বার্থ হবেই?
দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় ঘটনা বা সঞ্চালকের চাতুরী বা বোকামিটা হলো, তিনি সাধুবাদ দিয়ে যাচ্ছেন পরিচালককে। কেন ? তিনি মনে করছেন এর আগে কেউ কাশ্মিরের হিন্দু পণ্ডিতদের দেশত্যাগ মানে, ভারতের অন্য শহরে চলে যাওয়া, এই চাপা পড়ে থাকা ঘটনার দিকটা সামনে নিয়ে আসেনি। অতএব পরিচালক অগ্নিহোত্রী নিশ্চয় অনেক মহান মানুষ। তাই কি?
এ থেকে দর্শক ভুল ধারণা পেতে পারে যে, তাহলে কাশ্মির সমস্যা মানে হলো, মুসলমানদের হাতে হিন্দু দলন ও নিপীড়নের ঘটনা। বিজেপির ভাষায় ‘জাস্টিস’- দেশত্যাগী হিন্দু পণ্ডিতদের জাস্টিস দেয়ার কথা কেউ বলেনি। যেন সে জন্যই এক সিনেমা!
ধরা যাক যদি আপনি আপনার কোনো প্রতিদ্ব›দ্বীকে প্রথমে আগ বাড়িয়ে খুবই নির্দয়ভাবে পিটিয়েছেন। পরে ওই প্রতিদ্ব›দ্বী আপনার চেয়ে দল ভারী করে আপনাকে আরো নির্দয়ভাবে পিটিয়ে আরো বেশি সংখ্যায় আহত-নিহত করে দিয়ে গেছে। কিন্তু আপনি খুবই বুদ্ধিমান বলে আগে আপনার পেটানোর অংশ আড়ালে বা বাদ রেখে কেবল আপনাকে কিভাবে কত খারাপভাবে পিটিয়েছে এ নিয়ে এক লোমহর্ষক সিনেমা বানিয়ে ছেড়ে দিলেন, যাতে কেউ এটা দেখলে আপনাকেই খুবই ও একমাত্র ভিকটিম মনে হতে থাকে। আর এর ফলে তা দেখে এক নাজমুস সাকিব বলা শুরু করেন, পরিচালককে ধন্যবাদ যে, তিনি ভিকটিমকে জাস্টিস দেয়ার পথ খুলেছেন, কেউ যা নিয়ে কখনো কথা বলেনি, সে চাপা পড়া বিষয়টাই তিনি সামনে এনেছেন। ব্যাপারটা অনেক সুইট আর প্রগতিবাদী না?
আর এতে আমরা নিশ্চয় আপনাকে ‘খুবই বুদ্ধিমান’ বলব, কী বলেন?
দ্য কাশ্মির ফাইলস-এর সবচেয়ে বড় শঠতা এটাই। কারণ এর উদ্দেশ্য হিন্দু-মুসলমানকে প্রথমে বিভক্ত ও মেরুকরণ করা। পরে হিন্দুরা ভালো, মুসলমানরা খারাপ এভাবে এক তৈরি বয়ানে ঘটনাকে তুলে ধরা, যাতে এবার বিজেপি বা মোদিকে ত্রাণকর্তা মনে হয়। আর তাতে সব হিন্দু ভোট বিজেপির বাক্সে ঢোকে। এ জন্য সে কাশ্মিরের ঘটনা ইতিহাসের আগে-পিছে দেখাবেই না, কাশ্মিরের ঘটনা মানেই তা ১৯৪৭ সালে ভারতের জন্ম অথবা ১৯৫০ সালে ভারতের কনস্টিটিউশন থেকেও শুরু করবে না। এটা শুরু হবে জানুয়ারি ১৯৯০ সালে দেশত্যাগী হিন্দু পণ্ডিতদের ঘটনা থেকে। আবার এটা শেষও আপনি করে দেবেন ১৯৯০ সালের দু-এক বছর পর থেকে। আর প্রচার চালাবেন, এখনো কাশ্মিরের একমাত্র সমস্যা হলো ইনজাস্টিস; দেশত্যাগী হিন্দু পণ্ডিতদের প্রতি ইনজাস্টিস। আর এতে নিশ্চয় আপনার প্রাপ্য হবে সাধুবাদ! তাই কি?
কাশ্মিরের সব অশান্তির শুরু ১৯৪৭ সাল থেকেই। কাশ্মিরের প্রাক্তন রাজা হরি সিং ভারতে অন্তর্ভুক্ত ও বিলীন হয়ে যাওয়ার কাগজে সই করার উপযুক্ত অথরিটি বলে মনে করেন ভারতের প্রায় সব রাজনীতিবিদ। আর রাজনীতিবিদদের এমন মনে করার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় বা একাডেমিকরা ভিন্ন আর কিছু জানেন কি না তা-ও জানা যায় না। বরং সারা ভারত এক মিথ্যা জাতিবাদী জোশে ভুগতে দেখা যায় যে, ব্রিটিশ কলোনি দখলদাররা নাকি স্বদেশী আন্দোলনের নামে জমিদার হিন্দুর সন্ত্রাসবাদ বা কংগ্রেসের আন্দোলনে মুখে টিকতে না পেরেই ভারত ত্যাগ করেছিল। অথচ এ কথা শতভাগ মিথ্যা। ফ্যাক্টস হলো, কেবল ব্রিটিশরা নয়, সারা দুনিয়া থেকে সব কলোনি শাসকই ১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ থামার পরে স্ব স্ব কলোনি ছেড়ে স্বেচ্ছায় নিজ নিজ দেশে চলে গিয়েছিল। আর তারা ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল যে কারণে ঠিক সেই একই কারণে, রাজা হরি সিং-সহ তার মতো কোনো রাজারই ভারতে অন্তর্ভুক্ত ও বিলীন হওয়ার কোনো কাগজ-দলিলে স্বাক্ষর করার অথরিটিই ছিল না। আর এসব কিছুর পেছনে মূল কারণ হলো ‘আটলান্টিক চার্টার’ চুক্তি। এটাকে বলা যায়, আমেরিকার সাথে কলোনি দখলদার ইউরোপের চুক্তি। এই চুক্তিতে বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইউরোপের কলোনি দখলদাররা বিনা শর্তে দখলদারি ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আর এই শর্তেই আমেরিকা হিটলারের বদলে ব্রিটিশ-ফরাসি ইত্যাদি মিত্রশক্তির পক্ষ নিয়ে বিশ্বযুদ্ধে প্রথম যোগ দিতে সম্মত হয়েছিল। এতে ফেলে যাওয়া কলোনির কোনো রাজার আর কোনো অথরিটিই নেই, থাকবে না যে, সে ওই দেশকে নিয়ে নিজ খেয়ালে অন্য কোনো দেশের ভেতর যোগ দেয়। ওই দেশ কার দ্বারা শাসিত হবে, এর একমাত্র নির্ধারক হবে ওই ভূখণ্ডের জনগণ বা পাবলিক। ফলে তা নিজ পাবলিক ভোটের সম্মতিতে এক স্বাধীন রিপাবলিক রাষ্ট্র হতে পারে। ব্রিটিশরা চলে গেলে কাশ্মিরেরও এমন হওয়ার কথা।
কিন্তু নেহরু কখনো এমন আটলান্টিক চার্টার চুক্তির কথা জানতেন, এর চিহ্ন-প্রমাণ পাওয়া যায় না। এমনকি এই চুক্তি-ই যে, জাতিসঙ্ঘের জন্ম ঘোষণার ভিত্তি -দলিল সেটিও নেহরু জানতেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং উল্টা প্রমাণ আছে। এসবেরই ফলাফলে নেহরু কাশ্মিরকে জবরদস্তিতে ভারতের অংশ করে রাখার পক্ষে জোড়াতালি কিছু কাজ করে যান। কাশ্মিরের সব সমস্যার শুরু এখান থেকে।
দ্বিতীয় বড় ফ্যাক্টস হলো, জম্মু-কাশ্মির মিলে ২০১১ সালের হিসাবে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১.৩ কোটি যার ৬৮.৩% হলো মুসলমান আর হিন্দুরা ২৮.৪; বাকিটা অন্যান্য। আর ভারত রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই হিন্দু-মুসলমান সমস্যা যেটা সেটাই কাশ্মিরের ওপরেও ভর করেছিল যদিও তা অনেক পরে ১৯৮৭ সালের আগে-পরে।
অর্থাৎ ভারতের ‘আদি পাপ’ হলো, সব নাগরিকদের সমান অধিকারের রাষ্ট্র হবে, সে হবে না। মানে অধিকারভিত্তিক নাগরিক রাষ্ট্র তা হবে না। বরং ধর্মভিত্তিক জাতি-রাষ্ট্র হতে হবে। আর যে ধর্মের লোক সংখ্যায় বেশি মানে হিন্দুরা এ রাষ্ট্রে আধিপত্য নেবে।
যেমন সাম্প্রদায়িক শব্দটাকে ভাঙেন, যে শব্দটা দুনিয়ার আর কোনো রাষ্ট্রে নেই। আর এ শব্দের আসল অর্থ হলো, হিন্দু আধিপত্যের স্বার্থে ডিফাইন করা সীমার মধ্যে মুসলমানদের বসবাস, জীবন যাপন করতে হবে। মুসলমানরা ধর্মীয় চিহ্ন প্রদর্শন করে চলতে পারবে না। যদি তা না অনুসরণ করে তবে ওসব মুসলমানকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে নিন্দা করা হবে। বিপরীতে যেসব মুসলমান তা মানবে, মানে হিন্দু আধিপত্য কর্তৃত্ব মেনে নেবে তাদের মানার শর্তেই তারা হিন্দুদের পাশে সমাজে মানে যেমন স্কুলে অফিসে পাশে বসতে দেয়া হবে। আর তাতে এসব মুসলমানরা ‘অসাম্প্রদায়িক’ বলে গণ্য হবে।
যেমন মোগল আমলে সাম্প্রদায়িক শব্দটা নেই। তখন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কথাও জানা যায় না। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে বেশির ভাগ জমিদারি হিন্দুরা নেয়াতে (যে জমিদারি মানে, ব্রিটিশ শাসকের নিচে ওই সমাজের নিয়ামক শক্তি ) এবার তারা তাদের আধিপত্য (ধর্মীয় পরিচয়ে আধিপত্য) চালু করেছিল। আসলে হিন্দু জাতিবাদের ভিত্তিতে হবু ভারত গড়তে হবে -কংগ্রেসের এই নীতির ভিত্তিতে জন্ম -এটা ক্রমেই ওই জমিদার-হিন্দু আধিপত্যের পক্ষে সাফাই হিসাবে হাজির হয়েছিল।
এখন কাশ্মিরকে ভারতের অঙ্গীভ‚ত করার পরেও নেহরু শান্তিতে থাকতে পারেননি। সারা ভারতে মোট মুসলমান মাত্র প্রায় ১৫% তবে কোথাও কোথাও মানে, রাজ্যে বা শহরে তা বড়জোর ২৫-৩০%। ফলে সহজেই হিন্দু আধিপত্য মানে হিন্দু সামাজিক-রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম রাখা সহজ ছিল যদিও তা সমাজে সবধরনের নাগরিক অসাম্যের প্রধান উৎস।
কিন্তু ভারতের এই হিন্দু শাসকরা তাদেরই আধিপত্যের তত্ত্ব মুসলমানরা কেমন অনুভব করে তা কাশ্মিরে টের পেয়েছিলেন, ওই একই তত্ত¡ কাশ্মিরে তাদের বিপক্ষে। কারণ কাশ্মিরে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরই প্রধান প্রকাশ ঘটেছিল ১৯৮৭ সালের (প্রাদেশিক বা অ্যাসেম্বলি) নির্বাচনে। কারণ তত দিনে কাশ্মিরের অতিষ্ঠ মুসলমানরা, তাদের ব্যক্তি বা সামাজিক-রাজনৈতিক দল বা গ্রুপগুলো একজোট হয়ে মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্ট (এমইউএফ) গড়ে ওই নির্বাচনে লড়ে ক্ষমতা নিতে তৈরি হয়েছিল। এই এমইউএফ ছিল ১৯৮৪ সালে গড়ে তোলা প্রথম ভ্রুণ এক ছাত্রসংগঠন, যার নাম ছিল ইসলামী স্টুডেন্ট লিগ। আসলে ভারতের আধিপত্য তত্ত্ব অনুসারে, কাশ্মিরে হবু মুসলমান আধিপত্য দেখে তারা প্রমাদ গুনে বিপদ বুঝতে পারে আর এটা তারা মেনে নিতে পারেনি।
মূল কারণ নাগরিক অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র হলে সেখানে ধর্মীয় বা সব ধরনের পরিচয় নির্বিশেষে সবাই সমান নাগরিক হয়ে থাকতে পারে আর নাগরিকের যদি সবাই সম-অধিকারের নাগরিক হয়, কারো কারো আধিপত্যের আলাপ সেখানে থাকে না। কিন্তু বাস্তবের ভারত ছিল এর বিপরীত। হিন্দু-জাতিবাদী কংগ্রেসের হাতে পড়ে সেটি হিন্দু আধিপত্যের ভারত হয়ে উঠেছিল। আর তা একইভাবে কাশ্মিরের মুসলমানরা অনুসরণ করতে গেলে হিন্দুদের জন্য সব বিপদ ঘনিয়ে ওঠে।
এই বার্তাটা কাশ্মির জাতীয় কংগ্রেসের নেতা ফারুক আবদুল্লাহ নজর করেন। কারণ তিনি এমইউএফ-এর ভেতরের নেতা ও দল নয়। তিনি ততকালের বিষয়টাকে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর কানে তোলেন; সাথে আলাপ করেন এই এমইউএফ-এর উত্থান ঠেকাতে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ব্যাপক হলেও সরাসরি নির্বাচনী কারচুপি করেই তারা এই উত্থান ঠেকাবেন। ওই নির্বাচনের ভোটদানের পরেই এমইউএফের প্রায় সব নেতাকর্মীকে তারা গ্রেফতার করেন আর পরে প্রতিটা কেন্দ্রের ফলাফল ওই দিন দূরে থাক সপ্তাহ-দশ দিন পরে ইচ্ছামতো ঘোষণা করেছিলেন। আর এখান থেকে কাশ্মিরের রাজনীতি আর প্রকাশ্য রাজনীতি ও নির্বাচনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। পরের বছর ১৯৮৮ সাথে সারা কাশ্মির সশস্ত্র রাজনীতিতে চলে যায়। তার পর থেকে কাশ্মিরে নির্বাচনের আর কোনো গুরুত্ব থাকেনি। কংগ্রেস-বিজেপির ভাষায় যা ‘জঙ্গিবাদ’ হয়ে যায়। আর বিজেপির বাজপেয়ি নতুন বয়ানে হাজির হলেন। তিনি কংগ্রেসের হাতে নির্বাচনী কারচুপি করে রাজনীতিকে সশস্ত্রতার দিকে ঠেলে দেয়া ভুলে গেলেন, অস্বীকার করলেন। আর এক নয়া বয়ান হাজির করলেন যে, কাশ্মিরের সব সমস্যার উৎস ‘সীমা পার কী আতঙ্কবাদ’ -মানে কাশ্মিরের সব সমস্যার উৎস নাকি পাকিস্তান থেকে আসা টেরোরিজম!
আর ওদিকে কাশ্মিরের সশস্ত্র রাজনীতিতে এই প্রথম প্রতিহিংসাবশত দু-একজন হিন্দু পণ্ডিতকে হত্যা করা হয়েছিল। পরে যেটার সবচেয়ে বড় আর ব্যাপক হত্যার ঘটনাটা ছিল ১৯৯০ সালের ১৯ জানুয়ারি। আর এবারও কংগ্রেস, বিজেপি, ফারুক আবদুল্লাহ আর মুফতি সাঈদ সবাই একজোটে অবদান রেখে পণ্ডিতদের জম্মু ছেড়ে চলে যেতে উৎসাহিত করেছিলেন। ভেবেছিলেন এতে সশস্ত্রতার বিরুদ্ধে একটা চাপ হবে। কাশ্মিরের গভর্নর বা কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুফতি সাঈদ বা বিজেপি সমর্থিত কোয়ালিশনে ভিপি সিং-এর সরকারের আমলে এই জম্মুত্যাগের ঘটনাটা ঘটানো হয়। যদিও কেউ এ থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি। কিন্তু শিক্ষাটা হলো, কোনো একটা ধর্মীয় আধিপত্যের জাতিরাষ্ট্র গড়বেন নাকি অধিকারভিত্তিক সাম্যের নাগরিক রাষ্ট্র? যেমন গড়বেন তেমন ফল পাবেন। এটা না সারা ভারতে অথবা না কেবল কাশ্মিরে কোনো একটি ধর্মীয় আধিপত্যের রাষ্ট্র, কোথাও কারো জন্য ফলদায়ক হয়নি। আর আপনি যদি হিন্দু আধিপত্যের জাতিরাষ্ট্র চান তবে নিশ্চিত থাকতে পারেন, আপনি তার মানে সে দেশে মুসলমান আধিপত্যের আরেক জাতিরাষ্ট্রের চিন্তার জন্ম হতে দাওয়াত দিচ্ছেন।
ঠিক যেমন এখন ভারতে শুরু হয়েছে হিন্দুত্ববাদের আধিপত্যের রাষ্ট্র গড়া। এতে আরেকবার মুসলিম লীগের মতোই মুসলিম জাতিরাষ্ট্র চিন্তার জন্মকে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে।
তাহলে কাশ্মির ফাইল কী দাঁড়াল? সেটি হচ্ছে কাশ্মিরের সব ইতিহাস ফেলে কেবল ১৯৯০ সালে কাশ্মির পণ্ডিতদের জম্মু ছেড়ে চলে যাওয়াটাকে সামনে এনে বিজেপির পক্ষে সহানুভ‚তি জোগাড়, এই হিন্দুত্ব উত্থানের চেষ্টা করা হচ্ছে। আবার ১৯৪৭ সাল থেকে কত কাশ্মিরি মরেছে সেটি নয়; কেবল ১৯৯০ সালে সব বুঝাবুঝি সীমাবদ্ধ করতে চাইছেন। আর দাবি করছেন মুখরোচক শব্দ -জাস্টিস। কেবল ১৯৯০ সালকে জাস্টিস দিতে চাইছেন।
ডেইলি স্টারের ওই সঞ্চালক অনুষ্ঠান শেষে বারবার অনুরোধ করছিলেন কাশ্মিরের ইতিহাস জেনে যেন তার কথার প্রতিবাদ বা ভিন্নমত নিয়ে কেউ আসেন। অথচ তিনি নিজেই আসলে কাশ্মিরের ইতিহাস জানেন না। তার কাছে কাশ্মিরের ইতিহাস মানেই কেবল ওই ১৯৯০ সাল ও কাশ্মির পণ্ডিতদের জম্মু-ত্যাগ মাত্র। তামাশার আসলে কোনো শেষ নেই। তিনি টেরই পেলেন না যে, তিনি পরিচালক অগ্নিহোত্রীর হিন্দুত্ববাদের পাল্লায় পড়ে অন্ধ হয়ে গেছেন। অথচ তিনি মনে করছেন, নির্যাতিত হিন্দুদের পক্ষ নিয়েছেন; তাহলে এটা নিশ্চয় প্রগতিবাদী অবস্থান। কিন্তু কে তাকে বোঝাবে ঠিক এখানেই প্রগতিবাদ=হিন্দুত্ববাদ এক হয়ে গেছে! তাই তিনি হিন্দুত্ববাদকেই প্রগতিবাদ ঠাওরাচ্ছেন!! বেচারা ডেইলি স্টার!!!
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এনটি