শায়েখ মুহিউদ্দীন ফারুকী।।
শাবান মাসের একেবারেই শেষপ্রান্তে আমরা। এই সময়ে সকল মুমিনেরই রমজানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত। কারণ যথাযথ প্রস্তুতির মাধ্যমেই ভালো কিছু করা সম্ভব। রমজান থেকে পরিপূর্ণ উপকৃত ও পরিপূর্ণ লাভবান হওয়া সম্ভব। তবে প্রত্যেক মুমিন যেভাবে রমজানের জন্য প্রস্তুতি নিবে, সেই তুলনায় একজন দাঈ, খতিব বা আলেমের রমজান প্রস্তুতি হবে ভিন্ন। নিজের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার সাথে সাথে উম্মাহর বিষয় নিয়েও তাকে ভাবতে হবে।
একজন দাঈ ও খতিব রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে যা করতে পারেন:
এক. প্রথমত সবার মতই নিজে ঈমানী, আমলী ও চারিত্রিক প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। তাওবা ইস্তেগফারের মাধ্যমে পুতপবিত্র হয়ে নতুনভাবে একটি জীবন শুরু করতে চেষ্টা করবে। মানসিকভাবে পূণ্যের বসন্ত থেকে সব ধরণের বরকত হাসিলের প্রস্তুতি নিবে।
দুই. নবী করীম (সা.) রমজান আসার আগেই সবাইকে শুভেচ্ছা জানাতেন, অভিনন্দন জানাতেন, সুসংবাদ দিতেন।
তিনি বলতেন, তোমাদের সামনে রমজান মাস চলে এসেছে। মুবারক মাস চলে এসেছে। এই মাসের অনেক ফজিলত রয়েছে।’ এভাবে তিনি সকলকে অভিনন্দন জানাতেন। তাই একজন দাঈ ও খতিব রাসূল (সা.) এর উত্তসূরি হিসেবে সবাইকে রমজানের সুসংবাদ ও অভিনন্দন জানাতে চেষ্টা করবে।
তিন. যারা হাফেজে কুরআন আছেন তারা ভালোভাবে কুরআন হিফজের বিষয়টির লক্ষ্য রাখতে পারেন।...
রমজানকে সামনে রেখে যারা গাইরে হাফেজ রয়েছেন তারা এই কয়েকদিনে আয়াতুস সিয়াম অর্থাৎ সূরা বাক্বারার ১৮৩ নাম্বার আয়াত থেকে ১৮৭ নাম্বার আয়াত পর্যন্ত হিফজ করে নিবেন। সেই সাথে অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর পড়বে। প্রতিটি শব্দ ও আয়াত নিয়ে কিছুক্ষণ তাদাব্বুরও করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ‘ফান্নুত তাদাব্বুর’ বা তাদাব্বুর করার পথ ও পদ্ধতি শীর্ষক কোনো কিতাব বা বই পড়ে নিলে বেশি উপকৃত হওয়া যাবে।
চার. সিয়াম বিষয়ক হাদিসগুলো হিফজ করা জরুরী। বিশেষত বুখারি, মুসলিমসহ সহিহ হাদিসগুলো হিফজ করা অবশ্য কর্তব্য। সেগুলোর অনুবাদ শিখে নেওয়া জরুরী। সেই সাথে কোনো নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে এর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেখে নিতে হবে। এগুলো আমাদের রমজান পালনে এবং অন্যকে জানাতে ইলমী শক্তি ও সাহস যোগাবে।
একজন আলেম হিসেবে, দাঈ বা খতিব হিসেবে এ বিষয়টি খুবই প্রয়োজনীয়। রাসুল (সা.) রমজানটা কিভাবে কাটিয়েছেন সেটাও সিরাত থেকে এবং হাদিস অধ্যয়নের মাধ্যমে জেনে নেওয়া দরকার। এবিষয়ে দু একটি কিতাব পড়ে নেওয়া যায়। বিশেষত ড. ফয়সাল বা‘দানির “হাকাযা কানান নাবিউ সা. ফি রমাদান” লেখা কিতাবটি অত্যন্ত মুফীদ।
পাঁচ. আমরা রমজান আসলে বিভিন্ন ভাবেই সাধারণ মানুষের অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হই। তারা আমাদের কাছে অনেক কিছু জানতে চায়। কিন্তু দুঃখজনক হল, আমরা ইলমীভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ না করার কারনে অনেক সময় সেধরনের প্রশ্নের উত্তর সঠিক, সুন্দর ও প্রাঞ্জল করে এবং মানুষ গ্রহণ করবে এমনভাবে উপস্থাপন করতে পারি না।
সাধারণ মানুষেরা রমজানে বিভিন্ন কারণেই আলেম, দাঈ ও খতীবদের খুব বেশি শরণাপন্ন হয়। তারা একটু পরপরই বিভিন্ন বিষয় জানার জন্য প্রশ্ন করে। তখন সুন্দর উত্তর না পেলে হতাশ হয়। ভিন্ন কোথাও খুঁজতে থাকে। তাই এই দিক বিবেচনায় প্রথমত সিয়াম বিষয়ে কয়েকটি কিতাব অধ্যয়ন করে ফেলতে হবে। ছোট দু’একটি রিসালা বা পুস্তিকা পড়তে হবে।
সিয়াম, লাইলাতুল কদর, যাকাত ও ঈদ বিষয়ে আলাদা আলাদা কিতাব পড়তে হবে। এভাবে পড়তে পারলে নিজের মধ্যে একধরণের শক্তি আসবে। ভয় ও আশঙ্কা কেটে যাবে। অন্তত নিজের আমলগুলো জেনে বুঝে করা যাবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলিষ্ঠতার সাথে উত্তর দেওয়া যাবে।
এক্ষেত্রে ফিকহের একটি কিতাব থেকে কিতাবুস সাওমও পাড়া যায়। বিশেষত ফিকহে হানাফির গুরুত্বপূর্ণ মতন হিসেবে কুদূরি এবং সেই সাথে আরবের কোনো প্রাথমিক কিতাব থেকেও পড়া যেতে পারে। এছাড়া বাংলায় লেখা একটি কিতাব পড়ে নিলে ভালো হবে। যারা শিক্ষক আছেন তারা সার্বিক সতর্কতা বজায় রেখে কুদূরির কিতাবুস সিয়ামের দরসও দিতে পারেন।
ছয়. দ্বিতীয়ত রমজানের প্রশ্নোত্তর সম্বলিত কোনো কিতাব বা বই পড়ে নিতে হবে। এতে মানুষেরা কি ধরণের প্রশ্ন করতে পারে তা জানা যাবে এবং সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পদ্ধতিও আয়ত্ব করা যাবে। সাথে দলীল প্রমান উপস্থাপন বা সূত্র উল্যেখ করার পদ্ধতি শেখা যাবে। এক্ষেত্রে আল কাউসারের রমজান বিষয়ক প্রশ্নোত্তরগুলো পড়ে নিবে। এছাড়া আরবদের বিভিন্ন ওয়েব সাইটে প্রশ্নের উত্তরগুলো দেখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্যই স্থান ও কালের ভিন্নতার বিষয়টি মাথায় রেখে অধ্যয়ন করতে হবে।
সাত. জনসেবামূলক কিছু উদ্যোগ গ্রহন করা। বিশেষত ইফতারি উপলক্ষে কিছু খেজুর, কিছু ছোলাসহ ইফতারি সামগ্রী হাদিয়া হিসেবে প্রতিবেশী ও আশে পাশের মানুষকে পাঠানো যেতে পারে। ...
একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে, ইফতারি করানো ছাওয়াবের কথা আমরা যেভাবে প্রচার করি সেভাবে এর আমলেও আমাদের এগিয়ে থাকা দরকার। এর জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন সুন্দর পরিকল্পনার।
এক্ষেত্রে আমি যেই পরিকল্পনাটি করে থাকি তা হচ্ছে, রমজান শেষ হওয়ার পর থেকেই আগামী রমজানের জন্য একটি মাটির ব্যাংক বা পটে ইফতার প্রকল্প লিখে টাকা জমাতে থাকি। পরিবারের সবাইকে অংশগ্রহণ করতে বলি। এভাবে রমজান আসতে আসতে অনেক টাকা হয়ে যায় আলহামদুলিল্লাহ। তখন সেটা দিয়ে কিছু রোজাদারকে ইফতারি করাতে চেষ্টা করি। দাঈ ও খতিব সাহেবরাও এই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করে দেখতে পারেন। আশা করি এর মাধ্যমে ইফতার করানোর আমলটি সহজ হবে।
সার্বিকভাবে একজন দাঈ, খতিব বা তালিবুল ইলম ঈমানী ও ইলমী প্রস্তুতি নিয়ে রমজানকে বরণ করবে। আমল, কোরআন তেলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে রমজানকে ফলপ্রসু করে তুলবে। সেই সাথে প্রতিবেশী ও অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়ে মানব সেবায়ও অবদান রাখতে চেষ্টা করবে। এভাবে অগ্রসর হলেই নবির উত্তরসূরি হিসেবে সমাজে তার বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক: আরাবি ভাষার শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, মারকাযুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ বাংলাদেশ
এনটি