বিয়ে একটি বিধিবদ্ধ, সার্বজনীন এবং পবিত্র ব্যবস্থা। মানুষকে স্বেচ্ছাচারী জীবনের উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে রক্ষা করতে ইসলাম বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য জোর তাগিদ প্রদান করেছে। বৈরাগ্য ইসলামে নিষিদ্ধ। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বিয়ে না করা ইসলামে নিষিদ্ধ ও ভর্ৎসনামূলক একটি অপরাধ।
পবিত্র কোরআনে বিয়ে এবং স্ত্রী গ্রহণের ব্যবস্হাকে নবী-রাসুলের প্রতি আল্লাহতায়ালার বিশেষ দান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী! তোমার পূর্বেও আমি অনেক নবী-রাসুল পাঠিয়েছি এবং তাদের জন্য স্ত্রী ও সন্তানের ব্যবস্থা করেছি।’ (সুরা রাদ)। বর্ণিত আয়াতের মর্মবাণী থেকে বোঝা যায়, বিয়ে আল্লাহ প্রদত্ত এক ঐশী বিধান।
বর্তমানে সময়ের প্রেক্ষিতে বিয়ের, গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও -এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আওয়ার ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছেন কুষ্টিয়ার এদারাতুত তাওহীদ ইসলামিয়া মাদরাসার নাজেমে তালিমাত মুফতি মামুনুর রশিদ কাসেমী। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি তরুণদের মাঝে বিয়ে নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছেন। সম্প্রতি এ বিষয়ে তার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমেও বেশ সাড়া ফেলেছে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রতিবেদক নুরুদ্দীন তাসলিম।
বিয়ের গুরুত্বের বিষয়ে আপনার কাছ থেকে কিছু জানতে চাই?
মুফতি মামুনুর রশিদ কাসেমী: শরীয়তের চাহিদা হল, ছেলে অথবা মেয়ে বালেগ হয়ে গেলে তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া। প্রকৃতিক নিয়মেই বালেগ হওয়ার পরপরই তারা সঙ্গীর চাহিদা অনুভব করে।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও বলেছেন, যখন সন্তানেরা বালেগ হয়েছে যাবে তাদের বিয়ে দিয়ে দাও। কারণ বালেগ হওয়ার পরপরই ছেলে, মেয়েরা জীবন সঙ্গীর চাহিদা অনুভব করলেও তাদের সঙ্গী বাছাইয়ের মত জ্ঞান হয় না।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটাও বলেছেন, যদি সময় মত সন্তানদের বিয়ে না দেওয়া হয় এবং এ কারণে তারা কোন পাপাচারে লিপ্ত হয়, তাহলে এর দায়ভার পুরোই অভিভাবকের উপর বর্তাবে।
মেয়েদের যেহেতু ভরণপোষন ও সংসারের খরচ চালানোর বিষয়ে চিন্তা করতে হয় না, তাই মেয়ে বালেগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার দায়িত্ব হল উপযুক্ত ছেলে খুঁজে বিয়ের ব্যবস্থা করা। এজন্য বয়স কেমন হবে?-এটা সবার ভাগ্যের ব্যাপার। যার যার ভাগ্য ও বয়স অনুযায়ী বিয়ে হবে। তবে অভিভাবক হিসেবে বাবার দায়িত্ব সময় মত সচেতন হওয়া।
সময়মত বিয়ে না হওয়ার ক্ষতির দিকগুলো নিয়ে কিছু বলতে চাইবেন কি?
মুফতি মামুনুর রশিদ কাসেমী: ভয়াবহ ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে তরুনরা। মোবাইল ইন্টারনেটে চরিত্র বিধ্বংসী বিভিন্ন কন্টেন্ট দেখে নিজেদের গুনাহের পাল্লা ভারি করছে আমাদের সন্তানেরা। মোবাইল ইন্টারনেটের যুগে তরুণদের চারিত্রিক স্খলনটা বেশিই ঘটছে।
বয়স ১৪/১৫ পার হওয়ার পরই ৯৮% ছেলেরা অশ্লীল কন্টেন্টের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। জৈবিক চাহিদা পূরণের বৈধ পন্থা খোলা না থাকায় তারা হস্তমৈথন ও অন্যান্য পাপাচারের লিপ্ত হচ্ছে। মেয়েদের ক্ষেত্রেও এর বিপরীত হচ্ছে না।
২০/২৫/ ৩০ বছর পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু অভিভাবক সন্তানকে বিয়ে দিচ্ছে না। ফলে তারা গুনাহের পথে নিজের চাহিদা পূরণ করছে। সমাজের একটা বাস্তব চিত্রের কথা বলছি আমি। আর এজন্যই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সন্তানদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন।
অনেক বাবার সক্ষমতা থাকার পরেও সন্তানকে তিনি বিয়ে করাচ্ছেন না, শুধু এই অজুহাতে যে ছেলের বয়স কম। অথচ সে পাপাচারে লিপ্ত হচ্ছে এই ব্যাপারে কোন খেয়াল নেই।
বিয়ের ক্ষেত্রে সব থেকে বড় যে প্রশ্নটি সামনে আসে তাহলো, ‘ভরণপোষণ’। বলা হয়, ‘যে ছেলের নিজের খরচ যোগানোর সক্ষমতা হয়নি, সে কিভাবে স্ত্রীর দায়িত্ব নিবে’?
মুফতি মামুনুর রশিদ কাসেমী: বিয়ের পর স্ত্রীর ভরণপোষণ, দায়িত্ব গ্রহণ করা ছেলেদের একান্ত কর্তব্য। বালেগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণের মত সক্ষমতা থাকে না ছেলেদের।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, সন্তানরা বালেগ হয়ে গেলে তাদের বিয়ে দিয়ে দাও। ছেলেরা বালেগ হওয়ার পর তাদের বাবা-মায়ের সক্ষমতা আছে কিনা এ বিষয়টি দেখতে হবে।
এছাড়া ছেলেরা বালেগ হওয়ার পর কিন্তু তাদের লেখাপড়া ও হাত খরচের টাকা বহন করার দায়িত্ব আর বাবার কাঁধে থাকে না। এরপরও আমাদের দেশের বাবারা সন্তানকে পড়াশোনা করিয়ে উচ্চশিক্ষিত করে তুলছেন, তাদের উপর এহসান করছেন। ছেলের পেছনে মাসে লাখের উপর খরচ করছেন। তাদের মোবাইল খরচ বহন করছেন। তাদের বিভিন্ন প্রয়োজন পূর্ণ করছেন। এখন যদি ছেলে নিজের পক্ষ থেকে বলে আমাকে বিয়ে দিতে হবে। দেখবেন এরপরই অভিভাবক তার খরচ দেওয়া বন্ধ করে দিবে। আমাদের আসলে মানসিকতা পাল্টাতে হবে।
সচেতন বাবাদের ভাবা উচিত, তিনি নিজের ছেলের খাবার-দাবার,পড়াশোনার খরচ বহন করছেন, দামী মোটর সাইকেল কিনে দিচ্ছেন। বাবারা বিয়েকেও সন্তানের খাবার-দাবার, পড়াশোনার মত মৌলিক চাহিদা হিসেবে গণ্য করতে পারেন।এবং ছেলের স্ত্রীর জন্য মাসের একটা বরাদ্দ রাখতে পারেন। কিন্তু আমাদের সমস্যা হল, আমাদের মন- মগজে বসে গেছে ছেলে স্টাবলিশ হতে হবে। এরপর তাকে বিয়ে করানো হবে।
দ্বীনদার পরিবারগুলো এ বিষয়টিতে কতটা সচেতন বলে মনে করেন?
মুফতি মামুনুর রশিদ কাসেমী: সাধারণ পরিবারগুলো তো এক রকম ভাবনা নিয়ে চলছে, দ্বীনদার ও আলেম পরিবারগুলোতেও আজকাল একই রকম চিত্র। আলেম পরিবারগুলোর ভাবনা হল, ছেলে দাওরা শেষ করবে, তাখাসসুস পড়বে, সালে সময় দিবে, এরপর ২ বছর খেদমত করে তারপর বিয়ে করবে।
আর যেই ছেলেদের বাবার অথবা নিজের সক্ষমতা নেই তাদেরকে আমি ধৈর্য্য ধারণের, আল্লাহ তায়ালা কাছে রোনাজারীর উপদেশ দিব।
আমার নিজের দেখা এমন ঘটনা রয়েছে, এক দ্বীনদার পরিবারের সন্তান নিজের বিয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরল বাবার কাছে, কিন্তু ছেলে ছোট এই অজুহাতে বাবা ছেলেকে বিয়ে দিতে রাজি হলেন না। এর কিছুদিন পরেই অপ্রীতিকর এক ঘটনায় ফেঁসে গেল ছেলেটি। তখন ছেলেকে বাঁচাতে বাবাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হল।এতে ইজ্জত, সম্মান, টাকা সব গেল, ছেলের ভবিষ্যতেও দাগ লাগলো। আমাদের আসলে মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।
অভিভাকদের ভূমিকার বিষয়ে কিছু বলবেন কি?
মুফতি মামুনুর রশিদ কাসেমী: আমার ছোট ভাই মেশকাতে পড়ছে। আমি নিজেই তাকে বিয়ে করিয়েছি। বলেছি, ভাই; তোমার স্ত্রীর ভরণপোষণ সংক্রান্ত যেকোন খরচের জন্য আমাকে বলবে। সে আমাকে বলেছে, ভাইয়া আমি চাই দেশের সবাইকে যেন আল্লাহ তায়ালা আপনার মত ভাই দান করেন।
এজন্য সচেতন অভিভাবক- বাবা, ভাই যদি মনে করেন আমি আমার পড়াশোনা করা ছোট ভাইকে বিয়ে করিয়ে দিব, ৩ ভাই মিলে শিক্ষার্থী ছোট ভাইয়ের পরিবারের জন্য খরচ দিব। তাহলে কিন্ত সে গুণাহ থেকে বেঁচে হালাল পন্থায় নিজের জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে কেউ এভাবে ভাবেন না।
ছেলেরা বিয়ে করতে চাইলে অনেকে পরিবারই বলে বসে তোর ইনকাম কত যে তুই বিয়ে করতে চাইছিস?- এজন্য আমি বলি, তাড়াতাড়ি বিয়ে, বিয়ে সহজ করা, বেশি বিয়ে- এই বয়ানগুলো তরুণ নয় বরং অভিভাবদের বেশি বেশি করা প্রয়োজন, তারা অগ্রসর হলেই সম্ভব।
আমার ১৯ বছর বয়সি এক ছোট ভাইয়ের বিয়ের বিষয়ে আমি একজনের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। তাকে বিয়ে করিয়ে দিব কিনা?- তিনি আমাকে বললেন, দেখেন তাকে আপনি বিয়ে করালেও সে আলেম হয়ে যাবে, না করলেও সে আলেম হবে। কিন্ত যদি বিয়ে করিয়ে দেন তাহলে সে একটা ম্বচ্ছ ও নিষ্পাপ জীবন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করবে। তার জীবনে পাপ-পঙ্কিলতা নিয়ে কোন আক্ষেপ- আফসোস থাকবে না। আর বিয়ে না করালে সে হাজারো গুনাহ সঙ্গে নিয়ে পড়াশোনা শেষ করবে। আজীবন তার ভেতর অনুশোচনাবোধ কাজ করবে।
সময়মতো বিয়ের পরও অনেককে বিভিন্ন পাপাচার-জেনা- ব্যভিচারে লিপ্ত হতে দেখা- এ বিষয়ে কি বলবেন?
মুফতি মামুনুর রশিদ কাসেমী: দেখুন শরীয়তে হালাল ইনকামের কথা বলা হয়েছে। এরপরও যদি কেউ চুরি করে হারাম খেতে চায় তাহলে আপনার আমার কি করার আছে। এজন্য তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
অনেকে আমাকে প্রশ্ন করে, হুজুর, চার বিয়ে করলেই কি জেনা বন্ধ হবে/- আমি বলি, না, জেনা বন্ধ হবে না। কিন্তু পাপাচার বন্ধের জন্য বিবাহ সহজ, তাড়াতাড়ি এবং বেশি বিয়ের প্রচলন করতে হবে, এরপর অপরাধের যেই শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে তার বাস্তবায়ন করতে হবে।
পৃথিবীতে এমন অসংখ্য মানুষ আছে যারা বিয়ের পরেও জেনা ব্যভিচারে লিপ্ত। তাদের অপরাধ থেকে ফেরাতে শানস্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। শাস্তি না থাকার কারণে এমন মানুষরা পাপাচারে লিপ্ত হচ্ছে।
আসলে মানুষ তো কত ধরনের পাপাচারে লিপ্ত। সব নিয়ে আমরা কথা বলতে পারবো না, কাজ করতে পারবো না। কিন্ত আমাদের মূল উদ্দেশ্য হল যারা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে, তার বিধান মানতে চায় তাদের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো।
অভিভাবক ও তরুণদের কোন বার্তা দিতে চাইবেন কি?
মুফতি মামুনুর রশিদ কাসেমী: অভিভাবকদের বলবো, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জন্য যে আদর্শ রেখে গেছেন এবং যে আদেশ করেছেন সন্তানদের বালেগ হলেই বিয়ে করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে, আমরা তা বাস্তবায়ন করবো। এবং এজন্য আমাদের নিজেদের কিছু পয়সা খরচ করতে হলে তা করবো।
আর যদি এমন সক্ষমতা না থাকে তাহলে আমি তরুণদের বলবো তোমরা রোজা রাখবে, আল্লাহর ভয়কে সামনে রাখবে, আল্লাহর কাছে কান্নাকটি করবে। দোয়া করবে, আল্লাহ; আপনি আমাকে গুনাহ থেকে হেফাজত করুন। আর যদি নিজেকে কন্ট্রোল করা সম্ভব না হয় তাহলে আমার জন্য এমন কোন অভিভাবকের ব্যবস্থা করে দিন, যার মাধ্যমে আমি নিজেকে গুনাহ থেকে রক্ষা করতে পারি।