শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


‘অনভিজ্ঞ ও নবীনদের মাধ্যমে যেন মহিলা মাদরাসা পরিচালিত না হয়’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কওমি মহিলা মাদরাসা। দেশের নারীদেরকে শিক্ষিত, সভ্য, দ্বীনদার ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার অনন্য এক কেন্দ্র এটি। দেশে কয়েকযুগ ধরেই চলছে নারীদের শিক্ষাব্যবস্থার নতুন এ সংযোজন। প্রচলিত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে কাজ করছে? শিক্ষিত নারী জাতি গঠনে এসব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাই বা কী? কোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখী হচ্ছে কি তারা? এসব বিষয়ে জানতে আওয়ার ইসলামের বার্তা সম্পাদক কাউসার লাবীব কথা বলেছেন মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম রহ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দেশের অন্যতম প্রাচীন মহিলা মাদরাসা রামপুরা জাতীয় মহিলা মাদরাসার পরিচালক মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ মোমতাজুল করীম (মুশতাক) এর সঙ্গে। পাঠকের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হচ্ছে:-

দেশে শিক্ষিত নারী জাতি গড়ে তোলার পেছনে কওমি মহিলা মাদ্রাসাগুলোর অবদান কতটুকু?

সমাজ ও দেশের উন্নতির জন্য নারী এবং পুরুষ উভয়কেই শিক্ষিত হয়ে কাজ করতে হয়। সে প্রত্যয়কে সামনে রেখেই দেশের অধিকাংশ মহিলা মাদ্রাসা কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের এই রামপুরা জাতীয় মহিলা মাদ্রাসা পীর সাহেব চরমোনাই রাহিমাহুল্লাহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি শিক্ষিত, সভ্য এবং দ্বীনদার মা জাতি গঠনের লক্ষ্যে। মহিলা মাদ্রাসাগুলোতে দরসে নেজামীর পাশাপাশি মেয়েদেরকে আমরা ক্লাস এইট পর্যন্ত বাংলা ইংরেজি অংক ভূগোল এবং অন্যান্য জেনারেল বিষয় পড়িয়ে থাকি। সাধারণত একজন মেয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি ক্লাস এইট পর্যন্ত যদি লেখাপড়া করে তাহলে সে কোথাও আর ঠেকবে না বলে আমি বিশ্বাস করি। আর দ্বীনী ও জেনারেল শিক্ষার অপূর্ব সমন্বয়ের ফলে আমাদের দেশের নারীদের বিরাট একটা অংশ মহিলা মাদ্রাসার অবদানে দেশের শিক্ষিত নাগরিকদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারছেন। পাশাপাশি নিজেদেরকে দীনী শিক্ষায়ও শিক্ষিত করে মুখলেস দ্বীনের খাদেম হতে পারছেন।

মহিলা মাদ্রাসা পরিচলনার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়?

আলহামদুলিল্লাহ আমরা সরকারিভাবে বা অন্যকোনোভাবে কখনো বাধার মুখোমুখি হইনি। যেহেতু এখানে নারীদেরকে দীন শেখানো হচ্ছে তাই এ বিষয়টিকে সবাই ভালোভাবে নেয়। সবার কাছ থেকে আমরা সার্বিক সহযোগিতা পেয়ে থাকি। তবে দেশে করোনাকালীন সময়ে কিছুটা সমস্যার মুখোমুখী হতে হয়েছিল যা দেশের প্রায় অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হয়েছিল। আমাদের কোনো আয় ছিল না। কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরকে ঠিকই মাসিক সম্মানী দিতে হয়েছে। কেননা তারা তো আমাদেরই স্টাফ। আসলে মাদরাসা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতি বছরই আমাদের কিছু আর্থিক লস থেকে যায়। কিন্তু আমরা সবসময় মাথায় রাখি যে, মরহুম পীর সাহেব চরমোনাই রাহিমাহুল্লাহ এই প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলেছিলেন, আদর্শ  ও দ্বীনদার মা জাতি গঠনের লক্ষে। এটি আমাদের কোনো ব্যবসা নয়। তাই আমরা একমাত্র দ্বীনের খেদমতের লক্ষে কাজ করে যাচ্ছি।

লেখাপড়ার সঠিক মান রক্ষার্থে দেশের কওমি মহিলা মাদ্রাসাগুলো কিভাবে এগোতে পারে বলে মনে করেন?

সাধারণত মহিলা মাদ্রাসাগুলোতে দেখা যায় অনভিজ্ঞ ও নবীনদেরকে দিয়ে বেশি পরিচালনা করা হয়। এর জন্য লেখাপড়ার মান অনেক ক্ষেত্রেই নিশ্চিত করা যায় না। যদি অভিজ্ঞ এবং প্রবীণ, পাশাপাশি যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা দ্বারা মহিলা মাদ্রাসা পরিচালনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে আমাদের মেয়েরা যেভাবে শিক্ষিত হয়ে উঠছে আরও ভালোভাবে তারা দ্বীনের খাদেম হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে পারবে। যেমনটি আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানে করে থাকি। আমরা এখানে তিন থেকে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতার কমে কোন শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ দেই না। দেশের প্রবীণ শিক্ষক-শিক্ষিকা দিয়ে আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের দরস নিয়ে থাকি। কিছু নবীন শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরকে রাখা হয় সহযোগী হিসেবে। উদ্দেশ্য হলো, তারা যেন নিজেদেরকে ধীরে ধীরে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।

মহিলা মাদ্রাসায় অনেক অমনোযোগী এবং মেধা দুর্বল ছাত্রী থেকে থাকে তাদেরকে নিয়ে আপনারা কিভাবে কাজ করে থাকেন?

আসলে মেধা আল্লাহ প্রদত্ত একটি বিষয়। আমাদের এখানে যারা দ্বীন শিখতে আসে তাদেরকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে দিন শেখায়। যদি কারো মেধা দুর্বল হয় তাদেরকে ভিন্নভাবে যত্নের সঙ্গে লেখাপড়া করানো হয়। তারপরও যদি দেখা যায় কারও মেধায় কুলোচ্ছে না। তখন আমরা তাকে দীনের ফরজিয়াতগুলো শেখানোর পেছনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিই। ফরজিয়াতে দীন শেখার পর তার গার্ডিয়ানকে ডেকে পরামর্শ দিয়ে থাকি, তাকে কারিগরি বিভিন্ন কিছু শেখানোর জন্য যেটি তার পরবর্তী জীবনে কাজে আসবে। সে যেহেতু ইসলাম মেনে চলার জন্য যতটুকু শিক্ষা প্রয়োজন ততটুকুই শিখে ফেলেছে তাই তার দুর্বল মেধার ওপর আমরা জুলুম করি না। অথবা যদি তার পড়ালেখার প্রতি বেশি আগ্রহ থাকে কিন্তু সে লেখাপড়া পারছে না, তখন আমাদের প্রতিষ্ঠানের সঠিক মান রক্ষার্থে আমরা তাকে ভিন্ন কোনো প্রতিষ্ঠানে ট্রান্সফার হওয়ার পরামর্শ দেই।

মহিলা মাদ্রাসাগুলোর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ এবং মানসম্মত খাবার-দাবারের গুরুত্ব কতটুকু?

নারীরা যেহেতু পুরুষদের মতো নয়। তারা কোমল ও সেনসেটিভ, তাই তাদের পরিবেশটা হতে হয় কোমল এবং সুন্দর স্বাস্থ্যসম্মত। না হয় তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, রুচিশীল মানসম্মত খাবার-দাবার মহিলা মাদ্রাসায় খুবই প্রয়োজন। যেমন সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের জন্য জেনারেটর, নিরাপদ পানির জন্য ফিল্টারিংয়ের ব্যবস্থা, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারদের পরামর্শ মেনে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের ব্যবস্থা, নিরাপদ শৌচাগার, পর্যাপ্ত আলো বাতাস সঞ্চালনের ব্যবস্থা, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য উন্নত ব্যবস্থা এবং রুচিশীল আবাসন ব্যবস্থা খুবই প্রয়োজন। আমাদের দেশের বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে এরকম ব্যবস্থা আছে।

কিন্তু ঢাকায় অবস্থিত অনেক মহিলা মাদ্রাসায় ছাত্রীদের স্বাস্থ্যসম্মত আবাসন ব্যবস্থা এবং রুচিশীল খাবারের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। এর বড় কারন হলো, মন চাইলেই ছোট্ট একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে তারা মাদ্রাসা করে ফেলছে। সেখানে লেখাপড়া এবং অন্যান্য কোনকিছুরই সঠিক পরিচর্যা করা হচ্ছে না। যার ফলে মহিলা মাদ্রাসা সম্পর্কে অনেকের মনে একটি বিকৃত ধারণা তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের বোর্ডগুলোকে আরো বেশি সজাগ ভূমিকা রাখতে হবে। বিশেষ করে বেফাক বোর্ডের অধীনে যেহেতু দেশের অধিকাংশ মহিলা মাদ্রাসা। তাই তাদেরকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। কোনো মাদরাসাকে বোর্ডের অন্তর্ভূক্ত করার আগে এর সার্বিক বিষয় যেমন, শরঈ পর্দা, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ আছে কী না? লেখাপড়ার মান তারা ঠিকভাবে ধরে রাখছে কীনা এসব বিষয় নিশ্চিত হতে হবে। তাছাড়া কোনো মাদরাসায় পরীক্ষার কেন্দ্র দেয়ার আগেও এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।

মেয়েদের জন্য লেখা পড়ার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আমল আখলাক ও তারবিয়াত। দেশের মহিলা মাদরাসাগুলো উন্নত তারবিয়াতের জন্য কীভাবে কাজ করছে?

মহিলারা অনেকে স্কুল কলেজে পড়ার কারণে তারা বেপর্দায় জীবন যাপন করে। আমল-আখলাক তেমন ভাল থাকে না। উৎশৃংখল একটি জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সেজন্য সচেতন অভিবাবকগণ মহিলা মাদ্রাসায় তাদের মেয়েদেরকে দিয়ে থাকে। তাদের ইচ্ছে মেয়েটি যেন একজন খোদাভীরু দীনের খাদেমা হওয়ার পাশাপাশি দেশের একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠে। তাই আমরা এই বিষয়ে কোনো ছাড় দিই না। দেশের প্রথিতযশা বুযুর্গদের মাধ্যমে সময়ে সময়ে নসিহত করা হয়ে থাকে। তাছাড়া প্রতিদিন সকাল বিকেল তিলাওয়াত, জিকির, তাসবিহ-তাহলীলের গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। তাদেরকে বুঝানো হয়, একজন শিক্ষিত দীনদার মা, একটি দীনদার জাতি গড়ে তুলতে পারে।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ