।।কাউসার লাবীব।।
নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া। তাই বাধ্য হয়ে রাজধানীতে অনেকেই টিসিবির লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। কিন্তু সেখানেও ভোগান্তির শেষ নেই। চাহিদা অনুযায়ী ট্রাক ও পণ্যের পরিমাণ কম হওয়ায় বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। অতিমাত্রায় ধাক্কাধাক্কি ও ঠেলাঠেলিতে কোথায় কোথায় মাথা ফেটে আহত হওয়ার খবরও শোনা যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতির জন্য কারা দায়ী? এর থেকে বেরিয়েই বা আসা যাবে কীভাবে? এই প্রশ্ন রেখেছিলাম গবেষক আলেম মুফতী আব্দুল মাজিদের কাছে।
তার মতে, টিসিবির পণ্য বিক্রির সময় যে অস্থির অবস্থা আমরা দেখতে পাচ্ছি এটি একটি সমাজের বড় ধরনের ঘাটতি ও শূন্যতার নিশ্চিত ফলাফল। আর সেই ঘাটতি ও শূন্যতাটা হচ্ছে, কোন সমাজ যদি ভোগবাদী মানসিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় তখন ওই সমাজে টিসিবির পণ্য বিক্রির রাস্তা খুলে।
ভোগবাদী মানসিকতাটা কোথা থেকে শুরু হয়? এ বিষয়ে তার মতামত হলো, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরে যখন সষ্ট্রার আলোচনা বাদ দিয়ে শুধু ভোগবাদী যোগ-বিয়োগ শেখানো হয়, তখন ওই সমাজের মাঝে ভোগবাদী চিন্তা-চেতনা বেড়ে ওঠে। ইসলাম বলেছে যদি কেউ তোমার কাছে পিড়িত হয়ে আসে তাহলে তাকে তুমি সদকা করো। আর ভোগবাদী সমাজব্যবস্থা বলছে তাকে তুমি সুদের উপরে ঋণ দাও। এই সুদী ঋণের কারণে একজনের অসহায়ত্ব আরেকজনের পকেট ভারী হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একজনের অসহায়ত্ব আরেকজনের মুখে হাসি ফুটছে। এই সুদের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের কলেজে-ইউনিভার্সিটির প্রতিটি পাতায় পাতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। যা ভোগবাদী মানসিকতা তৈরি করে একজন শিক্ষার্থীকে। এ ভোগবাদী মানসিকতা থেকে সে পরবর্তীতে পণ্য গুদামজাত করে। অসাধু উপায়ে এই গুদামজাত করার কারণে পরবর্তীতে এই টিসিবির পণ্য বিক্রি করতে হয়।
‘রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সমাজ ব্যবস্থাকে উল্টানোর জন্য একটি সুন্দর দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, গ্রহীতার হাত থেকে দাতার হাত উত্তম। তার মানে আল্লাহর রাসুল আমাদেরকে ত্যাগের মানসিকতা শিক্ষা দিয়েছেন ভোগের মানসিকতা নয়। ভোগের মানসিকতা পরিহার করতে বলেছেন।’ বলেন- মুফতী আব্দুল মাজিদ।
ইসলামের সোনালী ইতিহাস টেনে এই গবেষক আলেম বলেন, আমরা দেখেছি ইয়ারমুকের যুদ্ধে একজন সাহাবী পানির জন্য চিৎকার করতে ছিলেন। তাকে একজন পানি দিতে গিয়েছে তখন ওই তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি দেখল তার পাশের আরেকজন সাহাবী পানির জন্য চিৎকার করছেন। এই মুমূর্ষ অবস্থায় মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তিনি তাদের মন মানসিকতা নিয়ে বলেছেন যে আমাকে নয় আমার ভাইকে পানি পান করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই সমাজ ব্যবস্থায় আমরা দেখতে পাচ্ছি একজন সাহাবী নিজের মৃত্যুর মুখে পড়েও ত্যাগের মানসিকতা পরিহার করছেন না। কিন্তু পক্ষান্তরে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যে ধারা যুক্ত হয়েছে তার অবস্থা হলো এরকম, দেশের সব মানুষ অসহায় হয়ে পড়ুক। আর তারা এসে আমার কাছ থেকে সুদের উপরে ঋণ নিক।
‘টিসিবির পণ্য বিক্রিতে আমরা যে অবস্থার মুখোমুখি এখন হচ্ছি ধাক্কাধাক্কি ঠেলাঠেলি এবং মাথা ফাটাফাটির মতো ঘটনা ঘটছে এর পেছনে দায়ী হলো সমাজের অতি ভোগবাদী কিছু মানুষ। যাদের জন্য আজকে এতগুলো মানুষকে টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনতে হচ্ছে তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।’- বলেন, মুফতী আব্দুল মাজিদ।
টিসিবির পণ্য লাইনে দাঁড়িয়ে আমরা যারা ক্রয় করব তারা যদি ইয়ারমুকের যুদ্ধের সে শিক্ষাকে জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে পারি। আমার প্রয়োজনের চেয়ে আমার ভাইয়ের প্রয়োজনকে যদি প্রাধান্য দিতে পারি তাহলে এই অবস্থা হতো না। দ্বীনি চেতনা থেকে সমাজকে শূন্য করে দিয়ে পশ্চিমা চিন্তা-চেতনা আমাদের সমাজে প্রবেশের ফলাফল হচ্ছে সমাজের সব অনিয়ম। তাই পশ্চিমা ভোগবাদী সমাজব্যবস্থা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ সমাজ বিনির্মাণ করতে হবে। ত্যাগের মানসিকতা আমাদের জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
এদিকে আরেক গবেষক আলেম মুফতী শামসুদ্দোহা মনে করেন, ক্রেতা বিক্রেতা উভয় একে অপরের জন্য সহায়ক। তাই তাদের মাঝে সম্পর্কটাও হতে হবে সৌহার্দ্যপূর্ণ। ক্রেতাকে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, বিক্রেতা যদি আমাকে এই পণ্যটি কেনার সুযোগ করে না দিতো তাহলে আমাকে এটি পেতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হত। আবার বিক্রেতাকেও এটি ভাবতে হবে যে ক্রেতা যদি আমার কাছ থেকে পণ্যটি না কিনতো তাহলে আমার রুটি রুজির এই মাধ্যমটি আশঙ্কায় পড়তো। তাই উভয়পক্ষেরই কৃতজ্ঞতা পূর্ণ আচরণ করতে হবে।
‘আর সরকারের পক্ষ থেকে যদি জনগণের চাহিদা অনুযায়ী টিসিবির ট্রাকের পরিমাণ আরো বাড়ানো হয় তাহলে ক্রেতাদের মধ্যে আরও স্বস্তি ফিরবে বলে আশা করছি। কেননা এখন দেখা যাচ্ছে অনেক বড় এরিয়া জুড়ে মাত্র একটি ট্রাক। হাজার হাজার মানুষ সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে আছে।’ উল্লেখ করে মুফতী শামসুদ্দোহা।
অপরদিকে ‘যারা লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নেয় তাদের ও যারা অসাধু উপায়ে খাবার গুদামজাত করে তাদের উভয়কেই পশ্চিমা ভোগবাদী চিন্তা-চেতনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে’ বলে জানান মুফতি আব্দুল মাজিদ।
-কেএল