মুফতি আতাউল করীম মাকসুদ।।
তখন তার বয়স ১১বছর। পাখি শিকার করা ছিল প্রিয় অভ্যাস; বলা যায় পাগলপারা ছিলেন পাখি শিকার করার জন্য। শর্টগান নিয়ে ঘুরতেন দেওবন্দের ওলি-গলিতে। মুহাদ্দিসে মসজিদে নববি, ইংরেজ খেদাও আন্দোলনের বিজয়ী সিপাহসালার, শায়খুল ইসলাম সাইয়্যিদ হুসাইন আহমাদ মাদানি রাহি. তার মুহতারাম পিতা। তিনি জানতেন প্রিয় আরশাদের অভ্যাস। বারণ করতেন না।
একদিনের কথা, আসর নামাজ পড়ে শায়খুল ইসলাম মাদানি রাহ. দেওবন্দের ছাত্তা মসজিদ থেকে বের হয়েছেন। সাথে ইমামুল আউলিয়া হজরত আবদুল রহিম রায়পুরি রাহ.। রায়পুরি রাহ. হলেন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের পুরোধা হজরতজ্বি ইলিয়াস রাহ.-মহান শায়খ ও মুরশিদ। উভয় যাবেন মাকবারায়ে কাসেমিতে। সামনে শিশু আরশাদ। বয়স তার ৬ অথবা ৭বছর। হজরত রায়পুরি রাহ. খুব স্থিরচিত্ত্বে চলছেন, চলার গতি মন্থর। হজরত মাদানি রাহ. অভিযোগের সুরে বললেন, ‘হজরত জলদি চলিয়ে! দ্রুত চলুন। হজরত রায়পুরি রাহ. বললেন, ‘কেয়সে চলে, কুতবুল ইরশাদ তো মেরে সামনে সে চাল রাহা হ্যায়’। মানে, ‘দ্রুত আসবো কীভাবে, কুতবুল ইরশাদ [শিশু আরশাদ মাদানি] আমার সামনে সামনে চলছেন, তাকে ওভারটেক করবো কীভাবে?’
বুঝতেই পারছেন, কেমন স্নিগ্ধ ও শোভিত ছিল তাঁর শৈশব। বিশ্বখ্যাত বুজুর্গ হজরত রায়পুরি তার শৈশবেই টের পেয়েছেন, ছোট্র আরশাদ একসময় বিশ্ব মুসলিমের প্রাণ পুরুষ, ইমামে রব্বানিতে পরিণত হবেন। পৃথিবী দেখেছে, এখনো দেখেছ, হজরত রায়পুরির ভবিষ্যত বাণী কীভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। তরতর করে এগিয়ে গেছেন জীবন-সফরে। পদে পদে সফলতা।
দারুল উলুম দেওবন্দের ইতিহাসে তার মত সফল নাজিমে তালিমাত দ্বিতীয়জন পাওয়া যাবে না হয়তো। এখন তিনি উম্মুল মাদারিস আল জামিআতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম দেওবন্দের সদরুল মুদাররিসিন ও সিনিয়র মুহাদ্দিস। সফলতা এখানেও তার অনুসারী। আল্লামা বদর উদ্দিন আইনি রাহ. রচিত তাহাবি শরিফের বিখ্যাত শরাহ ‘নুখাবুল আফকার’ তার তা'লিক ও তাখরিজে ১৬ খন্ডে ছেপে এসেছে আরো এক যুগ আগে। ইলমে হাদিসে তার ‘মাহারাতের’ জ্বলন্ত প্রমাণ এ-কিতাব। ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র ভরসাস্থল জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের তিনি প্রেসিডেন্ট।
উসুল ও নীতির আলোকে, স্বজনপ্রীতি উর্ধ্বে উঠে, সফলভাবে সংগঠন পরিচালনা করায় ইতিহাসে তার নজির পাওয়া বিরল। তাসাওফ ও ইরশাদে বর্তমান দুনিয়ায় তার কোনো জুড়ি নেই। পৃথিবীর উদয়াচল থেকে অস্থাচলে আরশাদ মাদানির ফুয়ুজ ও বারাকাত ছড়িয়ে পড়েছে। আমেরিকার উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্তে, আফ্রিকার দুর্গম এলাকায়ও তিনি সফর করেছেন, উম্মতে মুসলিমাকে দিয়েছেন পথের দিশা।
দারুল উলুম দেওবন্দের প্রাণপুরুষ ও প্রধান অভিভাবক এখন আমাদের আরশাদ মাদানি দা.বা.। তিরমিজি শরিফের প্রাণবন্ত দরস প্রদান করছেন গত দুই যুগ থেকে। তালিবে ইলমরা স্বতস্ফুর্ত তার দরসে শরিক হয়ে থাকেন। মসনদে হাদিসে যখন তিনি ‘জালওয়া আফরোজ’ হন, আওলাদে রাসুলের সুরভিত ও স্নিগ্ধ সুবাসে পুরো দরসেগাহ মোহিত হয় তখন।
একজন আওলাদে রাসুল, মানে, আমাদের পিয়ারা হাবিব হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রক্ত ধারণকারী সুসৌভাগ্যের অধিকারী তিনি।
সবুজ বাংলায়ও তিনি ‘কভি কভহার’ মসনদে হাদিসে সুরভি ছড়ান। নামাজের সুরতে বসে এক-নাগাড়ে কয়েক ঘন্টা হাদিসের দরস প্রদানের সৌরভ ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি অনেকবার। বিনয় ও তাওয়াজু এর অনুপম দৃষ্টান্ত এটি।
কর্মমূখর ও কর্মচঞ্চল হজরত আরশাদ মুদ্দাজিল্লুহু বর্ণাঢ্য জীবনে এখন বার্ধক্যে পৌঁছে গেছেন। শারিরিক দুর্বলতা চেপে বসেছে তাঁর উপর। লাঠি হাতে এতদিন স্বভাবজাত চলতেন তিনি। তার হাঁটার ভঙ্গিমা এত সুন্দর ও সাবলীল যে, ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। কিন্তু এখন তো হুইল চেয়ারে চলতে হয় তাকে। বিশ্বাস করুন, আমার জন্য এ দৃশ্য অবলোকন করা বড় কষ্টকর। তীর হয়ে বিধতে থাকে অন্তরে। চোখের সামনে প্রিয় হজরত হুইল চেয়ারে চলার মত দুর্বল হয়ে পড়েছেন, দিল গ্রহণ করে না, করতে চায় না।
ইদানিং বিভিন্ন বয়ানে-আলোচনায় বিদায়ের প্রতিও ইঙ্গিত করেন তিনি। সেদিন বললেন, ৮২/৮৩ বছরে আমাদের খান্দানের বড়রা পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। হজরতের বয়স এখন ৮৩। ইয়া আল্লাহ!!!
আল্লাহ, আমাদের আকুতি, করজোড় মিনতি মাওলা, আমাদের মুখলিস ও মুশফিক রাহবার হজরত মাদানিকে সুদীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন। কর্মমূখর নেক জীবন দান করুন।
এনটি