চলছে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের ৪৫ তম কেন্দ্রীয় পরীক্ষা। গত ৯ মার্চ থেকে শুরু হওয়া পরীক্ষা শেষ হবে আগামী ১৬ মার্চ। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে হঠাৎ শিক্ষার্থীদের মাঝে পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ছাত্রদের কিছু অংশের মতে পরীক্ষার প্রশ্ন কঠিন হয়েছে। তবে অনেকেই এ ধরনের দাবি মানার পক্ষে কোনো যৌক্তিকতা দেখেন না বলে মতামত দিয়েছেন। তাদের মতে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার প্রতি একাগ্রতা ও মনোযোগী হওয়া একান্ত কর্তব্য। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থীরা কিতাবমুখী হয়ে উঠলে প্রশ্নপত্র নিয়ে এ ধরনের কোন দাবি থাকবে না।
বেফাকের প্রশ্নপত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের আলোচনার প্রেক্ষিতে রাজধানীর অন্যতম ইলমী বিদ্যাপীঠ জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়ার (যাত্রাবাড়ী বড় মাদরাসা ) মুহাদ্দিস ও শিক্ষাবিদ মাওলানা হেমায়েত উদ্দিনের মুখোমুখি হয়েছে আওয়ার ইসলাম। শিক্ষার্থীদের একটি অংশের দাবি, আলোচনা, প্রতিক্রিয়া, মিশ্র প্রতিক্রিয়া, শিক্ষাবোর্ড বেফাকের দায়িত্ববোধ, আকাবির আসলাফের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন তিনি আওয়ার ইসলামের সঙ্গে। এই শিক্ষাবিদের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় সঙ্গে ছিলেন প্রতিবেদক নুরুদ্দীন তাসলিম।
পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে হঠাৎ বেফাকের প্রশ্নপত্র কঠিন হয়েছে বলে একটা কথা শোনা যাচ্ছে- একে আসলে প্রশ্নপত্র কঠিন বলা চলে নাকি শিক্ষার্থীদের কিতাবের সাথে মুনাসাবাত কমে যাওয়া বলা যায়?
মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন: প্রশ্ন কিতাবের মধ্য থেকে হয়ে থাকলে একে কঠিন বলা ঠিক হবে না। প্রশ্ন কিতাবের মধ্য থেকে করার পর কোন শিক্ষার্থীর কাছে তা কঠিন মনে হলে বলতে হবে, সে হয়তো কিতাব বুঝেনি অথবা ঠিকমত পড়াশোনা করেনি। নিজের না পড়া, না বুঝাকে কঠিন সাব্যস্ত করে এর থেকে দায়মুক্তি কোনভাবেই ঠিক হবে না।
বেফাকের সাথে সম্পর্ক রাখেন এমন লোকদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তারা জানিয়েছেন বর্তমানে শিক্ষার্থীরা গাইডমুখী হয়ে পড়েছে, তাই শিক্ষার্থীদের গাইড নির্ভরতা ঠেকানোর চেষ্টা করছে বেফাক। এরই প্রেক্ষিতে ইতিপূর্বে গাইডগুলোতে যেসব প্রশ্ন ধারণ করা হয়েছে তার বাইরে প্রশ্ন করার চেষ্টা করছে শিক্ষা বোর্ড।
বেফাকের পক্ষ থেকে এটি একটি যথার্থ ও সাধুবাদ পাওয়ার মতো পদক্ষেপ। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা যেভাবে গাইডমুখী হয়ে পড়ছে তাদেরকে গাইড থেকে ফেরানো না গেলে আগামী দিনগুলোতে যোগ্যতাসম্পন্ন আলেম পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার তাফসীর বিভাগের প্রধান হিসেবে ভর্তি পরীক্ষাগুলো আমিই নেই সবসময়। নির্দিষ্ট কোন কিতাবের বাইরে যে কোন কিতাব থেকে আমি শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা নেই। এক্ষেত্রে আরবী ইবারত সহিহভাবে পড়তে পারে এবং মোটামুটি তরজমা করতে পারে-এতোটুকু যোগ্যতা থাকলে আমি শিক্ষার্থীদের তাফসীর বিভাগের জন্য যোগ্য মনে করি এবং ভর্তি নেই।
পরীক্ষা নিতে গিয়ে আমি দেখেছি; বেফাকে ভালো রেজাল্ট করেছে এমন অনেক শিক্ষার্থীও এবারত তরজমা পড়তে পারে না। তখন আমি তাদের জিজ্ঞেস করি, এত ভালো রেজাল্ট কিভাবে করলে? ব্যাপার কি? তখন তারা স্বীকার করে নেয় যে তারা গাইড দেখে পড়াশোনা করেছে।
এভাবে গাইড পড়ে শিক্ষার্থীরা গাইড নির্ভর হয়ে গেলে কিতাবের সাথে তাদের সম্পর্ক থাকবে না। সামনে কোনো যোগ্য আলেম তৈরি হবে না।
আমি বেফাকের মহাপরিচালক, সর্বোচ্চ মুরুব্বির সাথে আলোচনা করেছি যে শিক্ষার্থীদের গাইড বিমুখ করার চেষ্টা করুন।
আমি প্রস্তাব করেছি প্রত্যেকটা কিতাবে একটা প্রশ্ন থাকবে যেখানে ইবারতে হরকত লাগাতে হবে। সম্ভব হলে দু-একটা কিতাব মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করা। ফেল, ফায়েল, মাফউল, মুযাফ, মুযাফ ইলাই,- মোটা মোটা- তারকীব, তাহকীকগুলো জিজ্ঞেস করা। জটিল তারকীব জিজ্ঞেস না করা; এতে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও হয়তোবা আটকে যেতে পারে।
যখন ছাত্ররা দেখবে যে, একটা প্রশ্নের পুরো উত্তর দিতে না পারলে তারা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে পারছে না, তখন তারা বাধ্য হয়ে পুরো কিতাব হল করবে। এবং কিতাব বুঝার চেষ্টা করবে। আমি বারবার এই প্রস্তাবগুলো দিয়ে এসেছি। এছাড়া আমাদের ছাত্রদের যোগ্য করে তোলার আর কোন উপায় নেই।
শিক্ষার্থীদের একটা অংশের দাবি অনুযায়ী যদি ধরে নেওয়া হয় যে প্রশ্ন কঠিন হয়েছে- তাহলে কি বলা যায় আমাদের মুরব্বিরা গাইড নির্ভর গড়াশোনার কারণে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত ও যোগ্যতা নিয়ে যেই আশংকা করে আসছিলেন এতোদিন সে শঙ্কা এবার প্রকটভাবে সামনে এলো ?
মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন: যদি বাস্তবে প্রশ্ন কঠিন হয়ে থাকে তাহলে বেফাক কর্তৃপক্ষ অবশ্যই বিষয়টি নিয়ে ভাববেন। তবে আমি বেফাক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে যতোটুকু জেনেছি তারা কঠিন প্রশ্ন করার পক্ষে থাকেন না। মোটামুটি ধরনের প্রশ্ন করার চেষ্টা করেন যাতে শিক্ষার্থীরা সহজেই ভালো ফলাফল করতে পারেন।
শিক্ষার্থীদের গাইডের প্রতি আসক্তি কি শুরু থেকেই ঠেকানো যেত?
মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন: শিক্ষার্থীদের গাইডের প্রতি আসক্তি এক দিনে গড়ে উঠেনি। প্রথমে কোন এক প্রকাশনী গাইড করেছে, আস্তে আস্তে কেউ সে দিকে ঝুঁকেছে এরপর আরো অনেকেরই আসক্তি বেড়েছে গাইডের প্রতি। আবার গাইড নির্ভর ব্যবসা শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নতুন নতুন গাইড ছেপেছে।
মূল কথা হল,যখন প্রশ্নগুলো এমন হবে যে গাইড থেকে সেগুলো হল করা সম্ভব নয় তখন শিক্ষার্থীরা নিজেরাই আস্তে আস্তে গাইড নির্ভরতা কমিয়ে দিবে।
শিক্ষার্থীদের গাইড নির্ভরতা এক দিনে গড়ে উঠেনি, তাই ওটা একদিনেই বন্ধ করা সম্ভব নয়, আস্তে আস্তে শিক্ষার্থীদের এ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
গাইড নির্ভর পড়াশোনা ঠেকাতে বোর্ড বড় ভূমিকা রাখতে পারে নাকি মাদ্রাসাগুলো ব্যক্তিগতভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন: অনেক মাদ্রাসা তো ছেলেদের গাইড-এর প্রতি উৎসাহিত করে এমনটাও আমি জানি। কারণ তাদের কাছে পড়াশোনা ভালো হওয়ার থেকে মাদ্রাসার রেজাল্ট ভালো করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভালো রেজাল্ট-এর মাধ্যমে মাদ্রাসার সুনাম হল কিনা সেটা মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় অনেকের কাছে।
এজন্য মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের গাইড নির্ভরতা ঠেকাতে পারবে বলে মনে হয় না। তারা সরাসরি কিতাব বোঝা ও বিভিন্ন আরবি শরাহ মুতালার জন্য উৎসাহ দিতে পারবেন। এছাড়া শিক্ষার্থীরা যখন দেখবে যে গাইড পড়ে ভালো নম্বর করা যায় তখন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ঠেকাতে পারবে না। তাই শিক্ষার্থীদের গাইড থেকে ফিরে আনতে বেফাকের ভূমিকা নিতে হবে।
শিক্ষার্থীদের গাইড নির্ভরতা বন্ধে বোর্ড আসলে ঠিক কোন ধরনের পন্থা অবলম্বন করতে পারে?- এ বিষয়ে আপনার কোন পরামর্শ আছে কি?
মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন: প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আমি বিষয়টা স্পষ্ট করেছি। প্রশ্ন এমনভাবে করতে হবে যে প্রত্যেক কিতাবে এমন একটা প্রশ্ন থাকবে যেখানে বাধ্যতামূলকভাবে এবারত লাগাতে হবে। মোটা মোটা তারকিবগুলো থাকতে হবে প্রশ্নে। যখন প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভেতরে বিষয়টি ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে যে তারা মূল কিতাব হল না করলে ভালো নম্বর করতে পারবে না। তখন ছেলেরা মূল কিতাব বোঝার প্রতি উদ্বুদ্ধ হবে এবং গাইড নির্ভরতা ছাড়তে বাধ্য হবে।
-এটি