মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন।।
বুদ্ধিজীবীদের কাছে আর একটি কথা যা নিবেদন করতে চাই। আপনারা ভেবে দেখবেন, মানুষের ভাল-মন্দ বোধ বা যুক্তির উপর কতটা নির্ভর করা যায়। যেটা ভাল ও যুক্তিযুক্ত সেটাই গ্রহণ করা চাই- এটা অনস্বীকার্য। কিন্তু মানুষ যেটাকেই ভাল ও যুক্তিযুক্ত মনে করে প্রকৃতপক্ষেই সেটা ভাল ও যুক্তিযুক্ত কি না তা অবশ্যই বিচার্য। এমনও দেখা যায় মানুষ একসময় যেটাকে ভাল ও যুক্তিযুক্ত ভেবে গ্রহণ করে, পরবর্তী কোনসময় আবার সেটাই তাদের কাছে খারাপ ও অযৌক্তিক প্রতিপন্ন হওয়ায় সেটাকে বর্জন করে।
একসময় তাদের কাছে যেটা পছন্দনীয় বোধ হয়, আরেক সময় সেটাই কদর্য বোধ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর ইতিহাসে মানব রচিত বহু মতবাদ একসময় সমাদরে গৃহীত হয়েছে তো পরবর্তী একসময় সেগুলো ঘৃণাভরে বর্জিত হয়েছে। কম্যুনিজম সোশ্যালিজমসহ মানবরচিত আরও বহু মতবাদ তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
পোশাকের কাটছাট, শিল্প, ডিজাইন ইত্যাদির ক্ষেত্রেও একসময় যেটা পছন্দনীয় লাগে, আকর্ষণীয় বিবেচিত হয়, আরেক সময় সেটাই অপছন্দনীয় লাগে, কদর্য বিবেচিত হয়। বোঝা গেল মানুষের ভাল-মন্দ বিবেচনা বোধের, মানুষের যৌক্তিকতা ও পছন্দ-অপছন্দ বোধের সঠিক হওয়ার কোন গ্যারান্টি নেই। মানুষের ভাল-মন্দ বিবেচনা বোধের, মানুষের যৌক্তিকতা ও পছন্দ-অপছন্দ বোধের কোন স্টান্ডার্ড রূপ নেই, কোন শাশ্বত রূপ নেই।
পক্ষান্তরে ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত ধর্ম হওয়ায় এর সবকিছুই নিশ্চিত সঠিক, নিশ্চিত সুন্দর ও চির গ্যারান্টিযুক্ত। আবার ইসলাম ধর্ম শাশ্বত ধর্ম হওয়ায় এর সবকিছু চির স্টান্ডার্ডও বটে। অতএব নিশ্চিত সঠিক, নিশ্চিত সুন্দর, চির গ্যারান্টিযুক্ত, চির স্টান্ডার্ড ও শাশ্বত ধর্মের কোন বিধান কোন যুগে বা কারও কাছে মন্দ বা অযৌক্তিক কিংবা অপছন্দনীয় বোধ হলে সেই মন্দবোধ বা অযৌক্তিকতা বোধ কিংবা সেই অপছন্দবোধকে আমলে নেয়া যায় না।
আগের পর্বটি পড়ুন: মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন
কারণ এখন যেটাকে খারাপ বা অযৌক্তিক ভাবা হচ্ছে দু'দিন পরেই হয়তো দেখা যাবে সেই ভাবনা ভুল ছিল। ইসলাম ধর্মের কোন বিষয়ে বিরূপ ধারণা পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হয়েছে তার দৃষ্টান্ত তো অনেক। এই ধরুন আমলের কোন দেহ নেই, আমল ধরা-ছোয়া যায় না- এই যুক্তিতে এক সময় অনেকে পরকালে আমলের ওজন হওয়ার বিষয়কে অস্বীকার করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে আলো, তাপ, বায়ু প্রভৃতি ধরা-ছোয়া যায় না গোছের জিনিসের ওজন বা মাপ হতে পারার বাস্তবতা সামনে এসে যাওয়ায় আমলের ওজন না হতে পারার ইসলাম বিরোধী ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
এর বিপরীত কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত অকাট্য কোনো তথ্য আজ পর্যন্ত অকাট্যভাবে কেউ ভুল প্রমাণিত করে দেখাতে পারেনি। আর কোনোদিন পারবেনও না। কারণ কুরআনের কথা হচ্ছে চূড়ান্ত সত্য কথা। আর চূড়ান্ত সত্য কোনোদিন মিথ্যা প্রমাণিত হয় না, হতে পারে না। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা বলে দিয়েছেন, إِنَّهُ لَقَوْلٌ فَصْلٌ.وَمَا هُوَ بِالْهَزْلِ.
অর্থাৎ, অবশ্যই এ কুরআন হচ্ছে চূড়ান্ত সত্য কথা। এটা তামাশা নয়। (সূরা ত্বারিক: ১৩-১৪)
যুগে যুগে সময়ে সময়ে যখন মানুষের যুক্তি বুদ্ধি বেঠিক প্রমাণিত হচ্ছে, তখন মানুষের যুক্তি ভাবনার, মানুষের বোধ-বুদ্ধির কী আস্থাযোগ্যতা রয়েছে? কোনোই আস্থাযোগ্যতা নেই। মানুষের যুক্তি ভাবনার, মানুষের বোধ-বুদ্ধির কোন আস্থাযযোগ্যতা নেই- এটা বোঝানোর জন্যই কুরআনে কারীমে জেহাদের বিধান বর্ণনা করার পর ইরশাদ হয়েছে, عَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ ۖ وَعَسَىٰ أَن تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ ۗ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ.
অর্থাৎ, হতে পারে কোনকিছুকে তোমরা খারাপ মনে করবে অথচ সেটা তোমাদের জন্য ভাল। আবার হতে পারে কোনকিছুকে তোমরা ভাল মনে করবে অথচ সেটা তোমাদের জন্য মন্দ। বস্তুত (কোনটি প্রকৃতপক্ষে ভাল বা কোনটা প্রকৃতপক্ষে মন্দ তা নিশ্চিতভাবে) আল্লাহ জানেন তোমরা জান না। (সূরা বাকারা: ২১৬)
আগের পর্বটি পড়ুন: মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন
আর এরূপ নিশ্চিত জানা থেকেই আল্লাহ তাআলা ধর্মের যাবতীয় বিধান প্রদান করেছেন। সুতরাং আল্লাহ তাআলা যেটিকে ভাল ভেবেছেন এবং সে মোতাবেক তা করার বিধান দিয়েছেন সেটিই সুনিশ্চিত ভাল। পক্ষান্তরে তিনি যেটাকে মন্দ ভেবেছেন এবং সে মোতাবেক তা বর্জনের বিধান দিয়েছেন সেটাই সুনিশ্চিত মন্দ।
আবার এভাবেও বলা যায়- মানুষ নিজের থেকে যেটা ভাল ভেবে গ্রহণ করে সেটা ভাল কি না তা সন্দেহপূর্ণ, পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআলা যেটা গ্রহণ করতে বলেছেন তা সুনিশ্চিত ভাল হওয়ায় সন্দেহমুক্ত। আর যুক্তি ও বুদ্ধি সন্দেহপূর্ণ জিনিস ছেড়ে নিশ্চিতটাই ধরতে বলে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ইরশাদ করেছেন, دَع ما يَرِيبُك إلى ما لا يَرٍيبُك. أخرجه الترمذي في سننه وقال : حديث صحيح.
অর্থাৎ, তোমার কাছে যেটা সন্দেহপূর্ণ লাগে সেটা ছেড়ে দাও, যেটি নিশ্চিত বোধ হয় সেটি গ্রহণ কর। (তিরমিযী: ২৫১৮) Leave what feels Uncertain, accept what feels Certain.
এমন যেন না হয় আমরা নিজেদের যুক্তিতে ভাল ভেবে খারাপটাকেই গ্রহণ করে নিলাম। ভাবলাম ভালই করছি অথচ প্রকৃতপক্ষে করছি খারাপ। এতে আমাদেরই জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আমাদের কর্ম পণ্ড হয়ে যাবে। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا . الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا.
অর্থাৎ, হে নবী! তুমি বল, আমি কি তোমাদেরকে ঐসব লোকের কথা বলব যারা কর্মে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ? তারা হল এমন লোক যাদের পার্থিব জীবনে কৃত চেষ্টা-চরিত্র পণ্ড হয়ে যায় অথচ তারা মনে করে তারা ভাল কর্মই করছে। (সূরা কাহফ: ১০৩-১০৪)
অতএব বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন- কুরআন ও হাদীছের উপরোক্ত কথাগুলো চিন্তায় রেখে মানুষের ভাল-মন্দ বোধ বা যুক্তির উপর কতটা নির্ভর করা যায় তা একটু ভালভাবে ভেবে দেখুন এবং পুন:সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করুন নিজেদের ভাল-মন্দ বোধ বা যুক্তির উপর নির্ভর করে কুরআন হাদীছের কথা প্রত্যাখ্যান করা ঠিক হবে কি না।
-এএ