।।মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন।।
বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ নয়, বাহাছ-বিতর্ক নয়, তাদের নিয়ে টিকা-টিপ্পনি কাটা নয়, বরং তারা যেন শুধু একটু চিন্তা করে দেখেন এ উদ্দেশ্যে তাদের কাছে কিছু কথা নিবেদন করব। পর্যায়ক্রমে কয়েক সংখ্যায় নিবেদনগুলো পেশ করব। আশা করি বুদ্ধিজীবীগণ পাঠ করে দেখবেন।
যে বুদ্ধিজীবীগণ আল্লাহ আল্লাহর রসূলে বিশ্বাস রাখেন তথা মুমিন মুসলমান তাদের উদ্দেশ্যেই আমার নিবেদন। পক্ষান্তরে যে বুদ্ধিজীবীগণ অমুসলিম বা কাফের -যারা ইসলামে বিশ্বাস করেন না বা আদৌ আল্লাহ রসূলেই বিশ্বাস করেন না- তাদের উদ্দেশে পরবর্তীতে ভিন্নভাবে কিছু নিবেদন করার ইচ্ছা রয়েছে। এখন শুধু মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশেই কিছু কথা নিবেদন করছি।
'বুদ্ধিজীবী' বলতে আমি সমাজে বিশেষভাবে এই নামে পরিচিতদেরকেই বুঝাচ্ছি না। বরং সেই সকল কবি, সাহিত্যিক, লেখক, গবেষক, বিজ্ঞানী ও শিক্ষিত সুধী জনদের বুঝাচ্ছি যারা ইসলামের কথা তথা কুরআন হাদীছের কথা শুধু সেগুলোই মানেন যেগুলো তাদের মনপুত হয় বা তাদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়। পক্ষান্তরে যেগুলো তাদের মনপুত না হয় সেগুলোকে তারা তাদের মত করে যুক্তি দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেন।
মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশে যাকিছু নিবেদন করব তা আমার নিজস্ব যুক্তি বা নিজস্ব পাণ্ডিত্য থেকে নয়। কারণ কোন বুদ্ধিজীবী যুক্তি ও পাণ্ডিত্যে নিজেকে অন্য যে কারও চেয়ে ঊর্ধতন ভাবতেই পারেন। আমি যা কিছু নিবেদন করব তা হয় আল্লাহর কথা কিংবা আল্লাহর রসূলের কথা।
আর নিশ্চয়ই কোন মুসলমান -তা তিনি যতবড় জ্ঞানী বা বুদ্ধিমানই হোন না কেন- নিজেকে যুক্তি ও পাণ্ডিত্যে আল্লাহর চেয়ে ঊর্ধতন ভাববেন না সেটাই স্বাভাবিক। কেউ তেমনটা ভাবলে সেটা তার জ্ঞান-বুদ্ধির ত্রুটি জ্ঞাপন করবে। নি:সন্দেহে আল্লাহর জ্ঞান সকলের চেয়ে বেশি। Undoubtedly, the knowledge of Allah is greater than all.
আর কুরআনের ভাষ্যমতে আল্লাহর রসূল নিজের খেয়াল-খুশি থেকে কিছুই বলেন না, যাকিছু বলেন, তা আল্লাহরই প্রত্যাদেশ। (সূরা নাজ্ম: 3-4) সেমতে আল্লাহর রসূলের কথাও আল্লাহরই কথা। তাই কোন মুসলমান আল্লাহর রসূলের চেয়েও নিজেকে জ্ঞানে ঊর্ধতন ভাববেন না সেটাই স্বাভাবিক। কেউ তেমনটা ভাবলে সেটা রসূলের কথার পজিশন সম্বন্ধে তার অবগতির ত্রুটি জ্ঞাপন করবে।
যাহোক আল্লাহ ও আল্লাহর রসূলের কিছু কথা আমি মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কাছে পেশ করতে চাই। আমার নিজের থেকে শুধু এতটুকু কথাই থাকবে যা আল্লাহ আল্লাহর রসূলের কথাকে স্পষ্ট করার জন্য নিতান্তই না বললে নয়। সেই সাথে প্রতিটি বিষয়ের ভূমিকা স্বরূপ কিছু কথা।
বুদ্ধিজীবীদের কাছে আমি যে কথাগুলো নিবেদন করব তার মধ্য থেকে সর্বপ্রথম যেটি পেশ করতে চাই তা হল-
আল্লাহর বিধানের বিপরীতে যুক্তি প্রয়োগ প্রসঙ্গ
বুদ্ধিজীবীদের অনেকে কুরআন হাদীছের অনেক কথা গ্রহণ করেন না শুধু এ কারণে যে, সেগুলো তাদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। অর্থাৎ, তারা যুক্তি দিয়ে কুরআন হাদীছের গ্রহণযোগ্যতা নির্ণয় করতে চান। তাই বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন- কুরআন হাদীছের বিপরীতে নিজেদের যুক্তি প্রয়োগের বিষয়ে একটু ভেবে দেখবেন।
কেননা কুরআনের কোন বক্তব্যের বিপরীতে নিজের যুক্তি প্রয়োগ করার অর্থ হচ্ছে আমি আল্লাহর চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখি, আমি আল্লাহর চেয়ে বেশি বুঝি। কিন্তু আদৌ কি আল্লাহর চেয়ে কারও জ্ঞান বেশি হতে পারে? আল্লাহর জ্ঞান তো অসীম। পক্ষান্তরে মানুষের জ্ঞান নিতান্তই সসীম ও সামান্য। সে হিসেবে আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় মানুষের জ্ঞান তো নেই পর্যায়ের। সেমতে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে,
والله يعلم وانتم لا تعلمون.
অর্থাৎ, আল্লাহ জ্ঞান রাখেন তোমরা জ্ঞান রাখো না। (সূরা আলে ইমরান: 66)
আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় মানুষের জ্ঞান যে কতো কম তার একটি উদাহরণ: বোখারী শরীফে বর্ণিত হযরত মূসা আ. ও খিযির আ.-এর ঘটনা সম্পর্কিত একটি দীর্ঘ রেওয়ায়েতের একাংশে আছে- হযরত মূসা আ. ও খিযির আ. একটা নৌকায় ছিলেন। ইত্যবসরে একটি ছোট্ট পাখি নৌকার গলুইতে এসে বসল। পাখিটি সমুদ্র থেকে তার ঠোটে একটু পানি তুলে নিল।
তখন হযরত খিযির আ. হযরত মূসা আ. কে বললেন,
ما نقص علمي وعلمك من علم الله تعالى إلا كنقرة هذه العصفور في البحر.
অর্থাৎ, হে মূসা! এই সমুদ্রের বিশাল জলরাশির তুলনায় পাখিটির ঠোটে তুলে নেয়া জল যতো কম তোমার আমার জ্ঞানও আল্লাহ তাআলার জ্ঞানের তুলনায় ওরকম কম। (বোখারী: হাদীছ নং 121)
বস্তুত আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় মানুষের জ্ঞান কিছুই না। আল্লাহ তার জ্ঞানের যতটুকু মানুষকে জানিয়েছেন তা ছাড়া মানুষ তাঁর জ্ঞানের কিছুই আয়ত্ব করতে সক্ষম নয়। কুরআনে কারীমে আয়াতুল কুরছিতে বলা হয়েছে,
ولا يحيطون بشيء من علمه الا بما شاء.
অর্থাৎ, তারা তার জ্ঞানের কিছুই আয়ত্ব করতে পারে না যতটুকু তিনি চান তা ছাড়া। (সূরা বাকারা: 255)
অতএব মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন কুরআন ও হাদীছের কোন কথা আপনাদের সামনে এলে তার বিরুদ্ধে আপনারা যুক্তি দিতে পারেন কি না তা একটু ভেবে দেখবেন।
-কেএল