আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: ইসলামি ঐতিহ্যের কথা বলে বাঁশখালীর বখশি হামিদ জামে মসজিদ, প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়, আরব সাগর পাড়ি দিয়ে মোগল আমলে ধর্মপ্রচারকগণ এসেছেন এদেশে ইসলামের শাশ্বত বাণী প্রচারের লক্ষ্যে। চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলে তারা প্রথমে বসতি স্থাপন করেন।
সে জন্য এসব এলাকায় রয়েছে বহু প্রাচীন মসজিদ, মাদরাসা ও বুজুর্গের কবর। বাঁশখালীর মধ্য ইলশা বখশি হামিদ জামে মসজিদও তেমনি একটি ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। মসজিদটি নির্মিত হয়েছে ইট, পাথর ও সুরকি ব্যবহার করে। ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফলক হিসাবে সমাদৃত।
ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশে তৎকালীন সময়ে এই মসজিদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মুসলিম শিক্ষা-সংস্কৃতির ভিত রচনা করে এ মসজিদ। মসজিদে রক্ষিত ফলকে আরবিতে লেখা আছে ‘বনাল মাসজিদুল মোকারেম ফি আহমিদ-মূলক, ইসনাদুল মিল্লাত ওয়াদ্দিন সুলতানুল মুয়াজ্জাম সুলাইমান (কররানি) সালামালাহু আনিল ওয়াফাত ওয়াল বলিয়্যাতি মুরেখাত তিসযু রমজান, খামছুন ও সাবয়িনা ওয়া তিসআতু মিআত হিজরি আলাইহিস সালাম।’
অর্থাৎ মসজিদ নির্মিত হয়েছে সেই বাদশাহর যুগে যাকে উপাধি দেওয়া হয়েছে দ্বীন এবং মিল্লাতের সুলতানুল মুয়াজ্জম তথা মহান সম্রাট। আর তিনি হলেন সুলাইমান কররানি (আল্লাহ তাকে বিপদাপদ থেকে মুক্ত রাখুন) তারিখ: ৯৭৫ হিজরির ৯ রমজান। যার ইংরেজি সন ১৫৬৮ সালের ৯ মার্চের সাথে মিলে যায়।
খোদাইকৃত শিলালিপি মতে, এটি সুলাইমান কররানি কর্তৃক প্রতিষ্ঠা করার কথা থাকলেও লোকমুখে বখশি হামিদের নির্মিত মসজিদ বলে পরিচিত।
স্থানীয় মুরব্বিরা বলেন, বখশি হামিদের পুরো নাম মুহাম্মদ আবদুল হামিদ, বখশি তার উপাধি। বখশি ফার্সি শব্দ। এর অর্থ কালেক্টর বা করগ্রহীতা।
তৎকালীন সময়ে বখশি হামিদ এতদাঞ্চলের কালেক্টর তথা প্রশাসক ছিলেন। তিনি এলাকার শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছেন।
জনশ্রুতি আছে, তৎকালীন সময়ে এ এলাকায় প্যারাবন ছিল। ঝোঁপঝাড়ে জনবসতি ছিল না। ইউসুফ ও কুতুব নামে গৌড়ের দু’জন আমির শাহ আবদুল করিম নামক জনৈক সুফির সঙ্গে উপযুক্ত বাসস্থানের সন্ধানে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে বাঁশখালীর এ জায়গায় অবতরণ করেন।
তারা উপকরণ নিয়ে বাঁশখালীর ইলশার দরগাহ বাড়ির স্থানে পৌঁছালে শাহ সাহেব ‘ইল্লাল্লাহ’ শব্দ উচ্চারণ করে তার ছড়ি পুঁতে রাখেন এবং সেখানে বসবাসের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তখন থেকেই স্থানটি ইল্লাল্লাহ শাহের স্থান এবং পরে ইলশায় রূপান্তরিত হয়। বখশি আবদুল হামিদ ওই শাহ্ শাহের অধস্তন বংশধর।
কেউ কেউ মনে করেন, গৌড় থেকে আগত সুফি-দরবেশের মধ্যে একজন ছিলেন সুলাইমান। তিনি নেতৃস্থানীয় সাধক ছিলেন। জ্ঞানে-গুণে অসাধারণ বিচক্ষণ ও প্রভাবশালী ছিলেন।
তাকে সুলতান বলে ডাকতো। তিনি এ মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন এবং পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের পর মুরব্বির প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে একমাত্র কন্যাকে উপজেলার জলদী গ্রামে বিয়ে দেন। তার ছিল দুই ভাই। ওলি বুজুর্গের আবাদকৃত এ গ্রামে বহু দ্বীনদার পীর-মাশায়েখের আবির্ভাব হয়েছিল। তন্মধ্যে শাহ চান মোল্লা অন্যতম। তিনি এ মসজিদ নির্মাণের সমসাময়িক যুগের বলে অনেকের ধারণা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৫ সালে এটি প্রটেক্টেড মনুমেন্ট এন্ড মৌন্ডস ইন বাংলাদেশ-এর তালিকায় স্থান পাওয়ায় কিছু সংস্কার হয়েছে। মোঘল স্থাপত্য কৌশলে নির্মিত এ মসজিদ তিন গম্বুজবিশিষ্ট, মাঝেরটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং ছোট গম্বুজ দুটি ধনুকের মতো করে ছাদের সঙ্গে যুক্ত।
মসজিদের পূর্ব পাশে প্রাচীনকালের শান বাঁধানো একটি সুবিশাল পুকুর রয়েছে। পুকুরে মাছচাষ করা হয় এবং পানি ব্যবহার করে মুসল্লিরা অজু করে। মসজিদের পশ্চিমে কবরস্থান, পূর্বে উত্তরে গড়ে উঠেছে সুবিশাল মাদরাসা ও এতিমখানাসহ ইসলামি কমপ্লেক্স। এ কমপ্লেক্সের নাম রাখা হয় ‘দারুল কোরআন মুহাম্মদিয়া শাহ আব্দুল হামিদ মাদ্রাসা ও এতিমখানা।’ সাথে গড়ে উঠেছে শাহ্ মজিদিয়া আদর্শ দাখিল মাদরাসা।
শিক্ষাবঞ্চিত জনপদে বখশি হামিদ জামে মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো উপকূলে আলো ছড়াচ্ছে। রাতে গুনগুন করে হেফজখানায় কোরআনের তেলাওয়াত, দিনভর মাদরাসা মাতিয়ে রাখে শিক্ষার্থীরা।
বখশি হামিদ (রহ.)-এর দ্বীন প্রচার ও প্রসারের যে স্বপ্ন দেখেছেন তা আরও পরিপূর্ণতা পেয়েছে মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে। এখানে রয়েছে মনকাড়া দৃশ্যের মসজিদ, মসজিদের বিশাল পুকুর ও সজ্জিত পুকুরঘাট। পাশে পুরো বটবৃক্ষসমেত বখশি হামিদের কবর।
ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা সমাবেত হয়। বর্তমানে মসজিদটি খুব সুন্দর করে নতুন সাজে সজ্জিত করে গড়ে তুলেছেন মসজিদ পরিচালনার পর্ষদ।
তবে ঐতিহাসিক এ স্থাপনায় প্রবেশের রাস্তাটি খুবই সংকীর্ণ। যার দরুণ বহিরাগতদের যাতায়াতে অসুবিধা হয়। যাতায়াতের এ সড়কটির আস্তর উঠে গিয়ে এখন খানাখন্দে রূপ নিয়েছে। সাধারণ যানবাহন তো দূরের কথা, স্বাভাবিকভাবে লোকজনের হাঁটা-চলাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। বড় কোনো গাড়ি এখানে প্রবেশ করতে পারে না।
যেভাবে যাবেন চট্টগ্রাম শহরের বহদ্দারহাট টার্মিনাল থেকে সোজা আনোয়ারা-বাঁশখালী আঞ্চলিক সড়কে (বাঁশখালী স্পেশাল সার্ভিস, সুপার সার্ভিস, সিনেমা প্যালেস থেকে এস আলম সার্ভিস, সানলাইন সার্ভিস) বাসে করে গুনাগরী খাসমহাল বাজারে নামতে হবে। বাজার থেকে সোজা পশ্চিমে ইলশা মোশাররফ আলী সড়ক হয়ে সিএনজিযোগে যাওয়া যায় এ মসজিদে। ঢাকা থেকে আসতে চাইলে সৌদিয়া সার্ভিসে করে সোজা গুনাগারি স্টেশনে নেমে যাওয়া যায়।
-এটি