আবদুল্লাহ আল ফারুক।।
তখন মালিবাগ জামিয়ার মুহতামিম ছিলেন কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ.। আসরের পর প্রায়শই মাদরাসার অফিসে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা আসতেন। বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা বলতেন।
তিনি প্রায় সময় বলতেন, ‘হুজুর, আপনারা কেন জন্মনিয়ন্ত্রণের ওপর বেশি বেশি আলোচনা করেন না? বই লেখেন না? নিজেরাও জন্মনিয়ন্ত্রণ করেন না? অল্প সন্তান নেবেন, আর তাদেরকে উচ্চশিক্ষিত করে মানুষের মতো মানুষ বানাবেন।’
কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ. কখনো তার উত্তর দিতেন, আবারও কখনো চুপচাপ হাসিমুখে এড়িয়ে যেতেন।
এভাবে অনেক বছর কেটে যায়। সরকারি কর্মকর্তা চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। ছেলে মস্ত বড় কেউকেটা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। বড় অংকের মাইনে পায়। সে হিসেবে লোকটির মহাসুখী হওয়ারই কথা।
একদিনের ঘটনা।
তিনি যথারীতি আসর নামাযের পর অফিসকক্ষে এলেন। বললেন, ‘হুজুর, আজ আপনার সঙ্গে আমি নিভৃতে কিছু কথা বলতে চাই।’
কাজি সাহেব রহ. অন্যদের চলে যেতে বললেন। অফিসকক্ষে তারা দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই। অফিসার লোকটি কাজি সাহেব রহ. এর হাত ধরে ঝরঝর কাঁদতে শুরু করলেন। শিশুর মতো হাউ মাউ করে কাঁদছেন। কিছুক্ষণ পর তিনি খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘হুজুর, জীবনের এ পর্যায়ে এসে আজ আমার অনেক বড় ভুল ভেঙেছে। আপনার অসংখ্য যুক্তি যা আমাকে শেখাতে পারেনি, পড়ন্ত জীবন আমাকে তা নির্মমভাবে শিখিয়ে দিয়েছে।’
কাজি সাহেব রহ. বললেন, ‘বিষয়টি খুলে বলুন।’
তিনি বললেন, ‘হুজুর, আমার একটা মাত্র ছেলে। ছেলেটাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছি। উচ্চশিক্ষিত করেছি। এখন সে বউ-বাচ্চা নিয়ে বাইরে থাকে। ঘরে আমি একা। ছেলের মা দু বছর আগে মারা গেছে। ব্যস্ততার কারণে ছেলে তার মায়ের জানাযাতেও আসতে পারেনি। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে আমি ভীষণ নিঃসঙ্গ। সম্পত্তির পাহাড় নিয়েও আমি নিঃস্ব। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার যদি আরো দু’-তিনটি সন্তান থাকতো তাহলে আমি অন্তত তাদের একজনের পরিবারের সঙ্গে থেকে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে পারতাম। আমার বস্তুবাদি চিন্তার ভুল আজ আমাকে তিলে তিলে ধ্বংস করছে। আমি এখন কীভাবে আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করব?’
.
আজ থেকে তেরো বছর আগে মালিবাগ মাদরাসার এক শিক্ষকের কাছে ঘটনাটি শুনেছি। নায়ক রিয়াজের শ্বশুর মুহসিন সাহেবের গতকালের করুণ আত্মহত্যার কারণে সেই শ্রুত ঘটনা আজ আবার মনে পড়লো।
আমাদের সমাজে এমন শত শত মুহসিন সাহেব রয়েছেন। কেউ নিঃসঙ্গ বার্ধক্যের কষাঘাতে তিলে তিলে মারা যাচ্ছেন। কেউ সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন।
তারপরও কি আমরা সচেতন হব না?
বস্তুবাদী চিন্তা হয়তো আমাকে-আপনাকে অঢেল বিত্ত দেবে; কিন্তু কখনই আপনার মনে সুখ-শান্তি এনে দেবে না। মনের সুখ আর বিবেকের খোরাক পেতে হলে আপনাকে অবশ্যই আল্লাহর বিধানের কাছে নিঃশর্ত সমর্পণ করতে হবে।
আরো পড়ুন: নুরানী মাদরাসাগুলো আমাদের গৌরব
এনটি