শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :

কওমি মাদরাসার দায়িত্বশীলদের প্রতি মুফতি তাকি উসমানির খোলা চিঠি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

২০২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া পাকিস্তানের সভাপতি নির্বাচিত হন শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকি উসমানি। দায়িত্ব গ্রহণের পর  উলামায়ে কেরামের প্রতি এক খোলা চিঠি পাঠিয়েছেলেন তিনি। যেখানে শিক্ষকদের বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন তিনি। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া পাকিস্তানের পক্ষ থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে শাইখুল ইসলামের সেই দিকনির্দেশনামূলক চিঠিটি। আওয়ার ইসলামের পাঠকদের জন্য এর অনুবাদ তুলে ধরেছেন ইবনে নাজ্জার


সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ তায়ালার। দুরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর।  বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া পাকিস্তানের একজন সেবক হিসেবে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি আমি।

আল্লাহ তাআলা আপনাদের নিজ নিজ মাদ্রাসায় ইসলাম ও ইসলামি শিক্ষার সেবক হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। শত প্রতিকুলতার মাঝেও আপনারা যেভাবে নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের সাথে দায়িত্ব পালন করছেন, তা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। তবে ইলমে নববীর পাহারাদার হিসেবে আপনাদের কিছু কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।

এক. মাদ্রাসায় শিক্ষকতা সওয়াবের কাজের পাশাপাশি অনেক বড় দায়িত্বও বটে। এই পথে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তবে এই সমস্যার সমাধানে মাধ্যম গ্রহণ করা যতটুকু জরুরি, তার চেয়ে বেশি জরুরি আল্লাহ তাআলার শরণাপন্ন হওয়া।

দুই. শিক্ষকদের উচিৎ, মাদ্রাসার নির্ধারিত কার্যক্রমের পাশাপাশি ছাত্রদের এ বিষয়টা ভালোভাবে বুঝানো যে, ইলমে দ্বীন বা ইসলামি শিক্ষা কখনো অন্যের কতৃত্ব বরদাশত ও সহ্য করে না। তাই ইলমে দ্বীন অর্জনে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিতে হবে ইলমের কাছে। যাতে ছাত্ররা নিয়মিত পাঠ গ্রহণ, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি ও স্বতন্ত্র অধ্যয়নের প্রতি মনোযোগ দেয়। সর্বদা ক্লাসে মনোযোগ সহকারে পাঠ গ্রহণ ও বুঝার প্রতি গুরুত্ব দেয়। কোনো একটা বিষয় বুঝে না আসা পর্যন্ত অস্থিরতা ভোগতে থাকে। অপ্রয়োজনীয় সাক্ষাৎ, আড্ডার আসর, মোবাইলের মতো আত্মঘাতী বিষ থেকে বাঁচার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। শিক্ষকরাও মূলত ছাত্র, কেননা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণের সময়। তাই তারাও এগুলো মেনে চলা দরকার।

তিন. শিক্ষকদের উচিৎ; ছাত্রদের নিজের সন্তান মনে করা ও ভালোবেসে নিঃস্বার্থে শিক্ষা-দীক্ষা প্রদান করা।

প্রতিদিনই পাঠদানের পূর্বে ঐ বিষয় এবং ঐ শাস্ত্র সম্পর্কে গভীরভাবে অধ্যয়ন কর। যদি কোনো বিষয় বুঝে না আসে অথবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো সংশয় বা আপত্তি সৃষ্টি হয়, তাহলে লজ্জা না করে অবিলম্বে অন্য শিক্ষকের দারস্থ হওয়া। পাঠদানের পূর্বে এমনভাবে প্রস্তুতি নেওয়া যে, নির্ধারিত পাঠের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা চোখের সামনে ভাসতে থাকে।

ছাত্রদের স্মৃতিশক্তি ও যোগ্যতা অনুযায়ী কতটুকু পড়ালে এবং কীভাবে পড়ালে তারা গ্রহণ করতে পারবে, সে বিষয়েও ভেবে দেখা। কঠিন বিষয়গুলো যথাসম্ভব সহজ করে পড়ানো। পড়ানোর পর কয়েকজনকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে নিশ্চিত হওয়া যে, তারা পরিপূর্ণ বুঝতে পেরেছে কি না। নিজের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে ঐ শাস্ত্রের বিভিন্ন গ্রন্থ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ অধ্যয়ন করা, চাই তা প্রতিদিনের পাঠদানে প্রয়োজন পড়ুক বা না পড়ুক।

চার. শিক্ষদের উচিৎ, ছাত্রদের আরবি ব্যাকরণ পড়ানোর চেয়ে সেগুলোর অনুশীলন ও ব্যবহারের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া। কিতাব পড়ার সময়ই ছাত্রদের ভুল ধরিয়ে দেওয়া এবং তাদেরকেই সেগুলো ব্যাকরণের আলোকে শুদ্ধ করতে বলা।

পাঁচ. শিক্ষকদের উচিৎ, ছাত্রদেরকে আরবি টীকা ও আরবি ব্যাখ্যাগ্রন্থ থেকে সহায়তা নেওয়ার অভ্যস্ত করে তোলা। তাদের সামনে উর্দু (অর্থাৎ অনারবি ভাষার) টীকা ও ব্যাখ্যাগ্রন্থকে এভাবে উপস্থাপন করা যে, তারা এগুলো পড়া তো দূরে থাক হাত লাগানোকেও খারাপ মনে করে। বর্তমানে উর্দু (অর্থাৎ অনারবি ভাষার) ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলো ছাত্রদের মূল গ্রন্থ পড়ার যোগ্যতা নষ্ট করে দিচ্ছে। তাই মূল আরবি গ্রন্থ পড়ার অভ্যস্ত করে তোলা।

ছয়. পাঠদানের পাশাপাশি ছাত্রদের ধার্মিকতা ও নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া নিজেদের জন্য ফরজ মনে করা। সকল ছাত্রকে প্রত্যহ তাকবিরে উলার সাথে জামাতে নামাজ পড়ার প্রতি গুরুত্ব বোঝানো। অবহেলা করলে, বোঝানোর চেষ্টা করা ও উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া।

সাত. ছাত্রদের উঠা-বসা, চলা-ফেরা, খাওয়া-দাওয়া সর্বদায় কোনো না কোনো জিকিরে অভ্যস্ত করে তোলা দরকার। এর জন্য পরিচালক ও শিক্ষকবৃন্দ নিজেরা জিকিরে অভ্যস্ত হয়ে, তাদের সামনে দৃষ্টান্ত পেশ করা। বিশেষ করে তৃতীয় কালিমা ও দুরুদ শরীফ বেশি বেশি পাঠ করা।

আট. বর্তমানে আমাদের শিক্ষা-দীক্ষার মূল উৎস হলো আকাবিরে দেওবন্দের শিক্ষা-দীক্ষা, দিকনির্দেশনা ও উত্তম চরিত্রের গুণাবলি। এর মাধ্যমে ছাত্রদের মাঝে আত্মশুদ্ধির আগ্রহ, স্পৃহা তৈরি হয়। তাই সব মাদ্রাসায় প্রতিদিন কমপক্ষে দশ মিনিটের জন্য হলেও নির্ধারিত একটা সময় একত্রিত হয়ে আকাবিরে দেওবন্দের জীবনী, বয়ান ও উপদেশের কিতাব সমূহ থেকে কিছু কিছু পড়ে শোনানোর ব্যবস্থা করা দরকার। বিশেষ করে নিম্নোক্ত কিতাবগুলো:-

✓ আপবীতি, লেখক: শাইখুল হাদিস মাওলানা মুহাম্মাদ জাকারিয়া কান্ধলবি রহ.।
✓ হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসিম নানুতবি রহ.-এর জীবনী, লেখক: মাওলানা মুহাম্মাদ মুনাযির আহসান গিলানি রহ.।
✓ কুতুবে আলম মাওলানা রশিদ আহমাদ গঙ্গুহি রহ.-এর জীবনী, লেখক: মাওলানা মুহাম্মাদ আশিক ইলাহি মিরাঠি রহ.।
✓ শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান রহ.-এর জীবনী, লেখক: মাওলানা সাইয়্যিদ আসগর হুসাইন রহ.।
✓ হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলি থানবি রহ.-এর জীবনী, লেখক: খাজা আজীজুল হাসান মাজযুব রহ.।
✓ মাওলানা খলিল আহমাদ সাহারানপুরি রহ.-এর জীবনী, লেখক: মাওলানা আশিক ইলাহি মিরাঠি রহ.।
✓ নকশে হায়াত, লেখক: শাইখুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানি রহ.।
✓ শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানি রহ.-এর জীবনী, লেখক: মাওলানা আব্দুশ শাকুর তিরমিযি রহ.।
✓ তাজাল্লিয়াতে উসমানি, লেখক: মাওলানা আনোয়ারুল হাসান শেরকুটি রহ.।
✓ মাজালিসে হাকিমুল উম্মত, লেখক: মুফতি শফি রহ.।

এছাড়াও খুতুবাতে হাকিমুল ইসলাম এর মতো আকাবিরে দেওবন্দের বিভিন্ন খুতুবাত বিস্তারিত হওয়ার কারণে পুরোটা আয়ত্ত করা যদিও কষ্টসাধ্য। তবুও কোনো শিক্ষক সেখান থেকে আত্মশুদ্ধিমূলক আলোচনাগুলো বাছাই করে ছাত্রদের সামনে বয়ান করবে।আর পুরোটা নিজে নিজে অধ্যয়নের জন্য ছাত্রদের উৎসাহ দেওয়া। সাথে সাথে ছাত্রদের সুবিধার জন্য পাঠাগারে উপরোক্ত প্রত্যেকটি বইয়ের একাধিক কপির ব্যবস্থা রাখা।

নয়. মাদ্রাসায় সুন্নাতের অনুসরণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। ইবাদতের সুন্নাতের সাথে সাথে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, উত্তম চরিত্র, ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করা, নম্রতা, সহনশীলতা, অমুখাপেক্ষিতা-স্বনির্ভরতা, সহমর্মিতা ও কল্যাণ কামনার মতো উৎকৃষ্ট মানের সুন্নাত ছাত্রদের মাথায় গেঁথে দেওয়া। এসব বিষয়ে তদারকি করা আর অবহেলা করলে হুঁশিয়ারি দেওয়া।

দশ. সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন দ্বীন ও সুন্নাতের মৌলিক চাহিদা। তাই সর্বদা ছাত্রদের এলোমেলো, বিশৃঙ্খলা থেকে বাঁচানো প্রয়োজন। নামাজের কাতার ছাড়াও সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানোর অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার।

এগারো. ইসলামি সম্পর্ক, বন্ধন ও সামাজিকতার এক গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হলো, নিজের কথা ও হাতের মাধ্যমে অন্যকে কষ্ট না দেওয়া। এই মূলনীতিটা তাদের স্বভাব ও চরিত্রে পরিণত করার আপ্রাণ চেষ্টা করা। এর বিরোধিতা করলেই, সহ্য না করে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া।

বারো. আউলিয়া কেরাম ও বুজুর্গদের সংস্পর্শ এবং ভালোবাসা ছাত্রদের অন্তরে ঢুকিয়ে দেওয়া। সাথে সাথে একথা তাদের মাথায় গেঁথে দেওয়া দরকার যে, বুজুর্গদের সংস্পর্শ ছাড়া বেশিরভাগ মানুষ পাক্কা সাচ্চা মুসলমান হতে পারে না।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তার পূর্ণ সন্তুষ্টি অর্জনে রজন্য এই দায়িত্ব পালনের তাওফিক দান করুন।

সূত্র: মাসিক পত্রিকা 'বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া পাকিস্তান'

এনটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ