মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন।।
"দ্বীনী ইলম অর্জন অনলাইনে নয় অফলাইনেই শ্রেয়"- এ শিরোনামে পূর্বে আমি একটা আর্টিকেল লিখেছি এবং অনলাইনে তা প্রচার করেছি। তাতে কিছুটা বিশদভাবে উল্লেখ করেছি অনলাইনে দ্বীনী ইলম তথা ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করাতে কত ধরনের সমস্যা রয়েছে। সেসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে অনলাইনেও দ্বীনী ইলম অর্জন করা যেতে পারে। তবে তার জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট যাচাই-বাছাই ও সতর্কতার। কিন্তু সে রকম যাচাই-বাছাইয়ের যোগ্যতা অনেকের মধ্যেই অনুপস্থিত। আবার সতর্কতার অভাবও রয়েছে অনেকের। ফলে যাচাই-বাছাই ছাড়া সতর্কতহীনভাবে অবাধে নেট থেকে সব ধরনের দ্বীনী কথা গ্রহণ অনেকের জন্য বিভ্রান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, হেদায়েতের পরিবর্তে গোমরাহির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে বিষয়টা লক্ষ করছি। অনেকটা অসহায়ের মত বিষয়টা লক্ষ করছি। অসহায়ের মত এজন্য যে, নেটে যারা বলেন লেখেন তাদের মধ্যে প্রচুর এমন লোক রয়েছেন যারা প্রকৃতপক্ষে বলার বা লেখার যোগ্য নন। কিন্তু তারা বলে যাচ্ছেন লিখে যাচ্ছেন। তাদেরকে আঁটকে রাখা যাচ্ছে না। অফলাইনে অযোগ্যরা প্রতিষ্ঠা পায় না। তারা অফলাইনে বক্তব্য দিয়ে ময়দানে স্বীকৃতি না পেয়ে অনুৎসাহিত হয়। তাদের লেখাও সমাজ তেমন খায় না, ফলে তারা সে লাইন থেকেও পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু অনলাইনে যোগ্যতার দরকার হয় না। এখানে মোবাইল বা কম্পিউটার টিপে কিছু লিখে ছেড়ে দিলেই হয়। ঘরে বসে অডিও ভিডিও তৈরি করে ছেড়ে দিলেই হয়। তারপর ফ্রেন্ড ফলোয়ারদের দিয়ে শেয়ার করিয়ে কিংবা কিছু পয়সা খরচ করে বুস্ট করে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া যায়।
আর এভাবে ব্যাপক পরিচিতিও ঘটে যায়। এভাবে অনেকে সেলিব্রেটিও হয়ে যায়। বিশেষত উপস্থাপন একটু সুন্দর হলে, কথার ফাঁকে ফাঁকে দু' চারটে ইংরেজি বাক্য ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা বলতে পারলে তো খুব দ্রুতই সেলিব্রেটি হয়ে যায়। তখন তাদের কথা গুরুত্ব পেতে শুরু করে। এভাবে গুরুত্বহীনরাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন তাদের কথা -যা তাহকীকী নয় তাও- তাহকীকী কথার মর্যাদা পেয়ে বসে। আর এভাবে দ্বীনী ইলমের অঙ্গনে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। এগুলো আমরা বন্ধ করতে পারছি না, কোনোভাবেই এ অঙ্গনে কাউকে লাগাম দিয়ে টেনে রাখা যাচ্ছে না। তাই অসহায়ের মত এসব তৎপরতা আর তার ফলে সৃষ্ট বহু মানুষের বিভ্রান্ত হওয়া শুধু লক্ষ করে যাচ্ছি আর পেরেশান হচ্ছি।
বস্তুত নেটে দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর তাল-বেতালের অডিও, ভিডিও, আর্টিকেল ও পোস্ট রয়েছে। ঈমান আকীদা, ইসলামী চিন্তাধারা, সুন্নাত বেদআত, মাসআলা-মাসায়েল যাবতীয় বিষয়ে তাল-বেতালের বক্তব্য রয়েছে। একটা জিনিসকে তের জন চৌদ্দ রকমের করে বুঝাচ্ছেন। বাতিল-ভণ্ডের অভাব নেই, তারা একেকজন একেক রকম ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছে। একটা সুস্পষ্ট না-হক জিনিসকেও অনেকে হক করে দেখানোর চেষ্টা করছেন। একটা পোস্টে নানান তালের কমেন্ট আসছে। এমনকি একজন গণ্যমান্য বিজ্ঞ আলেমের একটা কথা নিয়েও অযোগ্যদের পক্ষ থেকে নানান রকম ট্রল হচ্ছে। এখান থেকে এক কুঁচো চিংড়ি লাফ দিয়ে উঠছে, ওখান থেকে এক পুঁটিমাছ লাফ দিয়ে উঠছে, সেখান থেকে এক টাকিমাছ লাফ দিয়ে উঠছে! নানান তালের অপরিপক্ক ও ভুলভাল মন্তব্য আসছে।
কে কী বুঝাতে চায়, কার কী মতলব তা-ও অনেক সময় ঠাহর করা মুশকিল হচ্ছে। রীতিমত মাথা খারাপ করার অবস্থা। দিশেহারা হওয়ার অবস্থা। এতকিছুর মধ্য থেকে কোনটা প্রকৃতপক্ষে সঠিক তা বাছাই করে বের করা মজবুত আলেম ছাড়া অন্যদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অথচ নেটে বিচরণকারীদের মধ্যে সাধারণ মানুষের তথা গর-আলেমদের সংখ্যাই বেশি। তারা এসব নানামুখী কথার মধ্য থেকে যার যেটা ভাল মনে হচ্ছে সেটা গ্রহণ করছে, যদিও সেটা প্রকৃতপক্ষে ভাল নয়, সঠিক নয়। এসব কিছুর প্রেক্ষিতে নেট থেকে দ্বীনী ইলম শিখতে আগ্রহী সাধারণ লোকদের উদ্দেশে বলতে হচ্ছে, সাবধান থাকবেন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে অবাধে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ আপনাদেরকে যেন গোমরাহ করে না দেয়। নিজেদের দ্বীন রক্ষার স্বার্থে সাবধান থাকবেন, নতুবা আপনাদের দ্বীন বরবাদ হয়ে যেতে পারে। কেবল তাদের থেকেই দ্বীনের শিক্ষা গ্রহণ করুন যারা নিশ্চিত হকপন্থী।
এ ছাড়া অন্যদের থেকে কিছু গ্রহণের বেলায় যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করুন। এরূপ না করলে সোশ্যাল মিডিয়া দ্বারা গোমরাহ হওয়া মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। আল্লাহ সকলকে হেফাজত করেন।
পরিশেষে একটা পরামর্শ- যেসব সাধারণ মানুষ নেট থেকে দ্বীন শিখতে চান তারা বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার স্বার্থে অন্তত
একটা কাজ অবশ্যই করুন। তা হল- একজন বিচক্ষণ পরহেযগার হক্কানী আলেমকে নিজের দ্বীনী মুরব্বী মেনে নিয়ে তার দিক-নির্দেশনা মোতাবেক দ্বীনী সবকিছু সম্পন্ন করুন। যে কোনো বিতর্কিত বিষয় বা ঝামেলাপূর্ণ বিষয় সামনে এলে কোনটা গ্রহণীয় তার থেকে দিক-নির্দশনা গ্রহণ করুন। তবে এই মুরব্বী নির্বাচনের বিষয়টা সম্পন্ন হওয়া চাই অত্যন্ত যাচাই-বাছাই পূর্বক ও সতর্কতার সঙ্গে। এমন যেন না হয় ভূত তাড়াতে যে সরিষা নিলেন তাতেই ভূত রয়ে গেল। খাঁটি মুরব্বী নির্বাচনের প্রয়োজনে ইস্তেখারাও করে নেয়া যেতে পারে। সেই সাথে হেদায়েত পাওয়া ও হেদায়েতের উপর অবিচল থাকতে পারার জন্য সর্বদা আল্লাহর কাছে দুআ করা চাই। যেমন এইসব দুআ করা যেতে পারে-
اِهْدِنَا الصِّراطَ الْمُسْتَقِيْمَ.
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ اِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً اِنَّكَ اَنْتَ الْوَهَّابُ.
يَا مُقَلِّبَ القُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلَى دِينِكَ.
হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে সব রকম গোমরাহী থেকে রক্ষা করো। আমাদেরকে সচেতনতা দান করো, বিচক্ষণতা দান করো। সিরাতে মুস্তাকীমে অটল থাকার তাওফীক দান করো। আমীন !
এনটি