নুরুদ্দীন তাসলিম।।
প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে ‘দ্বিধাহীন কাছে আসার গল্প’ নামে প্রচারণা চালাতে দেখা যায় বহুজাতিক ইউনিলিভার কোম্পানির টুথপেস্ট ব্র্যান্ড ক্লোজআপ-এর পক্ষ থেকে।
এই প্রচারণার মূলে থাকে তরুণ-তরুণীদের মাঝে অবৈধ ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান। প্রায় ১০ বছর আগে শুরু হওয়া এ প্রচারণা নিয়ে প্রথম থেকে আপত্তি ছিল সচেতন মহলে। প্রতি বছর যখনই ক্লোজআপ-এর পক্ষ থেকে ‘দ্বিধাহীন কাছে আসার গল্প’ নিয়ে প্রচারণা শুরু হতো ঠিক তখনই দেখা যেত এ নিয়ে সচেতন মহল থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ।
ক্লোজআপ-এর প্রচারণা নিয়ে সচেতন মহলে ব্যাপক ক্ষোভ
২০২২- এ অবৈধ ভালবাসার প্রতি আহবানের প্রচারণা চালাতে গিয়ে ক্লোজআপ যে পথে এগিয়েছে দেশের সচেতন সমাজের ক্ষোভকে তা যেন কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
এবার ‘দ্বিধাহীন কাছে আসার গল্পে’র প্রচারণা চালাতে গিয়ে ক্লোজআপের পক্ষ থেকে যে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে তাতে দেখা গেছে; হিজাব পরিহিতা একজন মুসলিম নারী ও গলায় ক্রুশ পরা এক খ্রিস্টান পুরুষ একে অপরকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এবং ২৫ সেকেন্ডের একটি টিভিসি প্রকাশ করা হয়েছে...
জানুয়ারির শুরুতে প্রকাশিত ক্লোজআপের এই বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে পড়তেই দেশের সচেতন মুসলিম সমাজ এ নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং প্রতিবাদ চালিয়ে গেছেন। প্রতিবাদের এক পর্যায়ে অনেকেই ক্লোজআপের পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন।
‘ক্লোজআপের প্রকাশিত বিজ্ঞাপনটি শুধু মুসলিম নয় অন্য যে কোন ধর্মের মানুষকেই ক্ষেপিয়ে তুলবে যদি তিনি আদর্শ ধার্মিক হয়ে থাকেন’- এমন মন্তব্যও করেছেন অনেকে।
দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ-এর প্রেক্ষিতে তিনদিনের মধ্যে এই বিজ্ঞাপন সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয় সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ হুজ্জাতুল ইসলাম খানের পক্ষে অ্যাডভোকেট এস এম আরিফ মন্ডল এ নোটিশ দেন। তিন দিনের মধ্যে ব্যবস্থা না নেয়া হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে মর্মে হুঁশিয়ারি দেয়া হয় নোটিশে।
‘ক্লোজআপের এবারের প্রচারণা অতীত থেকে আরও ভয়ঙ্কর’
ক্লোজআপের এমন প্রচারণার বিষয়ে লেখক ও গবেষক শরীফ মুহাম্মদ বলেছেন, ‘ক্লোজআপ অতীতেও অশ্লীল সংস্কৃতির সমর্থক এবং ইসলামের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে কাজ করেছে। বর্তমানে প্রেম ভালোবাসার নামে তরুণ-তরুণীদের মাঝে যে অশ্লীলতার চর্চা শুরু করেছে ক্লোজআপ তা আরও একধাপ অগ্রসর ও ভয়ঙ্কর’।
তিনি বলেন, ‘ একে সামাজিক লজ্জা, সংকোচ ও নৈতিক মূল্যবোধ ধ্বসিয়ে দেওয়ার আয়োজন বলা চলে’।
‘ক্লোজআপের আয়োজনে দু'ধরনের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন’
লেখক শরীফ মুহাম্মদ বলেন, ‘ক্লোজআপ এবার যে আয়োজন করেছে এতে আমি দু'ধরনের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন দেখছি। একটা হল; দেশ হিসেবে বাংলাদেশে তরুণ তরুণীদের মাঝে সম্পর্ক স্থাপনকে লজ্জা, দ্বিধা ও ভয়ের চোখে দেখা হতো,- যা আসলে প্রশংসনীয়- তারা এই প্রচারণাগুলোর মাধ্যমে দ্বিধা ও লাজের ব্যাপারটা ভেঙ্গে দিতে চাচ্ছে। এটা হল সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রথম মাত্রা’।
‘দ্বিতীয় মাত্রা হল, এখানে দেখানো হয়েছে একজন খ্রিষ্টান, অপরজন মুসলিম। এর মাধ্যমে ধর্মীয় স্বাতন্ত্রকে বিলুপ্ত করার একটা আহ্বান জানানো হয়েছে। আরও একটু স্পষ্ট করে বলতে গেলে, এক্ষেত্রে ‘দ্বিধাহীন কাছে আসা’ শব্দ ব্যবহার করে তারা একে এক ধরনের বীরত্বব্যঞ্জক আবহ দেওয়ার চেষ্টা করেছে’ আওয়ার ইসলামকে বলেন তিনি ।
‘রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থাকে বিদ্রুপের শ্লোগান’
তিনি আরো সংযোগ করেন, ‘যারা ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে প্রেম কিংবা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত তাদেরকে এক ধরনের অবজ্ঞা ও বিদ্রুপ করতে চাওয়া হয়েছে এই শ্লোগানের মাধ্যমে- যে তোমরা দ্বিধার কাছে পরাজিত হয়ে গেলে’।
‘এছাড়া রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থা কারণে ছেলে মেয়েরা একে অপরকে ভালো লাগলেও যারা এ বিষয়ে খোলামেলা কথা বলে না, তাদেরকেও বিদ্রুপ করা হয়েছে এতে’। বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে এই দ্বিধাটা ঠিক না এবং থাকা উচিত না’।
‘সব বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করলে ক্লোজআপের এবারের আয়োজনকে শুধু সাংস্কৃতিক আগ্রাসন অথবা অশ্লীলতা ও নারী পুরুষের অবৈধ সম্পর্কের উস্কানি বললে পুরোপুরি বলা হবে না। আমি বরং বলবো এর মাধ্যমে একই সাথে নারী পুরুষের অবৈধ সম্পর্কের প্রতি উস্কে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এবং বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মুসলিম-খৃষ্টান প্রত্যেকেরই ধর্মীয় যে স্বাতন্ত্র রয়েছে এবং বিবাহের ক্ষেত্রে এই স্বাতন্ত্র বজায় রেখে নৈতিকতার যে মিনার তৈরি করা হয়েছে তা ধ্বসে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে’ বলে মন্তব্য করেছেন এই ইসলামি চিন্তাবিদ।
‘আমি বলবো এখানে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দুটি মাত্রা চালিয়েছে তারা। একটি হচ্ছে অনৈতিকতা ও অশ্লীলতাকে উৎসাহিত করা, অপরটি হচ্ছে অনৈতিকতা ও অশ্লীলতার ছড়াছড়ির পাশাপাশি মুসলিম স্বাতন্ত্র বজায় রেখে বিবাহ করার যে একটা ব্যাপার রয়েছে, একে প্রচন্ডভাবে ধাক্কা দেওয়া এবং অবজ্ঞা করা। আমার কাছে এটা এক ধরণের বিদ্রোহ বলে মনে হয়েছে’ বলেন গবেষক শরীফ মুহাম্মদ।
‘সবার সচেতনতা কাম্য’
‘মুসলিম দেশে ব্যবসা করা একটি ব্যবসায়িক কোম্পানির এমন বহুমাত্রিক শয়তানি আগ্রাসনের বিষয়ে জাতি ও সরকারের সচেতন হওয়া উচিত। পাশাপাশি তাদের অশালীন বিজ্ঞাপন সরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসা’র পক্ষে মতামত দিয়েছেন তিনি।
‘এই কোম্পানিগুলো দেশে মূলত ব্যবসা করতে এসেছে নাকি কোন ধরনের এজেন্ডা নিয়ে এসেছে এ নিয়ে দেশের সচেতন মুসলমানদের মাঝে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এবং এই সন্দেহ শতভাগ তারাই তৈরি করেছে’ বলে মন্তব্য করেছেন লেখক ও গবেষক শরীফ মুহাম্মদ।
‘সমাজে অপরাধ ও হারাম সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ভয়াবহ প্রচারণা’
একই বিষয়ে বিষয়ে ইসলামী আলোচক ও আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ আওয়ার ইসলামকে বলেছেন, ‘সমাজে অপরাধ ও হারাম সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে দীর্ঘদিন ধরে ভয়াবহ প্রচারণা চালিয়ে আসছে ক্লোজআপ। এর আগে বিভিন্ন মুসলিম দেশে সমকামিতা বৈধতার পক্ষে কাজ করে এসেছে এই কোম্পানি। একসময় তারা বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের অবৈধ সম্পর্ক ও জেনার দিকে আহবান করত। কিন্তু বর্তমানে তারা মুসলিমদের অন্য ধর্মের মানুষের সাথে জেনার সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার আহ্বান করতে চাচ্ছে যা শরীয়তে সম্পূর্ণ হারাম’।
তিনি বলেন, ‘হারামের প্রতি ঈমানদারের শুধু দ্বিধা নয়, বরং হারাম বর্জনের ব্যাপারেও থাকতে হবে দৃঢ় প্রত্যায়।
এসব ইবলীসীয় প্ররোচনায় পা দিয়ে কতো তরুণ নিজের সোনালী জীবন ধ্বংস করেছে, কতো পরিবার ভেঙ্গেছে, কতো সন্তান মমতাময়ী মা ও বাবার অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে পরে আক্ষেপ করেছে, কতো মুসলিম তার রবের কাছ থেকে দূরে সরে গেছে! মহান আল্লাহ আমাদের শয়তানের শয়তানী চক্রান্ত থেকে হেফাজতে রাখুন ‘।
‘তরুণদের প্রশংসনীয় 'লাজ' দূর করতে চায়’
শায়খ আহমদুল্লাহ আরো বলেন, ‘নিজের ভুল স্বীকার করতে আমাদের ‘দ্বিধা’ হয়। কাছের মানুষের অন্যায়কে অন্যায় বলতে ‘দ্বিধা’ হয়। গরিব বয়স্ক লোককে সম্মান জানাতে ‘দ্বিধা’ হয়। বাসার কাজের লোককে নিজেদের মতো মানুষ ভাবতে 'দ্বিধা' হয়। এমন কতো মন্দ ‘দ্বিধা’ আমরা পদে পদে লালন করি’।
তিনি বলেন, ‘এসব নিন্দনীয় ‘দ্বিধা’ দূরের জন্যে ওরা ক্যাম্পেইন করে না। ওরা ক্যাম্পেইন করে মানব-চরিত্রের অলংকার —‘সহজাত লাজুকতা’ ও হারামে লিপ্ত হওয়ার ‘দ্বিধা’ দূর করার জন্যে’। যারা তরুণদের প্রশংসনীয় 'লাজ' দূর করতে চায়, নির্মূল করতে চায় দেশীয় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, তাদের থেকেই বরং দ্বিধাহীন দূরে সরার গল্প আমাদের রচনা করতে হবে’।
এই কোম্পানিগুলো মানুষের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও কষ্টে উপার্জিত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে উল্লেখ করে শায়খ আহমদ উল্লাহ এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক ও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এটি/এনটি