শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ভারতে কেন প্রতিষ্ঠা হলো দারুল উলুম দেওবন্দ!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মূল: মুফতি ঝরওলি খান
অনুবাদ: ইবনে নাজ্জার


বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরে কুরআন মুফতি ঝরওলি খান সাহেব করাচির গুলশানে ইকবালের 'জামে মসজিদে আহসান'এর এক দীর্ঘ সময় ধরে ইমাম ও খতিব ছিলেন। সাধারণ মানুষের দ্বীনি শিক্ষার ব্যাপারে খুবই সোচ্চার ছিলেন। প্রতিদিন ফজর, আছর ও এশার পর চলত সাধারণ মানুষের জন্য তার সহজবোধ্য ক্লাস। পড়াতেন কুরআন শরীফের তরজমা-তাফসির, নুরুল ইযাহ, আত-তিবুন নববি, গুলিস্তাসহ আরো প্রাথমিক কিছু কিতাবাদি। তবে তার কুরআনের ক্লাস বেশি প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারো কুরআনপ্রেমী ছুটে আসত তার কাছে। অনলাইনের সুবাদে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছিল তার তাফসিরের সুনাম। ফলে তার প্রতিদিনের তিন-চার ঘন্টার ক্লাসে অফলাইন ও অনলাইনে তিন লক্ষাধিক মানুষ উপস্থিত থাকত।

এরই ধারাবাহিকতায় একবার তিনি সুরায়ে আম্বিয়ার তাফসির করতে গিয়ে বলেন, আল্লাহ তাআলা ভারতের ওলামায়ে কেরামের কবরগুলো নুরে পরিপূর্ণ করে দিন। তারা সাধারন মানুষের উপর মেহনত করেছেন, তাদের চিন্তা-চেতনা, আদর্শ-ভাবনা ও মন-মস্তিষ্ক পরিশুদ্ধ করেছেন, তাদের বুঝিয়েছেন, যদি তোমরা এই টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত খরচ না করে জমিয়ে রাখো আর মানুষ হিন্দু অথবা শিখ হয়ে যায়; তাহলে আল্লাহ তাআলা তোমাদের পাকড়াও করবেন। এই সম্পদের কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব নিবেন।

এটা আমাদের উপর ভারতীয় উলামায়ে কেরামের অনেক বড় এহসান-অবদান, তা স্বীকার করতেই হবে। এজন্যই আল্লাহ তাআলা দারুল উলুম দেওবন্দ ভারতে প্রতিষ্ঠা করেছেন। পেশাওয়ার শহরের আশেপাশে কিংবা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যখানে তৈরি করেন নাই। কেননা ভারত এমন একটি দেশ, যেখানের মানুষের অভ্যাস হলো দ্বীনের জন্য খরচ করা। আল্লাহর রাস্তায় দান সদকা করা। ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করতে থাকা।

একবার আমরা জেদ্দা থেকে বাসযোগে মক্কা যাচ্ছিলাম। ঘটনাক্রমে সেই বাসে ভারতের হাজী সাহেবরাও ছিলেন। বেশিরভাগ আলেম ছিলেন। দেওবন্দ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। তারা এক ব্যক্তির দিকে ইঙ্গিত করে আমাকে বললেন, ইনি আমাদের মাঝে অনেক বড় ধনী ব্যবসায়ী। প্রতি বছর ১০০ জন মানুষকে হজ্জ করতে নিয়ে যান। এটা কোনো সাধারণ বিষয় নয়। সহজ কাজ নয়। আপনি একজন মানুষের খরচ দিয়ে দেখেন, বুঝতে পারবেন। আমি বললাম, এটা দারুল উলুম দেওবন্দ আর দিল্লির ওলামায়ে কেরামের অবদান।

আমাদের মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মরহুম হাজী আলী সাহেব। একবার তিনি আমাকে বললেন, ভারতের গুজরাট প্রদেশের অন্তর্গত 'সুরত' শহরের সাথে আমার নাড়ির সম্পর্ক, সেখানে আমি ১০০ মসজিদ বানিয়েছি। প্রত্যেকটা মসজিদের সাথে একটা করে মাদারাসাও নির্মাণ করেছি। যাতে মানুষ মুসলমান থাকে। তাদের ঈমান ও একিন ঠিক থাকে। আর সেখানের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন এই করাচি থেকেই যায়। তাবলীগ জামাতের মারকাজ দিল্লির নিজামুদ্দিনের সমস্ত খরচাদিও রায়বেন্ড থেকে যায়। এজন্য রায়বেন্ড ছাড়া তাদের কথার কোনো ধর্তব্য নেই।

মরহুম হাজী আলী সাহেব দারুল উলুম দেওবন্দও যেতেন। দারুল উলুম দেওবন্দ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনেক বড় প্রতিষ্ঠান। পুরো বিশ্বে কুফর, গোমরাহী ও বিদআতের মোকাবেলাকারী প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীর যেখানেই কোনো ভালো কাজের ঝলক অথবা বাতি জ্বলছে, সেখানে দারুল উলুম দেওবন্দের অবদান রয়েছে। যেহেতু হাজী সাহেবের সাথে আমার ঘনিষ্টতা তৈরি হয়েছিল। আমার প্রতি তার ভালোবাসাও ছিল অনেক। বুখারি ও তিরমিজি শরীফের ক্লাস দুটোর পুরো সময়টাতে তিনি ক্লাসে বসতেন।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হাজী সাহেব দেওবন্দ এমনি এমনিই যান নাকি কোন কিছু দানও করেন? বললেন, ৫০ হাজার দেই। আমি বললাম, ইন্নালিল্লাহি। উনি বললেন, আমি তোমাদের থেকে ঋণ নিয়েছি নাকি? আমি বললাম, হাজী সাহেব দারুল উলুম দেওবন্দ আমাদের কেবলা ও প্রাণকেন্দ্র। দারুল উলুম দেওবন্দ শুধু ভারতের নয় বরং আমাদের পাকিস্তানেরও সমস্ত মাদ্রাসার সেনাপতি। তিনি নিজের কথা বলতে লাগলেন আর আমি আমার তাকরির চালিয়ে গেলাম। বলতে লাগলেন, এই আসতেছে মাদ্রাসার চাঁদা নেওয়ার জন্য, ওই আসতেছে, সে আসতেছে। তোমরা আমাকে কী পেয়েছ? এটা আমাদের মধ্যকার কথাবার্তার ধরণ ছিল, তবে শেষপর্যন্ত আমি যা বলতাম সেটাই হত। এখানেই ঘটনা শেষ।

কিছুদিন পর তিনি আমাকে বললেন, আমি ভারত যাচ্ছি। একমাস সেখানে কাটাব। তারপর চলে গেলেন। যখন ফিরে এলেন, তখন আমার সাথে যেহেতু সম্পর্ক বেশি ছিল তাই আমার বাচ্চাদের জন্য সেখান থেকে কাজুবাদামসহ আরো অনেক কিছু নিয়ে এলেন। তার মধ্যে থেকে একটি রশিদ বের করে আমাকে দিলেন আর বললেন, দেখ! দেখ! পড়! পড়! তুই তো খালি ইন্নালিল্লাহ পড়তে পারিস আর কিছু পড়তে পারিস না। এটা পড়ে দেখ। তাতে লেখা ছিল, দারুল উলুম দেওবন্দের সাহায্য বাবদ ৫০ হাজার। তিনি বললেন, পিছনে উল্টিয়ে দেখ। পিছনে দেখলাম। তাতে লেখা ছিল, তৎকালীন মুহতামিম মাওলানা মারগুবুর রহমান সাহেব র. লিখেছেন; হাজী আলি সাহেব তার অভ্যাস ও নিয়ম অনুযায়ী দারুল-উলুম দেওবন্দ এসেছেন। তবে এইবার তার আগমন কিছুটা ভিন্ন রকমের ছিল। আর কেনই বা হবে না, যখন দারুল উলুম দেওবন্দের এক সুসন্তান, সমর্থক, প্রশংসাকারী ও প্রেমিক আর দারুল উলুম দেওবন্দের তত্ত্ব-পরিচয় ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সঠিক ধারক-বাহক (তারপর আমার নাম লিখেছেন) এর সোহবত ও সংস্পর্শে তিনি থাকেন। এবার তিনি দারুল উলুম দেওবন্দকে (উপরে উল্লেখিত ৫০ হাজার ছাড়া) এক মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন। এজন্য দারুল উলুম দেওবন্দের সকল শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারী ও মজলিসে শুরার সকলেই হাজী সাহেব ও এই অধমের প্রতি অনুগৃহীত ও কৃতজ্ঞ। আমাকে বললেন, তুই ইন্নালিল্লাহ বলে ছিলি না, দেখ তার কেমন প্রভাব পড়েছে? এবার যখনই যাব, এক লাখ পুরো দিব।

তিনি আরো বললেন, মুহতামিম সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন; এবার তো অনেক বাড়িয়ে দিলেন, কারণ কী? আমি বলেছি, ওখানে যেই ওলামাদের আমরা অনুসরণ করি, পিছনে পিছনে চলি; আমরা দেওবন্দে কম টাকা দিই বলে, তারা রাগ করেন। ইন্নালিল্লাহ পড়েন। দেখো, বড় ব্যক্তিরা কথার কত দাম দেয়? কীভাবে কথার মান রাখে? তারা পিছু হটে না। আলহামদুলিল্লাহ! এমন অনেক দুনিয়া আছে। এই যে আপনারা দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ছড়াছড়ি দেখতেছেন। পৃথিবীর কোণা কোণা থেকে ছাত্র আসতেছে। করাচির মাদ্রাসাগুলো তো হিমস, বলব, বুখারা, সমরকন্দ ও তিরমিজের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করছে। সেখানের নকশা পেশ করছে। আলহামদুলিল্লাহ!

যাইহোক সুরায়ে আম্বিয়ায় আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, যত নবি ছিলেন সবাই নেকি ও ভালো কাজে এগিয়ে থাকার চেষ্টা করতেন। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-কষ্ট সর্বদায় আল্লাহর কাছে চাইতেন। কেউ কবরপূজারী ছিলেন না। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বিপদ থেকে উদ্ধারকারী, প্রয়োজন পূরণকারী হিসেবে মানতেন না। তারা শুধু এক আল্লাহকেই অনুসরণ করতেন। আর আল্লাহকেই ভয় পেতেন। এটাই সূরা আম্বিয়ার সারমর্ম যে, হয়রান-পেরেশান না হয়ে ভালো কাজ করার চেষ্টা করো। আর আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করা যে, জীবনে আমরা দ্বীনের খেদমত করার সুযোগ পেয়েছি। তিনি আমাদের ভালো কাজে বেশি বেশি খরচ করার সাহস, ইচ্ছা ও তৌফিক দিয়েছেন।

-এএ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ