নুরুদ্দীন তাসলিম।।
বাংলাদেশে ওলামায়ে কেরামের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সেতুবন্ধনের যতগুলো মাধ্যম রয়েছে এর মধ্যে ওয়াজ মাহফিল অন্যতম। শীতকাল এলেই সরব হয়ে উঠেছে ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন।
শতাব্দীকাল ধরে দ্বীনের দাওয়াত ছড়িয়ে আসা মাহফিলগুলো নিয়ে গত কয়েক বছরে হঠাৎ করেই বেশ কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে ধর্মপ্রাণ মানুষদের। প্রথমে দেখা গেছে মাহফিলগুলোর উপর বিভিন্ন ধরনের বিধি নিষেধ ও অসন্তোষ। পরবর্তীতে মাহফিলগুলোতে উপস্থিত হয়ে স্থানীয়দের বিভিন্ন অশোভন আচরণও ছিল চোখে পড়ার মতো। সবকিছু ছাপিয়ে দুই এক বছর ধরে খোদ কিছু কিছু বক্তার আলোচনা নিয়েই তৈরি হয়েছে বিতর্ক। মাহফিলের মঞ্চে কুরআন হাদিসের বাইরে বক্তাদের বিভিন্ন ধরণের গল্প-কাহিনী, অঙ্গভঙ্গি ও হাস্যরসে মাহফিলগুলো অনেকটা প্রাণ হারাতে বসেছে বলেও অভিযোগ অনেকের।
এর জন্য বক্তাদের ব্যবসায়ী মনোভাব, এলেমের গভীরতা না থাকার বিষয়টি যেভাবে আলোচনায় এসেছে ঠিক ততটাই দায়ী করা হয়েছে আয়োজক কমিটিকে। অনেকেই মনে করেন মাহফিলের মঞ্চগুলোতে হক্কানী আলেমদের বিতর্কিত করার যে আয়োজন তৈরি হতে চলেছে এর জন্য আয়োজক কমিটিরও দায় কম নয়। সচেতন আয়োজক কমিটি কখনোই শ্রোতার সংখ্যা বাড়াতে সুর আর বাকপটুদের মাহফিলের জন্য দাওয়াত দেন না। মাহফিলের জন্য যোগ্য আলোচকদেরই তারা নির্বাচিত করেন। এজন্য বিভিন্ন এলাকায় হক্কানী আলেমদের মাধ্যমে পরিচালিত মাহফিলগুলোকেও সামনে এনেও উদাহরণ টানতে দেখা যায় অনেককে।
‘রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আলেমদের অধীনে পরিচালিত ইত্তেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়ার পক্ষ থেকে প্রতিবছর যে মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় এখানে সব সময় বাছাই করেই বক্তা নির্বাচন করা হয়। দেশে বক্তাদের বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যে বিতর্ক তৈরি হয় তা যে এই মঞ্চের বক্তাদের নয় তা অনায়াসেই বলে দেওয়া যায়’ বলছিলেন আতিকুল ইসলাম নামে একজন।
আরো পড়ুন: ধর্ষণ মামলায় সময়ের বাধ্যবাধকতা: ‘ভুক্তভোগীর ন্যায়বিচারের অধিকারে হস্তক্ষেপ’
তিনি আরো বলেছেন, ‘শুধু মোহাম্মদপুর কেন আমার জানা মতে উত্তরাসহ রাজধানীর বাইরে ময়মনসিংহ, নরসিংদীসহ দেশের যেসব জায়গায় আলেমদের মাধ্যমে অথবা আলেমদের পরামর্শে মাহফিলের আয়োজন করা হয়, সেই মঞ্চগুলো থেকে কখনো বিতর্ক তৈরি হয় না। তাই বক্তাদের যতটা দায় রয়েছে আয়োজক কমিটিরও ঠিক ততটাই বলে অভিমত রাজধানীর এই বাসিন্দার।
জুবায়ের আহমেদ নামে আরেকজন বলেছেন, আয়োজক কমিটি বিবেচনা করে ভালো আলেমদের দাওয়াত দিলেই তো মাহফিলের মঞ্চগুলো কৌতুকের আড্ডায় পরিণত হয় না। তবে যেহেতু বক্তাদের থেকে মানুষ দ্বীনের বার্তা পেতে চায় তাই তাদেরওে এ বিষয়টিতে যথেষ্ট সচেতন থাকা প্রয়োজন বলে মতামত দিয়েছেন তিনি।
‘আয়োজক-আলোচক ( বক্তা) উভয়ের নিয়ত সহিহ করা প্রয়োজন’
এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া দারুল আরকাম আল ইসলামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সিনিয়র সহ-সভাপতি আল্লামা সাজিদুর রহমান বলেছেন, ‘ওয়াজ মাহফিল দ্বীনের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম মাধ্যম। তাই এর আয়োজক-আলোচক ( বক্তা) উভয়ের নিয়ত সহিহ করা প্রয়োজন’।
তিনি বলেছেন, ‘আয়োজক কমিটির দায় অবশ্যই রয়েছে তবে এর আগেও বক্তাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। দায় যতটা না আয়োজক কমিটির উপর বর্তায় বিবেচনা করলে এর থেকেও বেশি দায় আলোচকদে (বক্তা)। কারণ বক্তারা হলেন ওরাসাতুল আম্বিয়া। অবশ্যই তাদের উচিত নয় দ্বীন প্রচার মাধ্যমগুলোকে বিতর্কিত করা অথবা এর মাধ্যমে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া কোন ভুল বার্ত ‘।
‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাহফিলের আয়োজক কমিটি হয়ে থাকেন সাধারন শিক্ষিত, ভালো আলেম বক্তা নির্বাচনের মতো বুঝ থাকে না অনেকের। বক্তা আমন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে তারা দেখেন; কে ভালো আলোচনা করতে পারে, কার সুর ভালো, কোন ব্যক্তিকে দাওয়াত দিলে মানুষ বেশি হবে। এক্ষেত্রে তাদের নিয়তে কিছুটা ভুল-ভ্রান্তির কারণে লোক বেশি হচ্ছে; কিন্তু মাহফিলের আসল যে উদ্দেশ্য তা হাসিল হচ্ছে না’-বলেছেন তিনি ।
আরো পড়ুন: ‘ইসলামে যৌতুক বলে কিছু নেই, মোহরের ক্ষেত্রেও বাড়াবাড়ির সুযোগ নেই’
‘দুই পক্ষেরই উদ্দেশ্য এবং নিয়ত ঠিক করতে হবে। সুরের মাধ্যমে মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করা- কখনোই হক্কানি ওলামায়ে কেরামের কাজ হতে পারে না’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আজীবন মানুষকে দ্বীনের পথে আহ্বান করে গেছেন কথা ও কাজের মাধ্যমে। তিনি কখনো কন্ঠের অঙ্গভঙ্গি দিয়ে মানুষকে দ্বীনের পথে ডাকেননি। দ্বীন প্রচারের মাধ্যম মাহফিলের আলোচকরাও (বক্তা) দ্বীনের দায়ী তাই তাদেরও প্রত্যেকটি বিষয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু সালামের অনুসরণ করা প্রয়োজন’- বলেন আল্লামা সাজিদুর রহমান।
‘সবাইকেই কেয়ামতের দিন জবাবদিহিতা করতে হবে’
তিনি মনে করেন, বক্তারা যদি ব্যবসায়ী মনোভাব বাদ দিয়ে সত্যিকার অর্থেই ওরাসাতুল আম্বিয়ার দায়িত্ব পালন করেন তাহলে আয়োজক কমিটিও ঠিক হয়ে যেতে বাধ্য। তাই এখানে প্রথম দায়িত্ব বক্তাদের’ বলেই মতামত দিয়েছেন এই ইসলামী চিন্তাবিদ।
‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করা হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে’ বুখারী শরীফে বর্ণিত এই হাদীসের উদ্বৃতি টেনে তিনি বলেন, সবাইকেই কেয়ামতের দিন জবাবদিহিতা করতে হবে, তাই মাহফিলের আয়োজক-আলোচক সব পক্ষেরই নিয়ত সহিহ করা জরুরি’ বলেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া দারুল আরকাম আল ইসলামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সিনিয়র সহ-সভাপতি আল্লামা সাজিদুর রহমান।
‘মাহফিলের আয়োজক কমিটিও ভালো কাজে আহ্বানকারীদের অন্তর্ভুক্ত’
'ভালো কাজের দিকে আহ্বানকারীর মাধ্যমে যত মানুষ ভালো কাজ করবে, আহ্বান করার কারণে আহ্বানকারীও ঠিক তাদের মতই সওয়াব পাবেন' হাদিসের এই অংশ উদ্ধৃত করে রাজধানীর জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া আজিজিয়ার প্রধান মুফতি, মুফতি হিফজুর রহমান বলেছেন, মাহফিলের আয়োজক কমিটিও ভালো কাজে আহ্বানকারীদের অন্তর্ভুক্ত, তাই তাদের উচিত কুরআন-হাদীসের সহিহ আলোচনা করেন এমন বক্তাদের মাহফিলের জন্য নির্বাচিত করা।
তিনি বলেন, খোদ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবে তাবেঈন, আকাবির ওলামায়ে কেরাম এ দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই আমাদেরও সচেতন থাকতে হবে এ বিষয়ে।
মুফতি হিফজুর রহমান আরও বলেন, ‘আয়োজকদের মাধ্যমেই মাহফিলের মঞ্চে উঠে থাকেন বক্তারা, তাই তাদের মাধ্যমে মানুষ ভালো কিছু পেলে এর সওয়াব অবশ্যই তারা পাবেন। ঠিক তেমনি মানুষ দ্বীনের বিষয়ে কোন ধরণের ভুল বার্তা পেলে এর দায়ভারও তাদের উপর বর্তাবে’।
‘দ্বীন- ধর্মের প্রতি ভালোবাসা সত্যিকার অর্থেই যেন সার্থক হয়’
তিনি বলেন, ‘টাকা ব্যয় করে যারা মানুষকে দ্বীনের বাণী শোনাতে চাচ্ছেন, হক পথে পরিচালিত করতে যাচ্ছেন, আয়োজন-এর পূর্বে বিষয়টি নিয়ে তাদের অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার’।
আরো পড়ুন: পরকীয়া মহামারী রোধে দুই ইসলামি চিন্তাবিদের পরামর্শ
‘হক্কানি ওলামায়ে কেরাম কোন মাহফিলের তদারকিতে থাকলে এলেম নেই এমন বক্তারা আসার সুযোগ পান না, তবে সাধারণ শিক্ষিত আয়োজকদের ক্ষেত্রেই বিষয়টি বেশি ঘটে থাকে এবং মাহফিলের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে মানুষ ভুল বার্তা পেয়ে থাকেন’।
যেহেতু দ্বীন- ধর্মের প্রতি ভালোবাসা থেকেই টাকা খরচ করে মাহফিলের আয়োজন করছেন সাধারণ শিক্ষিত আয়োজকরা, তাই সত্যিকার অর্থেই যেন তাদের ভালোবাসা সার্থক হয় এবং মানুষ ধর্মের সঠিক বিষয়গুলো জানতে পারেন; এজন্য প্রয়োজনে বক্তা বিষয়ে বুঝেন এমন অভিজ্ঞ আলেমদের কাছে তাদের পরামর্শ নিতে হবে। অন্যথায় দায় এড়ানো সম্ভব হবে না-আওয়ার ইসলামের কাছে মন্তব্য করেছেন রাজধানীর জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া আজিজিয়ার প্রধান মুফতি ও ইসলামী চিন্তাবিদ মুফতি হিফজুর রহমান।
এটি/এনটি