আতাউর রহমান খসরু।।
করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে লকডাউনকে একটি কার্যকর হাতিয়ার মনে করা হয়। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ আংশিক ও পূর্ণাঙ্গ লকডাউন ঘোষণা করে। কোনো কোনো রাষ্ট্র ‘লকডাউন’ শব্দ ব্যবহার না করে ‘বিধি-নিষেধ’-এর মতো বিকল্প শব্দ ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেছে।
কোরআনে লকডাউনের ধারণা : পবিত্র কোরআনের সুরা নামলে মহান আল্লাহ সুলাইমান (আ.) ও পিপীলিকার সংলাপ তুলে ধরেছেন। সে সংলাপ থেকে এ ধারণা লাভ করা যায় যে ঘরে অবস্থান করাটা কখনো কখনো মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যা আধুনিক লকডাউনেরও মূল ভাষ্য। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তারা পিপীলিকা অধ্যুষিত উপত্যকায় পৌঁছল, তখন এক পিপীলিকা বলল, হে পিপীলিকাবাহিনী! তোমরা তোমাদের ঘরে প্রবেশ করো, যেন সুলাইমান ও তাঁর বাহিনী তাদের অজ্ঞাতসারে তোমাদের পদতলে পিষিয়ে না ফেলে।’ (সুরা : নামল, আয়াত : ১৮)
নবীজির যুগে চলাচলে নিয়ন্ত্রণ : শুনতে নতুন মনে হতে পারে অথবা অনেকে জেনে আশ্চর্যান্বিত হবেন যে মানুষের চলাচলে নিয়ন্ত্রণারোপ ইসলামের ইতিহাসে নতুন নয়, বরং ইসলামের ইতিহাসে মহানবী (সা.) সর্বপ্রথম মানুষের চলাচলের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেন এবং তাদের ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেন। অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের সময় মহানবী (সা.) মক্কাবাসীর উদ্দেশে ঘোষণা দেন, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ, যে ব্যক্তি নিজের ঘরে অবস্থান করবে সে নিরাপদ এবং যে ব্যক্তি মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ। তাঁর ঘোষণার মর্ম হলো, কেউ রাস্তায় থাকলে সে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিরোধিতাকারী যোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হবে। ফলে তাকে হত্যা করা হবে। কিছু মানুষ মহানবী (সা.)-এর ঘোষণার বিরুদ্ধাচরণ করে এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) তাদের হত্যা করেন। বিপরীতে যারা ঘরে অবস্থান করে এবং দূরে পালিয়ে যায়, নবীজি (সা.) তাদের ক্ষমা করে দেন।
মক্কা বিজয়ের সময়কার এই ঘোষণা থেকে চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ বা লকডাউনের ধারণা পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) তা করেছিলেন মানুষের জীবন, সম্পদ ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য।
অবশ্য মহানবী (সা.)-এর দাদা আবদুল মুত্তালিব বিন হাশিম আবরাহার আক্রমণ থেকে মক্কাবাসীর জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য তাদের নিকটবর্তী পাহাড়ে সরে যাওয়ার এবং সেখানে অবস্থানের নির্দেশ দেন। তিনি তাদের বলেন, আবরাহা ও তার বাহিনী মক্কা ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত তারা যেন মক্কার পাহাড়গুলোর গোপন গুহায় অবস্থান করে, সেখান থেকে বের না হয় এবং চলাচল পরিহার করে। (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা ২৯)
নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় লকডাউন : মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.)-এর যুগে মানুষের চলাচলের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। বসরায় নিযুক্ত তাঁর গভর্নর জিয়াদ ইবনে আবিহ নারীর সম্ভ্রম রক্ষার জন্য রাতের বেলা চলাচলের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ঘোষণা করেন। কেননা তখন বসরায় আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল এবং একাধিক নারীর সম্ভ্রমহানির ঘটনা ঘটেছিল। জিয়াদ ইবনে আবিহ তাঁর ঐতিহাসিক ‘বাতরা’র ভাষণে বলেন, ‘তোমরা রাতের বেলা বের হওয়া থেকে বিরত থাকবে। রাতের বেলা কাউকে বের হতে দেখলে তার রক্ত প্রবাহিত করা হবে। আমি তোমাদের এ ক্ষেত্রে ততটুকু সময় দিচ্ছি, যতটুকু সময়ে কুফা থেকে তোমাদের কাছে এবং তোমাদের কাছ থেকে কুফায় সংবাদ পৌঁছায় (রাত পরিমাণ)। তোমরা জাহেলি যুগের আহ্বান থেকে বিরত থাকো। কেউ জাহেলি যুগের আহ্বান জানালে আমি তার জিহ্বা কেটে ফেলব। তোমরা এমন ঘটনা ঘটিয়েছ, যা আগে কেউ করেনি। আমরা (রাষ্ট্র) প্রতিটি অপরাধের শাস্তি নির্ণয় করেছি। যে মানুষকে ডুবিয়ে হত্যা করবে আমরা তাকে ডুবিয়ে হত্যা করব, যে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করবে আমরা তাকে পুড়িয়ে হত্যা করব। যে কারো ঘরে সিঁধ কাটবে আমরা তার কলিজা ফুঁটো করে ফেলব। কেউ কাফনের কাপড় চুরি করলে আমরা তাকে জীবন্ত কবর দেব। সুতরাং আমাদের থেকে তোমাদের হাত ও মুখ নিরাপদ রাখো। তোমাদের থেকে আমাদের হাত ও মুখ নিরাপদ রাখো।’ (মুখতারাত মিন আদাবিল আরাবি : ২/৪৫)
জিয়াদ ইবনে আবিহ রাতের বেলা মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ বাহিনী নিয়োগ দেন। তিনি নির্দেশ দেন তারা যেন রাতে রাস্তায় রাস্তায় টহল দেয় এবং কাউকে বসরার রাস্তায় পাওয়া গেলে গ্রেপ্তার করা হয়। নির্দেশনা বাস্তবায়নে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে হিসন ও জায়াদ ইবনে কায়েসকে নিযুক্ত করেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে বসরায় শৃঙ্খলা ফিরে আসে, মানুষের জীবন ও সম্পদ এবং নারীর সম্ভ্রম রক্ষা পায়।
তথ্যঋণ : ইসলামস্টোরি ও আলজাজিরা।
এনটি