সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর।।
ইসলামের মধ্যে জাত-পাত, বংশ-গোত্র, উঁচু-নীচুর কোনো ধারণা নেই। ইসলাম কোনো ধরনের কৌলিন্য প্রথা বা আশরাফ-আতরাফের ধার ধারে না। ইসলামের সীমারেখায় সকলে সমান। আরব-আজম, হিন্দুস্তান আর মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। এক পৃথিবীর সকল মুসলিম একই সমান, কোনো বৈষম্য নেই। হোক সে কালো বা সাদা, হোক সে আজকে কালেমাপড়া মুসলিম কিংবা শত বছর ধরে বংশ পরম্পরায় অবধারিত মুসলিম। ইসলাম কারো মধ্যে কোনো ধরনের প্রান্তিক দেয়াল বা প্রতিবন্ধকতা তৈরির সুযোগ দেয় না।
এগুলো তত্ত্বীয় কথা। কিন্তু ঐতিহাসিক চোখ দিয়ে যদি আমরা আমাদের ইতিহাস বিচার করি তাহলে আমাদের চোখে মুসলিমদের মধ্যে আশরাফ-আতরাফ (উঁচু-নীচু) নির্ধারণের একটা প্রচ্ছন্ন ধারা চোখে পড়বে। আরবরা যেমন কোনোদিনই অনারব মুসলিমদেরকে তাদের সমকক্ষ মনে করে না, তেমনি আমাদের এই দেশেও ইসলাম আগমনের পর থেকেই আশরাফ-আতরাফের একটা ধারা প্রবল ছিল, এই কিছুদিন আগ পর্যন্তও।
আমরা আজকে এই স্বাধীন বাংলাদেশে বসবাস করে সেই অঘোষিত ধারাকে যদিও অনুভব করতে পারছি না, কিন্তু সে ধারা যে একটা সময় বেশ প্রবল ছিল সেকথা অস্বীকারের জো নেই।
ইতিহাসটা একটু খোলা চোখে দেখার চেষ্টা করি। আরবে ইসলাম আগমনের কিছুদিন পরই এই বঙ্গদেশে ইসলাম আগমন করে, এটি প্রায় সতঃসিদ্ধ সত্য। আরব-পারস্য-তুর্কিস্তানের অনেক সুফি, দরবেশ, ধর্মপ্রচারক এই বঙ্গ অঞ্চলে এসে নিভৃতে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তাদের দাওয়াতের ফলে এখানকার ‘নিম্নবর্ণের’ হিন্দু-বৌদ্ধরা ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় তাদের সংখ্যা ছিল যদিও হাতেগোনা, তবে সুফি-দরবেশদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় দিন দিন বঙ্গের নিভৃত নানা পল্লিতে ইসলামের পরিধি বিস্তৃত হতে থাকে।
এই ধারা চলতে থাকে তুর্কি যোদ্ধা ইখতিয়ারুদ্দিন মুহাম্মদ খিলজি বাংলার রাজধানী গৌড় বিজয়ের আগ পর্যন্ত। তুর্কিদের বিজয়ের পর এ অঞ্চলে মুসলিম ধর্মপ্রচারকদের আগমন বেড়ে যায় এবং বাংলার নানা অংশে তারা স্বতন্ত্রভাবে দাওয়াতি কার্যক্রম শুরু করেন। এভাবে শতাব্দী পার হয়ে যায়। একদিকে মুসলিম শাসকদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নিরাপত্তা, অন্যদিকে সুফি-দরবেশদের দাওয়াতের ফলে বঙ্গ অঞ্চলের হাজার হাজার নিম্নবর্ণের হিন্দু-বৌদ্ধ ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে।
বঙ্গ অঞ্চলের জন্য এ ছিল এক স্বাভাবিক প্রবণতা। কারণ ব্রাহ্মণ ও হিন্দু-বৌদ্ধ শাসকদের নিপীড়নে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিষ্পেষিত ছিল। ইসলামের মর্মবাণী তাদের হৃদয়ে নতুন এক আশার আলো প্রজ্জ্বলিত করতে সক্ষম হয়৷ সামাজিক বিভাজন ও বৈষম্য পায়ে দ’লে ইসলাম অনন্য এক জীবনের কথা শোনায় তাদের। যেখানে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই, যেখানে জাত পাত আর কুলীন-দলিতের কোনো স্থান নেই। সবাই সমান। সুতরাং বাংলায় নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য এই ধর্ম ছিল আশীর্বাদের মতো।
কিন্তু মুসলিম শাসক ও প্রজা—এই দুই তবকার মধ্যে একটা অঘোষিত বৈষম্য রেখার সূত্রপাত ঘটে এদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। সে সময় যারা বাংলা অঞ্চলের মুসলিম শাসক ছিল তারা হতো আরবী, আফগানী, পারসিক অথবা তুর্কি বংশোদ্ভূত। অন্যদিকে যারা নতুন ইসলাম গ্রহণ করত তারা সকলেই ছিল এ অঞ্চলের সাধারণ কৃষক-মজুর শ্রেণির মানুষ। তো, ওই শাসকশ্রেণি এই অঞ্চলের নওমুসলিমদের কখনোই তাদের সমকক্ষ মুসলিম মনে করত না। তারা নিজেদের সবসময় আশরাফ মুসলিম ভাবত, আর এ অঞ্চলের মুসলিমদের মনে করত আতরাফ, মানে তারা নিম্নবর্গের মুসলিম।
শাসকদের সংস্কৃতি ছিল আলাদা, তাদের ভাষা ছিল ফারসি, তাদের পোশাক আর উৎসবও ছিল ভিন্ন। তারা নিজেদের রাজধানীকেন্দ্রিক প্রাসাদ ও দুর্গের বলয়ে বসবাস করত। স্থানীয় মুসলিমদের সঙ্গে কালেভদ্রে তাদের সৌজন্য সাক্ষত হতো বটে, তবে সেটা কখনোই আশরাফের সীমা ডিঙিয়ে নয়।
একথা শুনতে বেখাপ্পা লাগলেও বাস্তবতা ছিল এমনই। ইতিহাসের দিকে তাকালে খুব সহজেই আমরা এমন দৃষ্টান্ত দেখতে পাব। বাংলার সুলতানদের মন্ত্রী, সভাসদ, সেনাপতি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় অধিকাংশ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেত কেবল আফগান, তুর্কি, পারস্যের অভিবাসী আশরাফ মুসলিমগণ। কোনো কোনো সুলতানের দরবারে স্থানীয় উঁচু বর্ণের হিন্দুরাও নিয়োগ পেত অনেক সময়, কিন্তু স্থানীয় মুসলিমরা একেবারে নগন্যই সুযোগ পেত রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের।
এই ধারা চলমান ছিল প্রতিটি সুলতানী শাসনামলে। পরবর্তী নবাবী আমলেও আশরাফ-আতরাফের বিভাজন ছিল। কারণ নবাবরা ছিল পারস্য বংশোদ্ভূত এবং অনেকে শিয়া মতাবলম্বীও ছিল। সুতরাং তাদের মধ্যে নিজস্ব সাম্প্রদায়িক কৌলিন্য রক্ষা করা আরও রক্ষণশীলতায় পরিণত হয়।
ইংরেজ আমলেও ইংরেজরা এই দুই শ্রেণির মুসলিমদের বিভাজিত করে রাখে। এটা তারা করেছিল তাদের প্রশাসনিক সুবিধার কারণে। ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ দিয়ে তারা সহজেই দুটো শ্রেণিকে আলাদা করে রাখে। যারা অভিবাসী আশরাফ ছিল, তাদেরকে তারা নানা প্রলোভনের মাধ্যমে চাকরি বাকরি জুটিয়ে দিত, নিজেদের মহলে জায়গা করে দিত। তাদের দিয়েই শাসন করত এ অঞ্চলের সাধারণ মুসলিমদে প্রজাদের।
এমনকি পাকিস্তান আমলেও এই আশরাফ-আতরাফ ধারা পুরোমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। পাকিস্তানি শাসক এবং সাধারণ পাকিস্তানি জনগণও পূর্ব বাংলার মুসলিমদের তাদের সমকক্ষ মনে করত না। তারা এখানকার মুসলিমদের প্রকারান্তরে হিন্দুদেরই অপভ্রংশ রূপ মনে করত। এ কারণেই পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের নারীদের ‘গনিমতের মাল’ মনে করে ধর্ষণ করত, সকল মুসলিমের সম্পত্তি যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তি (গনিমত) হিসেবে লুট করত এবং এখানকার মানুষদের হত্যা করাকে জিহাদ মনে করত। পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাদেশে যুদ্ধ করা পাকিস্তানি সৈন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে তাদের ‘মুজাহিদ’ বলে সম্বোধন করত। পূর্ব বাংলার মানুষ হত্যা পুণ্যের কাজ বলে বিবেচনা করত তারা। হোক সে মুসলিম বা হিন্দু, তাদের কাছে বাংলার মুসলিম পরিচয় বড় কোনো বিষয় ছিল না। কারণ তারা নিম্নবর্গের মুসলিম!
কিন্তু যখন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেলাম, এই দেশে প্রথম আমরা নিজেদের আত্মপরিচয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারলাম। আমাদের ভেতরে জাত-পাতের সকল শৃঙ্খল আমরা ছিন্ন করতে পারলাম মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এই বাংলাদেশের সকল মানুষ আমরা একই রক্ত ও কৌলিন্যের ধারা। আমাদের মধ্যে কোনো আশরাফ-আতরাফ নেই। আমরা সুদীর্ঘ কালের সেই আর্য রক্ত আমাদের ধমনীতে বইছি, যা এই মাটির সঙ্গে ওতপ্রোভাবে জড়িয়ে আছে। আমরা এ মাটির সন্তান, আমরা কোনো অভিবাসী মুসলিম নই। এই মাটি থেকে উদ্গত হয়েছে আমাদের শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু। আমাদের পূর্বপুরুষদের উচ্চারিত কালেমা আমাদের উচ্চকিত করেছে মুসলিম হিসেবে। যেমন এই একই কালেমা মদিনার আনসারদের উচ্চকিত করেছিল আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে।
১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের মাধ্যমে আমরাও বিশ্বমঞ্চে ঘোষণা করতে পারলাম, সৌদি আরব আর আমরা একই মুসলিম দেশ। আরব-পাকিস্তান-মিশরের মুসলিমদের মতো আমরাও একই কালেমার মুসলিম। শত সহস্র বছর পর এই বাংলাদেশ আমাদের নতুন এক পরিচয় দিল। যে জাতি সহস্র বছরের ঔপনিবেশিকতার ফলে তাদের আত্মপরিচয় ভুলতে বসেছিল।
এ কারণেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় এত গৌরবের। শত সহস্র বছর ধরে আরব, আফগান, তুর্কি, পারসিক, ইংরেজ, পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি যেভাবে আমাদের আত্মপরিচয়কে তাদের আশরাফি মুসলমানিত্বের কৌলিন্য দিয়ে দাবিয়ে রেখেছিল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সেই আত্মপরিচয়কে আবার ছিনিয়ে এনেছে। তাই এ মুক্তিযুদ্ধ আমাদের আত্মপরিচয় অর্জনের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ আমাদের মুসলিম পরিচয়ের অন্যতম রক্ষাকবচ!
সবাইকে বাংলাদেশের ৫০তম বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
এনটি