আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: পূর্ব ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার মিলনস্থলে অবস্থিত মিশ্র সংস্কৃতির দেশ জর্জিয়া। ককেশাস অঞ্চলের এই দেশের পশ্চিমে কৃষ্ণ সাগর, উত্তর ও পূর্ব দিকে রাশিয়া, দক্ষিণে তুরস্ক ও আর্মেনিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আজারবাইজান অবস্থিত।
সুউচ্চ পাহাড় ও সমুদ্র তীরবর্তী উর্বর সমতলভূমির দেশ জর্জিয়ার মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৭০০ স্কয়ার কিলোমিটার। তিবলিসি দেশটির সর্ববৃহৎ শহর ও রাজধানী। মোট জনসংখ্যা চার মিলিয়ন। ২০১৪ সালে জনসংখ্যা জরিপ অনুসারে দেশটির জনসংখ্যার ১০.৭ শতাংশ মুসলিম।
জর্জিয়ায় ইসলামের আগমন জর্জিয়ায় ইসলামের আগমন ঘটে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে। যখন ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান (রা.)-এর যুগে জর্জিয়ার একাংশ মুসলিম শাসনাধীন হয়। ১১২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জর্জিয়ায় (একাংশে) মুসলিম শাসন অব্যাহত ছিল। দীর্ঘ ৫০০ বছরের শাসনকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
১. আমিরাত অব তিবলিসি: ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে তিবলিসি জয় করার পর থেকে ৭৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উমাইয়া খলিফাদের অধীনে জর্জিয়ান ভূমিতে প্রথম ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
২. আব্বাসীয় শাসন: ৭৩৬ থেকে ৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিবলিসি আব্বাসীয় খিলাফতের অধীন থাকে। এ সময় জর্জিয়ার সমগ্র পূর্বাঞ্চল মুসলিম শাসনাধীন হয়।
৩. সেলজুক শাসন: ৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে খ্রিস্টীয় এগারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্ব পর্যন্ত তিবলিসি সেলজুক সাম্রাজ্যের অধীন হয়। ফলে জর্জিয়ান ভূমি থেকে আরব শাসনের অবসান হয় এবং পারসিয়ান শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
১১২২ খ্রিস্টাব্দে জর্জিয়ার শাসক চতুর্থ কিং ডেভিড তিবলিসি জয় করেন। তবে মুসলিম শাসনামলে সমৃদ্ধ তিবলিসিকেই জর্জিয়ার রাজধানী ঘোষণা করেন।
মুসলিম শাসকদের উদারতা: দীর্ঘ ৫০০ বছর মুসলিমরা তিবলিসি শাসন করলেও স্থানীয় নাগরিকদের ওপর ইসলাম ধর্ম চাপিয়ে দেয়নি। প্রখ্যাত ফরাসি পর্যটক জে ডে টর্নফোর্ট ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে যখন তিবলিসি সফর করেন, তখন শহরের ২০ হাজার নাগরিকের মধ্যে ১৭ হাজার ছিল খ্রিস্টান এবং তিন হাজার ছিল মুসলিম।
জর্জিয়ায় ইসলামী শাসনের দ্বিতীয় অধ্যায়: খ্রিস্টীয় চৌদ্দ শতকের শুরুতে তুরস্কের উসমানীয় সাম্রাজ্য ও ইরানের সাফাভিদ সাম্রাজ্য ককেশাস অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণে অভিযান শুরু করে।
স্থানীয় খ্রিস্টান শাসকদের পরাজিত করে তারা জর্জিয়ার বৃহৎ অংশ জয় করে। পনেরো থেকে ষোলো শতক পর্যন্ত উসমানীয় ও সাফাভিদ সাম্রাজ্য জর্জিয়ার দুই অংশে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে উভয় সাম্রাজ্যের মধ্যে ‘আমাসিয়া চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়।
দুই শাসনের দুই ফল : জর্জিয়ায় সুন্নি উসমানীয় এবং শিয়া সাফাভিদ শাসনের ফলাফল ছিল দুই রকম। উসমানীয়রা জর্জিয়ার পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জনসাধারণের ভেতর ইসলাম প্রচারে মনোযোগী হয় এবং তাদের প্রচেষ্টায় প্রভাবশালী আজরা সম্প্রদায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। অন্যদিকে সাফাভিদরা পূর্বাঞ্চলের সমাজের উচ্চ শ্রেণির ভেতর ইসলাম প্রচারে মনোযোগী ছিল। তাদের প্রচেষ্টায় শাসক শ্রেণির অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁদের অন্যতম ছিলেন ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম গ্রহণ করা রাজা ষষ্ঠ ভাকতাং।
মুসলিম জর্জিয়ায় রুশ আগ্রাসন: রুশ-তুর্কি যুদ্ধ ১৮৭৭-১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের পর আজরা রুশ সাম্রাজ্যের অধীন হয়। বার্লিন চুক্তি ১৮৭৮ অনুসারে তুরস্ক তা রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দেয়। চুক্তি অনুসারে রাশিয়া অত্র অঞ্চলের মুসলিমদের সহায়-সম্পদ বিক্রি করে তুরস্কে চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়। ফলে বিপুলসংখ্যক মুসলিম দেশত্যাগ করে। একই সঙ্গে সেখানে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারণা শুরু হয়, যদিও কিছুসংখ্যক মুসলিম সেখানে থেকে যায়।
১৯২১ সালে জর্জিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত করার পর মুসলিমরা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে এবং তাদের ধর্ম পালনের সব ধরনের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়।
জর্জিয়ার মুসলিম অঞ্চলের মুসলিম জনসংখ্যা হ্রাস করতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লক্ষাধিক মুসলিমকে সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় শুধু অবিশ্বাস ও মিথ্যা ধারণা থেকে।
স্বাধীন জর্জিয়ায় মুসলমান: ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে জর্জিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন জর্জিয়ায় মুসলিমদের পথচলা মোটেই সহজ ছিল না। কেননা সোভিয়েত ইউনিয়নের সেক্যুলার শাসন ও ধর্মবিরোধী কঠোর মনোভব মুসলিম সমাজের ভিত নাজুক করে দিয়েছিল। তবু জর্জিয়ান মুসলিমরা ইউরোপের অন্য দেশগুলোর তুলনায় বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে। দিন দিন সেখানে মুসলিম জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে জর্জিয়ায় চার শতাধিক মসজিদ (সরকার স্বীকৃত) ও অর্ধশতাধিক ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, রেডিও ফ্রি ইউরোপ ও আলজাজিরা
-এটি