আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ‘ওমিক্রন’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার এই ভ্যারিয়েন্টটি অন্তত ৩২টি মিউটেশন (জিনগত গঠনের পরিবর্তন) ঘটিয়েছে - যার বৈজ্ঞানিক নাম বি.১.১.৫২৯।
ওমিক্রন নিয়ে বিজ্ঞানীরা যে কারণে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন তা হলো- এটি অত্যন্ত দ্রুত এবং সহজে ছড়াতে পারে এবং মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এড়াতে পারে - যার ফলে এর বিরুদ্ধে টিকা কম কার্যকর হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
করোনাভাইরাস যত সহজে ছড়াবে, ততই তাতে আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি হবে - আর এর ফলে কোভিড-১৯এ গুরুতর অসুস্থ হওয়া ও মৃত্যুর সংখ্যাও ততই বাড়তে থাকবে।
প্রাথমিক তথ্য প্রমাণে আরও দেখা গিয়েছে যে ওমিক্রনে পুনরায় সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি রয়েছে। অর্থাৎ যারা আগে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন - তাদের সাধারণত দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হবার দৃষ্টান্ত কম হলেও - ওমিক্রনের ক্ষেত্রে পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের টিকা নিয়েছেন। তারা এখন কতটা নিরাপদ - তা নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। ফাইজার, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্না, সিনোভ্যাক, স্পুটনিক - এসব টিকা ওমিক্রনের বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর হবে?
এগুলোই ওমিক্রন নিয়ে ভয়ের কারণ। বলা দরকার যে ভাইরাস সবসময়ই পরিবর্তিত হচ্ছে, প্রতিনিয়ত মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন রূপ নিচ্ছে।
চীনের উহান শহরে প্রথম যে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছিল, সেই ভাইরাস এখন আর নেই। ডেল্টা আর বেটা ভ্যারিয়েন্ট তাকে হটিয়ে দিয়েছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে মিউটেশন ছিল ১০টি আর বেটায় ৬টি। আর ওমিক্রনের ‘ইউনিক’ মিউটেশনের সংখ্যা এর অনেক বেশি - মোট ২৬টি। এতেই বোঝা যায় একে মোকাবিলা করা কত কঠিন হতে পারে।
‘ওমিক্রনের উপসর্গ অত্যন্ত মৃদু’
ওমিক্রন ভাইরাস প্রথম চিহ্নিত হয় গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণ আফ্রিকায়। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই এতে আক্রান্ত ব্যক্তি চিহ্নিত হয়েছে পৃথিবীর অন্তত ১১টি দেশে। এটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে যখন নানা দেশ নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করতে শুরু করেছে, তখন দক্ষিণ আফ্রিকার ডাক্তাররা বলছেন, এ পর্যন্ত ওমিক্রন নামের কোভিডের এই নতুন ধরনটির সংক্রমণে রোগীদের মধ্যে খুবই মৃদু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের প্রধান এ্যানজেলিক কোয়েৎজি বিবিসিকে বলেছেন, এ পর্যন্ত সেদেশে কেসের সংখ্যায় সামান্য বৃদ্ধি ঘটেছে - কিন্তু ওমিক্রনে আক্রান্তদের অধিকাংশেরই হাসপাতালে চিকিৎসা নেবার দরকার হয়নি। তিনি আরও বলেন, হয়তো এর লক্ষণ অত্যন্ত মৃদু বলেই এই নতুন ধরনটি এতদিন শনাক্ত হয়নি।
বিবিসিকে গতকাল রবিবার দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মিজ কোয়েৎজে বলেন, প্রথম যে আক্রান্ত ব্যক্তিকে পাই সে একজন পুরুষ, বয়স ছিল ৩০এর কোঠায়। এবং সে দু’দিন ধরে প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করার কথা বলছিল।
‘তার সাথে গায়ে ব্যথা, মাথাব্যথা। তবে কোন কাশি ছিল না বা স্বাদ-গন্ধ হারিয়ে ফেলাও ছিল না। এরকম লক্ষণ আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হওয়াতে আমি তার টেস্ট করাই। তাতে সে এবং তার পরিবারের সবাই পজিটিভ ধরা পড়লেও পরিবারের অন্যরা ভালো ছিল। সেজন্যই আমি বলছি মৃদু উপসর্গ।’
‘এরপর একদিনে আমি আরও কয়েকজন রোগী দেখি। তারাও সবাই পজিটিভ ছিল। এর পরই আমি টিকা সংক্রান্ত সরকারি কমিটিকে সতর্ক করি, যার সদস্য আমি নিজেও। আমরা দক্ষিণ আফ্রিকায় যা দেখছি তা হলো সংক্রমিত সবারই লক্ষণ আমাদের বিবেচনায় অত্যন্ত মৃদু। আমরা কাউকেই হাসপাতালে ভর্তি করাইনি। আমি অন্য একজন সহযোগী ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি। তিনিও একই চিত্র তুলে ধরেছেন।’
মিজ কোয়েৎজি অবশ্য বলছেন, যদিও এ পর্যন্ত ওমিক্রন আক্রান্তদের উপসর্গ খুবই মৃদু বলে দেখা যাচ্ছে - কিন্তু দু সপ্তাহ পর হয়তো এ চিত্রটা বদলে যেতে পারে।
ওমিক্রন বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশের পরপরই বিভিন্ন দেশ তড়িঘড়ি করে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। দক্ষিণ আফ্রিকার নেতারা এর সমালোচনা করেছেন। তারা অভিযোগ করছেন যে, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি আবিষ্কার করার জন্য, দক্ষিণ আফ্রিকাকে সাধুবাদ দেয়ার পরিবর্তে তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে।
ওমিক্রন কতটা মারাত্মক সে চিত্রটা এখনো স্পষ্ট নয়
দক্ষিণ আফ্রিকার আরও কয়েকজন চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলে মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট জানাচ্ছে - ওমিক্রনে ঠিক কতটা গুরুতর অসুস্থতা দেখা দিতে পারে সে চিত্রটা এখনো পরিষ্কার নয়।
একজন ডাক্তার জানাচ্ছেন, প্রথমদিকে আক্রান্তদের লক্ষণ ছিল মৃদু। আরেকজন ডাক্তার বলেছেন, তিনি তরুণ-বয়স্ক কিছু রোগী দেখেছেন যাদের মাঝারি থেকে গুরুতর অসুস্থতা দেখা দিয়েছিল।
আফ্রিকা হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউটির ফ্যাকাল্টি সদস্য অ্যালেক্স সিগাল ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, এখনই কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোটা ভুল হবে, তবে বলা যায় যে আমরা আগে যা দেখেছি, এটা তার চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন বলে মনে হচ্ছে না। এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু করবে এমন কোন ইঙ্গিত এখনো নেই।
বৈশ্বিক ঝুঁকি অত্যন্ত উঁচু
বাস্তবতা হচ্ছে - ওমিক্রন কতটা মারাত্মক রূপ নিতে পারে - এ সম্পর্কে এখনো খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, তারা যেসব পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন তার ফলাফল পেতে আরও দুই-তিন সপ্তাহ লাগবে।
এর মধ্যে প্রতিদিনই নতুন নতুন দেশে ওমিক্রন-আক্রান্ত ব্যক্তি খুঁজে পাবার খবর বেরুচ্ছে। বিভিন্ন দেশ - যারা করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বিধিনিষেধ শিথিল করেছিল, বা করতে যাচ্ছিল - তারা এখন নতুন করে বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, মাস্ক পরা ও জনসমাগম নিরুৎসাহিত করতে নানা নির্দেশ কার্যকর করছে।
এসব দেশের সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন, ওমিক্রন কতটা বিপজ্জনক হতে পারে সম্পর্কে আরও তথ্য জানার জন্য তারা আগেভাগে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে সময় নিচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোববার দেয়া তাদের বিবৃতিতে স্পষ্ট করেই বলেছে, ওমিক্রনের সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি অত্যন্ত উচ্চ।
‘টিকা অন্তত কিছুটা কার্যকর হবে’
দক্ষিণ আফ্রিকায় এ পর্যন্ত সীমিত নমুনার ভিত্তিতে ডাক্তাররা দেখেছেন যে ‘ব্রেক-থ্রু ইনফেকশন’ - অর্থাৎ যারা ইতোমধ্যেই টিকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে ওমিক্রন আক্রান্ত হবার হার - বেশি বলে দেখা গেছে।
তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং কোভিড সংক্রান্ত সরকারি উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ইয়ান সানে বলছেন, প্রাথমিক উপাত্তে ভ্যাকসিন এখনো কার্যকর বলেই দেখা যাচ্ছে - কারণ যারা হাসপাতালে আছেন, তাদের অধিকাংশই টিকা না-নেয়া রোগী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওমিক্রনের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমে গেলেও টিকা যে পুরোপুরি অকার্যকর হবে তা নয় - খানিকটা কার্যকারিতা অক্ষুণ্ণ থাকবে। তাই তারা বলছেন, ওমিক্রনের বিস্তার ঠেকাতে টিকা নেয়া, মাস্ক পরা, এগুলোই সবচেয়ে ভালো উপায়। সূত্র: বিবিসি বাংলা
-কেএল