ইশতিয়াক মু. আল-আমিন: আল্লাহ তায়ালা বার্তাবাহক হিসেবে পৃথিবীতে যুগে যুগে অসংখ্য নবী রাসুল পাঠিয়েছেন। সে ধারাবাহিকতায় হেদায়েতের সর্বশেষ মশাল নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)। তাঁর ওফাতের মাধ্যমে নবুওতের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে।
দুনিয়াতে আর কোনো নবী-রাসুল আসবেন না। তবে নবীজির রেখে যাওয়া সেই ‘নবুওতি দায়িত্ব’ পালন করবেন আলেম-ওলামাগণ। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে ওলামায়ে কেরাম হচ্ছেন নবীগণের উত্তরাধিকারী। আর নবীগণ দিনার ও দেরহামের উত্তরাধিকারী বানান না।তারা ইলম ও জ্ঞানের উত্তরাধিকারী বানান।’ (আবু দাউদ : ৩৬৪১)
যাদের নবুওতের ইলম দেওয়া হয় তাদের মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যারা জ্ঞানপ্রাপ্ত, আল্লাহ তাদের উচ্চ মর্যাদা প্রদান করেন।’ (সুরা মুজাদালা : ১১) আলেমরাই হচ্ছেন পৃথিবীর সর্বোত্তম মানুষ। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে নিজে কোরআন শিখে এবং অন্যকে তা শিখায়।’ (তিরমিজি : ২৯০৭)
ওলামায়ে কেরাম হচ্ছেন পৃথিবীর বুকে হেদায়েতের বাতিস্বরূপ। এই হেদায়েতের বাতি যে দিন নিভে যাবে, সে দিন পৃথিবী অজ্ঞতার আঁধারে নিমজ্জিত হয়ে যাবে।
এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ওলামাদের দৃষ্টান্ত ওইসব তারকার মতো যাদের দ্বারা স্থলে ও জলের অন্ধকারে পথের দিশা পাওয়া যায়। আর যখন তারকাসমূহ আলোহীন হয়ে যায় তখন পথচারীর পথ হারাবার সম্ভবনা থাকে।’ (মুসনাদে আহমদ : ৩/১৫৭)।
অর্থাৎ ওলামায়ে কেরাম পৃথিবীতে না থাকলে মানুষের পথভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। সুতরাং আলেমরা হচ্ছেন উম্মতের হেদায়েতের আলোকবর্তিকা।
একজন আলেমের মৃত্যু উম্মতের জন্য ধ্বংসের কারণ। কেননা একজন আলেমের মৃত্যুতে উম্মতের জন্য যতোটা দ্বীনি ব্যাপারে ক্ষতি হয় একটি গোত্রের সব মানুষ মৃত্যুবরণ করলেও সেই ক্ষতি হয় না।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আলেমদের মৃত্যু এমন মুসিবত যার প্রতিকার নেই এবং এমন ক্ষতি যা পূরণ হয় না। আর আলেম এমন এক তারকা যে (তার মৃত্যুর কারণে যেন পৃথিবী) আলোহীন হয়ে যায়। একজন আলেমের মৃত্যু অপেক্ষা একটি গোত্রের মৃত্যু অতি নগন্য।’ (বায়হাকি : ২/২৬৪)
সুতরাং আলেমরা দুনিয়াতে না থাকলে ইলমও দুনিয়াতে থাকবে না। কেননা আলেমদের দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া থেকে ইলেম উঠিয়ে নেন। আর ইলেম যদি দুনিয়াতে না থাকে তাহলে মানুষ হেদায়েতের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গোমরাহের দিকে ধাবিত হয়।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা (শেষ জামানায়) ইলেমকে এভাবে উঠিয়ে নেবেন না যে, লোকদের অন্তর থেকে সম্পূর্ণ বের করে নেবেন বরং তিনি ইলমকে এভাবে উঠিয়ে নেবেন যে, এক এক করে ওলামায়ে কেরামদের উঠিয়ে নেবেন। আর যখন কোনো আলেম দুনিয়াতে অবশিষ্ট থাকবে না তখন লোকেরা ওলামাদের পরিবর্তে অজ্ঞ ও মূর্খ ব্যক্তিদের নেতা বানিয়ে নেবে।’ (বুখারি : ১০০)
বর্তমানে না জানার কারণে আলেমদের অনেক সময় অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা হয়। অথচ আলেমদের সম্মান আল্লাহর কাছে এত বেশি, আসমান ও দুনিয়ার সব মাখলুক আলেমদের জন্য দোয়া-মাগফেরাত কামনা করতে থাকে।
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আলেমদের ওপর স্বয়ং আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ এবং আসমান ও জমিনের সব মাখলুক এমনকি পিঁপড়া আপন আপন গর্তে এবং মাছ পানির ভেতর আপন আপন পদ্ধতিতে রহমতের জন্য সর্বদা দোয়া করতে থাকে।’ (তিরমিজি : ২৬৮৫)
খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দেশের প্রতিশযথা একাধিক আলেম ইনতেকাল করেছেন যা জাতির জাতির জন্য দুর্ভোগের কারণ হতে পারে। তাদের স্থান পূরণ করার মতো যোগ্য আলেম তৈরি হতে অনেক সময় দরকার।
গতকাল ৩০ নভেম্বর ইনতেকাল করেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা নূরুল ইসলাম জিহাদী ।
গত শনিবার রাত ৯টার দিকে অসুস্থ হয়ে পড়লে আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। গতকাল বাদ এশা বাইতুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে তাঁর জানাযার সালাত অনুষ্ঠিত হয়। হয়। তার মৃত্যুতে এদেশের ইসলামী অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে।
আল্লামা জেহাদী হেফাজতের মহাসচিব হলেও সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে তাঁর গ্রহনযোগ্যতা ছিল আকাশচুম্বী। দায়িত্ব পাওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি হেফজতকে মূল লক্ষ্যে ফিরিয়ে আনা,অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করণ ও রাজনীতিমুক্ত হেফাজত গড়ার জন্য কাজ শুরু করেছিলেন।
১৯৮৪ সালের ১০ জুলাই তিনি ঢাকা জেলার অন্তর্গত খিলগাঁও-এ আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া মাখজানুল উলুম প্রতিষ্ঠা করেন। অদ্যাবধি তিনি এই মাদরাসার মহাপরিচালক ও শায়খুল হাদিস হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। পাশাপাশি তিনি দারুল উলুম হাটহাজারীর মজলিসে শূরা এবং বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা ও আমেলার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
১৯৭৮ সালে ইসলাম বিদ্বেষীদের প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে তিনি “ইসলামী আন্দোলন পরিষদ” নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার করেছিলেন। কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলন ও খতমে নবুয়ত আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত বাংলাদেশ’র মহাসচিব হন তিনি।পরে ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব নির্বাচিত হন।
শুধু ২০২০ সালেই আমরা হেফাজাতে ইসলামের আমীর আল্লামা আহমদ শীফ সহ প্রায় অর্ধ ডজন প্রখ্যাত আলেমদের হারিয়েছি। যাদের মধ্যে রয়েছেন- আল্লামা নূর হোসেন কাসেমী, তাফাজ্জল হক হবিগিঞ্জি, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জিরি মাদরাসার মহাপরিচালক, সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমে দ্বীন আল্লামা শাহ মুহাম্মদ তৈয়ব দা. বা., বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া’র (বেফাক) সহ-সভাপতি আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ, চট্টগ্রাম নাজিরহাট বড় মাদ্রাসার মহাপরিচালক আল্লামা ইদ্রিস সাহেব,আল্লামা জুনায়ের আনসারী, আল্লামা গোলাম সরোয়ার সাঈদী সহ অনেককে।
এছাড়াও গত একযুগের মধ্যে বাইতুল মোকররমের খতিব আল্লামা ওবায়দুল হক , খেলাফত মজলিশের আমীর শাইখুল হাদিস আল্লামা আযিযুল হক , চরমোনাইর প্রয়াত পীর ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করিম, ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের চেয়ারম্যানমুফতি ফজলুল হক আমিনী , মালিবাগ জামিয়া শারিয়ার প্রিন্সিপ্যাল মুফতি কাজী মুতাছিম বিল্লাহ, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের (বেফাক) সিনিয়র সহ-সভাপতি, জামিয়া শারঈয়্যাহ মালিবাগের প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিস আল্লামা আশ্রাফ আলী সহ অনেকেই ইনতিকাল করেন ।
এসকল ওলামাদের স্থান কখনোই পুরণ হবার মতো নয়। আল্লাহ তা’য়ালা এসব আলেমদে শূণ্যস্থান পূরণকরার জন্য যোগ্য ও তাকওয়াবান আলেম আলেম পদয়া করে দিন । আমীন!
-কেএল