নুরুদ্দীন তাসলিম।।
'এতদিন মাদরাসায় কষ্ট করে পড়াশোনা করে যদি ব্যবসা করতে হয়, তাহলে এই পড়াশোনার কোনো দরকার নেই' সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে হাফেজ নাজমুস সাকিবের ৭ মিনিটের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ভিডিও‘র শুরুতেই তাকে এ কথাটি বলতে শোনা যায়।
নববী সুন্নত ব্যবসাকে নিয়ে এক সময়ের বিশ্বজয়ী হাফেজ নাজমুস সাকিবের মুখে এমন মন্তব্য বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে সচেতন মহলে। বিষয়টি নিয়ে হাফেজ নাজমুস সাকিবকে এক রকম তোপ দেগেছেন নেট নাগরিকরা।
আলেম ব্যবসায়ীদের নিয়ে এমন ‘নেতিবাচক’ মন্তব্য ছাড়াও আলোচনায় এসেছে কুরআন হাদিস সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান না রেখেই বয়ানের স্টেজে বক্তা হিসেবে মাহফিল কর্তৃপক্ষ কাদের উঠিয়ে দিচ্ছেন মানুষের নসিহতের জন্য।
তোপের মুখে হাফেজ নাজমুস সাকিব
এ নিয়ে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আলেম মাওলানা সাইমুম সাদী তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন; ‘আলেমদেরকে বক্তা বানান, বক্তাদেরকে আলেম বানান’।
মুফতি জিলানি নামে একজনকে উদ্ধৃত করে তরুণ লেখক ও অনুবাদক আবদুল্লাহ আল ফারুক লিখেছেন; ‘কুরআন তিলাওয়াত আর হিফযকে যারা ব্যবসায় পরিণত করছে, সংগীতের নামে যা চলছে, এ অধপতন রোধ করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে আমরা নীতি-আদর্শহীন এক প্রজন্ম দেখতে পাবো’।
আরবি ভাষা শিক্ষক মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী লিখেছেন; ‘হিফজ বিভাগ, মাদরাসার কর্তৃপক্ষ, ওয়াজ কমিটির ভাইদের দৃষ্টিআকর্ষণ করছি, আপনারা ছোট ছোট অল্পবয়সী এসব রেকর্ড করা হাফেজ, ক্বারী ও সংগীতশিল্পীদের দাওয়াত দেওয়া বন্ধ করুন। এদেরকে ওয়াজের ময়দানে বয়কট করুন। এসব দেখিয়ে যে সুখ আপনারা ভোগ করেন তা বাদ দিন। অতিলোভ সংবরণ করুন।এদের মাধ্যমে দ্বীনের যে ক্ষতি হচ্ছে তার জন্য মূলত আপনারাই দায়ী। এর জন্য একদিন আল্লাহর সামনে দাড়াতে হবে’।
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জাব্বার তার দীর্ঘ স্ট্যাটসে লিখেছেন;... নাজমুস সাকিব বারিধারা মাদরাসার রানিং ছাত্র৷ বাজী রহ: জীবিত থাকতেও তিনি বারিধারার ছাত্র ছিলেন৷ তখনো প্রোগ্রামে যেতেন৷ কিন্তু কাসেমী সাব (রহ:) বলে দিয়েছিলেন "তুই শুধু তিলাওয়াত করবি, এর বাহিরে কিছু বলবি না, তোর কিছু বলার মতো বয়স হয়নি" যতো দিন বাজী জীবিত ছিলেন নাজমুস সাকিবের কোনো সমালোচনার সাইট আমার সামনে আসেনি৷ একবছরের ব্যাবধানে পার্থক্যটা আজ সকলের সামনে উপস্থিত৷ আজ একজন সচেতন যোগ্য রাহবারকে হারিয়ে ভিন্ন রকম হয়ে যাচ্ছে তার সম্ভবনাময়ী এক উজ্জ্বল ভবিষ্যত৷
প্রিয় নাজমুস সাকিবের প্রতি বিনীত পরামর্শ থাকবে আপনি কোনো মুরুব্বীর দিক নির্দেশনায় চলুন৷ তিনি বয়ান থেকে বিরত থাকতে বললে আপাতত বিরত থাকুন৷ তিনি বয়ানের পরামর্শ দিলে তার পরামর্শ মেনে চলুন৷ একজন মুরুব্বী আপনার জন্য কতোটা প্রয়োজন তা হয়তো আপনি পুর্বের অবস্থা ও বর্তমান পরিস্থিতি থেকে কিছুটা অনুধাবন করতে পেরেছেন৷
মাওলানা জিয়াউর রহমান নামে একজন তার দীর্ঘ স্ট্যাটসে লিখেছেন; সন্তানকে আন্তর্জাতিক হাফিয বানাবেন? নাকি উম্মতের জন্য নিবেদিতপ্রাণ আন্তর্জাতিক আলিম বানাবেন? সেই সিদ্ধান্ত অভিভাবকদেরই নিতে হয়৷ তবে উস্তায কর্তৃক অভিভাবককে সেই স্বপ্ন দেখাতে হবে৷ উস্তায আর অভিভাবক মিলে যদি সন্তানকে দিয়ে শুধু টাকার স্বপ্ন দেখেন, তাহলে তো সন্তানের ভবিষ্যত নষ্ট হবেই৷
সারা দেশে এমন কিছু হিফজখানা আছে, যারা সচেতনভাবেই তাদের ছাত্রদের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখেন৷ যদিও তাদের পড়াশোনার মান অনেক ভালো৷ ছাত্রদের ব্যাপারে তাদের দূরদর্শিতা ও তারবিয়াতি ফিকিরের উপর শুধুই মুগ্ধতা৷
যারা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পেয়েছে, তাদের সবাই লাইনচ্যুত হয় না৷ দরকার উস্তায এবং অভিভাবকদের সমন্বিত গাইডলাইন, নির্লোভ থাকা ও সন্তানকে নিয়ে উঁচু ফিকির৷ সেই ফিকির দেওয়ার জন্য আগে অভিভাবক ও শিক্ষকদের তারবিয়াত দরকার৷(কথাগুলো তাদের জন্য যারা সন্তানকে মাদরাসায় ভর্তি করেছেন বা করতে চান৷)
তরুণ লেখক ও অনুবাদক আবদুল্লাহ আল ফারুকের পোস্টের কমেন্টে আরেক তরুণ লেখক ইমরান রায়হান লিখেছেন; ‘সমস্যাটা আরো গভীরে চলে যাচ্ছে। অনেক হিফজখানা ও মাদরাসার উস্তাদরাই ছাত্রদের সামনে এদের মডেল বানায়ে এদের মত টাকা কামানোর স্বপ্ন ধরিয়ে দেয়৷ আমার কয়েক আত্মীয়ের ক্ষেত্রেই এটা হতে দেখেছি’৷
জুবায়ের মাহমুদ নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘হাল জমানার নয়া মোটিভেশনাল বক্তা সোনায়মাল সুখনের ইসলামিক ভার্সন। টয়লেটে গিয়া কুরআন পড়া জাহেলের আবির্ভাব‘।
ভাইরাল বক্তব্যের বিষয়ে যা বলছেন হাফেজ নাজমুস সাকিব
হাফেজ নাজমুস সাকিব। যার ভাইরাল বক্তব্যে তোলপাড় নেট মাধ্যম। বর্তমানে তিনি বারিধারা মাদরাসার জালালাইন জামাতে অধ্যায়নরত।
এ বিষয়ে আওয়ার ইসলামের পক্ষ থেকে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেছেন, ভাইরাল বক্তব্যটি কোন ওয়াজ কিংবা মাহফিলের স্টেজের ছিল না, প্রায় ৬ মাস আগে একটি মাদরাসার ঘরোয়া মজলিসে মশকের সময় দেওয়া হয়েছিল। পুরো ভিডিওটি ২৯ মিনিটের ছিল; সেখান থেকে কাট করে ৭ মিনিটের ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল করা হয়েছে।
‘যে মাদরাসায় মশক করানোর জন্য গিয়েছিলেন, সেই মাদরাসা শিক্ষকের পক্ষ থেকে অনুরোধ ছিল; যেন ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলেন তিনি। মাদরাসাটি শরহে বেকায়া পর্যন্ত ছিল; সেখানে উপস্থিত নিজের থেকে অল্প বয়স্ক ও ছোট ছাত্রদের উদ্দেশ্যে তাই নাজমুস সাকিব কিছু কথা বলেছিলেন’ বলেন তিনি।
নাজমুস সাকিবের ভাষ্য অনুযায়ী; ‘মূলত তিনি ছাত্রদের বলেছেন, যারা আজ এখানে পড়াশোনা করছে তারা হয়তোবা ফারেগ হয়ে আলেম হতে হতে ২০৩০ অথবা ৩৫ সাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তখন আধুনিকতার সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে গেলে আরো অনেক বেশি যোগ্যতার প্রয়োজন হবে। যোগ্যতা অর্জন করে যেন ভালো কোন প্লাটফর্মে শিক্ষার্থীরা পৌছাতে পারেন। অল্প অঅয়ের কিছুতে তাদের যুক্ত হতে না হয়’- এই কথাই বলা উদ্দেশ্য ছিল তার। ‘এখানে ভিডিওটি কাট করে তার উদ্দেশ্যকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছে’।
অবচেতন মনে নাজমুস সাকিবের বক্তব্যে আলেমদের ব্যবসা সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য চলে এসেছে বলে তিনি মনে করেন কিনা?
‘আমার উদ্দেশ্য মোটেও এমন কিছু ছিল না। ‘আমি নিজেও ব্যবসার সাথে জড়িত, আমি ব্যবসাকে কিভাবে ছোট করে দেখব’ - বলেন তিনি।
‘নাজমুস সাকিবকে বিতর্কিত করার চেষ্টা’!
আওয়ার ইসলামের সাথে আলাপচারিতায় তিনি আরো বলেছেন, ‘তার সাথে কোনো ধরনের বিরূপ মনোভাবের জেরে হয়তোবা কেউ এই ভিডিও ভাইরাল করে তাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছেন’।
ভিডিওতে ‘ওয়াশরুমে’ কোরআন শরীফ তেলাওয়াতের কথা রয়েছে- এ প্রসঙ্গে নাজমুস সাকিব বলেন, ‘অনেকেই আমার কাছে আমার জীবন সম্পর্কে জানতে চান, মানুষের আগ্রহ থেকেই আমি নিজের জীবনের ঘটনা বলেছি। এখানে আমি তেলাওয়াতের কথা বলিনি; মূলত ওয়াশরুমে মনে মনে আয়াত পাঠ করার বিষয়টি বলেছি’।
নিজের ব্যক্তিগত রুটিনে ‘ওয়াশরুমে’ তেলাওয়াতের বিষয়টি এভাবে সবার সামনে বলা কতটা যুক্তিযুক্ত?
নাজমুস সাকিব বলেছেন , ‘এবিষয়টি অবচেতন মনে তিনি ভুলে বলে ফেলেছেন। আসলে এটা ঠিক হয়নি তা তিনি পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছেন’।
ভাইরাল বক্তব্যের বিষয়ে যা বলছে বারিধারা মাদরাসা কর্তৃপক্ষ
নাজমুস সাকিবের ভাইরাল বক্তব্যের বিষয়ে বারিধারা মাদরাসার নাজেমে তা'লীমাত মুফতি মকবুল হোসাইন কাসেমীর সাথে যোগাযোগ করেছিল আওয়ার ইসলাম।
তিনি বলেছেন, ভাইরাল ভিডিওতে যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে নাজমুস সাকিবে বক্তব্য, বক্তব্য অনুযায়ী জ্ঞানের পরিপক্কতা না থাকার কারণে নাজমুস সাকিব যদি সত্যিই আলেমদের ব্যবসার বিষয়টিকে ছোট করে দেখে থাকে; তাহলে এটি তার পক্ষ থেকে ভুল হয়েছে। কারণ আমাদের আকাবিরদের অনেকেই নববী সুন্নত ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। তারা পরবর্তী প্রজন্মকে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধও করেছেন।
মুফতি মকবুল হোসাইন আরো বলেছেন, যেহেতু পরবর্তীতে নাজমুস সাকিবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বিষয়টিকে সে এক ভাবে বলতে চেয়েছে; উপস্থাপিত হয়েছে ভিন্নভাবে, তাই বক্তার বক্তব্যের ক্ষেত্রে তাকে ব্যাখ্যার সুযোগ দেওয়া যেতে পরে এবং এ বিষয়ে তার পরবর্তী বক্তব্য গ্রহণ করা যেতে পারে।
মুফতি মকবুল হোসাইন ছাত্রদের উদ্দেশ্যে আরো বলেছেন, তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে বর্তমানে শিক্ষার্থীরা এমন অনেক কিছুর সাথে জড়িয়ে পড়ছে যা তাদের পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। আমল-আখলাক ও তারবিয়াতী বিষয়গুলোতে বর্তমান ছাত্রদের একেবারে গুরুত্ব নেই।তাই ছাত্রদের এ বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এটি