নুরুদ্দীন তাসলিম।।
বেফাক ও হাইয়াতুল উলইয়ার অধীনে দেশের কওমী মাদ্রাসাগুলো দরসে নেজামির যেই সিলেবাসের অধীনে পরিচালিত হয়, এতে দাওরায়ে হাদিসে শিক্ষার্থীরা এক বছর সময় পেয়ে থাকেন। বিগত কয়েক বছরে দাওরায়ে হাদিসকে এক বছর থেকে দুই বছরের সিলেবাসে পরিণত করার দাবি উঠেছে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা মহল থেকে। ছাত্রদের যোগ্যতা, সময় সংক্ষিপ্ততায় বছরের শেষ দিকে সিলেবাস নিয়ে টানাপোড়েন-সহ বিভিন্ন দিক বিবেচনায় বেফাক ও হাইয়াতুল উলইয়ার নিজস্ব এজেন্ডার মধ্যেও রয়েছে দাওরায়ে হাদীসকে দুই বছরের সিলেবাসে উপনীত করার বিষয়টি।
ইলমে দ্বীনের ধারক বাহক একজন আলেমের জন্য যোগ্যতা ও বুৎপত্তির বিষয়টিতে কোন আপস নেই। যোগ্যতা অর্জন ছাড়া শরীয়তের সঠিক সমাধান দেওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়।
একজন শিক্ষার্থীকে পূর্ণ যোগ্য করে তুলতে কওমী মাদরাসায় যতটা না ক্লাসের উপর গুরুত্ব রয়েছে এর থেকেও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, ক্লাস পরবর্তী তাকরার, উস্তাদের নেগরানীতে মাদরাসাভিত্তিক আবাসিক পরিবেশে একাগ্রতার সাথে পড়াশোনাতে।
কওমি মাদরাসাগুলোতে রমজান, কোরবানি, পরীক্ষা মিলিয়ে বছরে ১২ মাসের মধ্যে প্রায় পাঁচ মাসের মতো ছুটি থাকে। বাকি সাত মাস ক্লাস চলে। এতে করে আবাসিক পরিবেশের মধ্যে বছরে প্রায় ২২০ দিনের মতো সরাসরি শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার সাথে দীক্ষা গ্রহণের সুযোগ পান কওমী শিক্ষার্থীরা।
পড়াশোনার আবাসিক পরিবেশ, শিক্ষকের নেগরানী, সহপাঠীর সাথে পড়াশোনা নিয়ে বিভিন্ন বাক্য বিনিময়- এসবের পরেও স্বাভাবিক নিয়মেই অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যোগ্য হয়ে ওঠার বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
সপ্তাহে দু'দিন তিন ঘণ্টা করে দাওরার ক্লাস!
সম্প্রতি দুই বছর মেয়াদী দাওরায়ে হাদিস শর্ট কোর্স শিরোনামে একটি লিফলেট ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। কিশোরগঞ্জের আলহাজ্ব শামসুদ্দিন ভূঁইয়া জামিয়া ইসলামিয়া বড় বাজার মাদ্রাসার অধীনে এই কোর্সটি পরিচালনা হবে বলে জানা গেছে। এতে দাখিল ফলপ্রার্থী, আলিম, ফাযিল ও কামিল পড়ুয়া শিক্ষার্থী, হাফেজ আরবি পারদর্শীদের জন্য দাওরা হাদিস পড়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এই কোর্সের অধীনে পুরুষ ও মহিলা শাখায় সপ্তাহে দু'দিন তিন ঘণ্টা করে ক্লাস হবে। এছাড়া কোর্সের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে বলা হয়েছে কওমি মাদ্রাসা বেফাক বোর্ড ও হায়াতুল উলইয়ার সনদ প্রদানের কথা।
দেশে দরসে নিজামীর অধীনে পরিচালিত কওমী মাদ্রাসাগুলোতে দাওরা হাদিসের শিক্ষার্থীদের দেখা যায় ফজরের পর থেকে প্রায় রাত এগারোটা কোন কোন জায়গায় বারোটা পর্যন্ত ক্লাস করতে। এরপরও বছর শেষে সিলেবাস নিয়ে বেশ টানাপোড়েনে পড়তে দেখা যায় শিক্ষকদের। সেখানে দাওরা হাদিসের শর্ট কোর্সে ৩ ঘন্টা করে সপ্তাহে মাত্র দুই দিন ক্লাস। এতে শিক্ষার্থীদের যোগ্য হয়ে ওঠার বিষয়টির সাথে শিক্ষার মান কতটা রক্ষা হবে এ নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনা চলছে অনলাইন অফলাইনে।
কেউ কেউ একে তামাশা বলেও উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে বেফাক, হাইয়াতুল উলইয়ার দৃষ্টি আকর্ষণও করেছেন।
দেশের প্রচলিত ধারার কওমি মাদরাসাগুলোতে দাওরা হাদিসের ক্লাস চালু রয়েছে; এর বিপরীতে গিয়ে এই কোর্সের আয়োজন কেন/ এ বিষয়ে জানতে আওয়ার ইসলামের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে কোর্সের পরিচালক মুফতি কামাল হোসাইন ফরায়েজীর সাথে।
তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘আলিয়া মাদ্রাসায় পড়েছেন এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছেন যারা কওমি অঙ্গনেও নিজেদের সাক্ষরতা রাখতে চান এমন শিক্ষার্থীদের জন্য এই কোর্সের ব্যবস্থা’।
তিনি আরো যুক্ত করেন, ‘হেফজ শেষ করেছেন, আলিয়ায় পড়েছেন, বর্তমানে ইমামতি করছেন, পুরোপুরি মাদ্রাসায় সময় দেওয়ার সুযোগ নেই এমন শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে এই কোর্সের আয়োজন’।
‘এই কোর্স কওমী শিক্ষার্থীদের জন্য না’- তিনি এই কথা বুঝাতে চেয়েছেন কিনা অথবা এই কোর্সকে সার্টিফিকেট কেন্দ্রিক বলা যায় কিনা ? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের যোগ্যতা রয়েছে তাদের জন্য এই কোর্সে ভর্তির সুযোগ রয়েছে। তবে এই কোর্স সার্টিফিকেট কেন্দ্রিক- তা বলতে নারাজ তিনি।
‘দ্বীনের পথে আসতে আগ্রহী এমন কিছু মানুষের সহযোগিতা করতে এই কোর্সের আয়োজন’ বলতে চেয়েছেন তিনি।
বর্তমানে বেফাক ও হাইয়াতুল উলইয়ার নিয়ম অনুযায়ী মেশকাতের সার্টিফিকেট না থাকলে হাইয়াতুল উলইয়ার অধীনে দাওরা পরীক্ষা দেওয়ার কোন সুযোগ নেই, এই কোর্সের অধীনে পড়ুয়ারা মেশকাতের সার্টিফিকেট ছাড়াই কীভাবে দাওরা পরীক্ষা দেবেন?
মুফতি কামাল হোসাইন ফরায়েজী বলেছেন, কোর্সের লিফলেটে দুই বছর মেয়াদী দাওরা হাদিসের কথা লেখা থাকলেও এক বছর মেশকাত পড়ানো হবে।
কোর্সের লিফলেটে কোথাও মেশকাত পড়ানো হবে এমন কোনো কথা উল্লেখ নেই কেন?
তিনি বলছেন, লিফলেট থেকেই সব বুঝে নেওয়া যায় না।
এতে শিক্ষার্থীর যোগ্যতার বিষয়টি কতটা রক্ষা হবে এমন প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন কোর্সের এই পরিচালক।
বেফাক ও হাইয়াতুল উলইয়ার দায়িত্বশীলরা কি বলছেন এ বিষয়ে?
এ বিষয়ে বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মাওলানা জুবায়ের আহমদ আওয়ার ইসলামকে বলেছেন, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কোর্সে যেভাবে অনেকের পড়াশোনা করার সুযোগ থাকে কোর্সের লিফলেটের বর্ণনা দেখে বিষয়টিকে অনেকটা এমনই মনে হয়েছে।
লিফলেটের বর্ণনা অনুযায়ী এখানে আলিয়া শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দেওয়া হবে।
তবে এখানে হাফেজ ও আরবী ভাষায় পারদর্শীদের দাওরায় পড়ানোর সুযোগের কথা বলা হয়েছে- এ প্রসঙ্গে বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, হেফেজ শেষ করে আরবি ভাষায় পারদর্শী হওয়া এবং দাওরায়ে হাদীস পড়ার যোগ্য হয়ে ওঠা কিভাবে সম্ভব? এটি একটি বড় প্রশ্ন।
‘সব মিলিয়ে এই কোর্স একটি ব্যবসায়ী উদ্যোগ বলে মনে হচ্ছে, শিক্ষামূলক কোন কার্যক্রমের অধীনে এই কোর্সের আয়োজন করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না' আওয়ার ইসলামকে বলছিলেন তিনি।
শিক্ষায় ব্যবসায়িক মনোভাবের কারণে শিক্ষা কার্যক্রমই ক্ষতিগ্রস্থ হবে- বলেন তিনি।
বেফাক এবং হাইয়াতুল উলইয়ার অবস্থান বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের নীতিমালায় রয়েছে হাইয়াতুল উলইয়ার পরীক্ষা দিতে চাইলে অবশ্যই শিক্ষার্থীর জন্য মেশকাতের সার্টিফিকেট দেখানো আবশ্যক তাই মেশকাতের সার্টিফিকেট ছাড়া হাইয়াতুল উলইয়ার পরীক্ষার অধীনে কোনোভাবেই আসতে পারবে না এই কোর্সের শিক্ষার্থীরা’।
এদিকে হাইয়াতুল উলিয়া সদস্য ও জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের মহাসচিব মুফতি মোহাম্মদ আলী বলেছেন, ‘পড়াশোনা কিংবা সার্টিফিকেট নয় কওমি মাদরাসার মূল বিষয় হলো আর্দশ। সার্টিফিকেটের নাম করে কোর্সের অধীনে পড়াশোনা কোনোভাবেই কাম্য নয়, এটা দুঃখজনক এবং অবৈধ-পন্থা’ বলছেন তিনি।
তিনি আরো বলেছেন, বিভিন্ন এলাকা ও মসজিদভিত্তিক হাদিস ও তাফসিরের দরস হয়ে থাকে সেখানে সাধারণ মানুষ এসে দরস শুনে যান, বিষয়টি এমন হলে ভিন্ন কথা। কিন্তু কোর্সের অধীনে এভাবে সার্টিফিকেট দেওয়ার কোন সুযোগ নেই।
এছাড়া বোর্ড কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে তা বাতিল করে দেবেন - বলেন তিনি।
‘সামনে থেকে প্রত্যেক বোর্ড পরীক্ষায় গত বোর্ড পরীক্ষার রেজাল্ট শীট দেখানো আবশ্যক হবে, তখন এমন কোর্সের কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে বর্তমানে হয়তোবা বিভিন্নভাবে তারা সুযোগ নিতে পারেন কিন্তু এটা অবৈধ ও অন্যায়‘ বলছিলেন মুফতি মোহাম্মদ আলী।
আরো পড়ুন: অনলাইনে ইফতা কোর্স: হুমকির মুখে ফতোয়া বিভাগ
এটি