শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


হক-বাতিলের পরিচয়: কোনটি মানদণ্ড আর কোনটি মানদণ্ড নয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক: আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বড় মেহেরানি। তিনি আমাকে আপনাদের খেদমতে হাজির হওয়ার তাওফিক নসীব করেছেন; তাই শোকর আদায় করছি-আলহামদু লিল্লাহ। আল্লাহর এত নেক বান্দার সোহবতে কিছু সময়ের জন্য হাজির হতে পেরেছি এটা আমার জন্য অনেক সৌভাগ্যের বিষয়।

ইচ্ছা ছিল, এখানে এসে মাগরিবের নামায আদায় করব, মাগরিবের পর থেকেই আপনাদের সোহবতে থাকব। কিন্তু তাওফিক হয়নি, দেরি হয়ে গেল। তবু মাজমা থাকা অবস্থায় আল্লাহ যে নিয়ে এলেন এবং সবার সাথে মুলাকাত হল, সেজন্য আমি আল্লাহর শোকর আদায় করি, আলহামদু লিল্লাহ।

اللّهُمّ مَا أَمْسى بِي مِنْ نِعْمَةٍ، أَوْ بِأَحَدٍ مِنْ خَلْقِكَ، فَمِنْكَ وَحْدَكَ لَا شَرِيكَ لَكَ، فَلَكَ الْحَمْدُ وَلَكَ الشّكْرُ.

এটা শোকর আদায়ের দুআ। ‘আলহামদু ল্লিাহ’ও শোকর আদায় করার গুরুত্বপূর্ণ দুআ। শোকর আদায়ের বিভিন্ন দুআ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়েছেন। একটা দুআ এটা যা এখন বললাম।

اللّهُمّ مَا أَمْسى بِي مِنْ نِعْمَةٍ، أَوْ بِأَحَدٍ مِنْ خَلْقِكَ، فَمِنْكَ وَحْدَكَ لَا شَرِيكَ لَكَ، فَلَكَ الْحَمْدُ وَلَكَ الشّكْرُ.

হে আল্লাহ! এ সন্ধ্যায় আমার মাঝে এবং আপনার যেকোনো মাখলুকের মাঝে ছোট-বড় যত নিআমত আছে, সকল নিআমত একমাত্র আপনার পক্ষ থেকে। আপনার কোনো শরীক নেই। অতএব আপনার জন্যই সকল হামদ এবং আপনার জন্যই সমস্ত শোকর ।

ঠিক সকালেও এই দুআ; শুধু একটু পার্থক্য। সন্ধ্যায় পড়ব أَمْسى আর সকালে পড়ব أَصْبَحَ -

اللّهُمّ مَا أَصْبَحَ بِي مِنْ نِعْمَةٍ، أَوْ بِأَحَدٍ مِنْ خَلْقِكَ، فَمِنْكَ وَحْدَكَ لَا شَرِيكَ لَكَ، فَلَكَ الْحَمْدُ وَلَكَ الشّكْرُ .

শোকর আদায়ের এই দুআ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়েছেন। আমি এ দুআ পড়লাম যেহেতু আমার উপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের লক্ষ-কোটি নিআমত। তাঁর লক্ষ কোটি নিআমতের মধ্যে আমি ডুবে আছি।

وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَةَ اللهِ لَا تُحْصُوهَا.

আমরা গুনেও শেষ করতে পারব না। আর গণনা করার জন্য তো আগে জানাও থাকতে হবে। কত নিআমত এমন আছে যে, আমি জানি-ই না, এটা আমার প্রতি আল্লাহ তাআলার নিআমত। আল্লাহর মেহেরবানি, আমি-ই না এখন এসেছি; আপনাদের অনেকে তো আসরের সময় এসেছেন, কেউ মাগরিবের সময় এসেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে কথা শুনেছেন।

আল্লাহ তাআলা এসব কথার উপর আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফিক নসীব করুন। ভুল-ত্রুটি হয়ে গেলে আল্লাহ ক্ষমা করুন এবং সেগুলো থেকে আমাদের রক্ষা করুন- আমীন।

যেহেতু মুরুব্বীরা এখানে বসিয়ে দিয়েছেন এজন্য দু-একটি কথা আরয করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আমি দুআ চাই, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন সহীহ বলার এবং সহজভাবে বলার তাওফিক দান করেন- আমীন।

আপনারা হয়ত লক্ষ করেছেন, খুতবাতে আমি দুটি হাদীস পড়েছি।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ ‘আমি তোমাদের কাছে দুটি জিনিস রেখে গেলাম।’ كِتَابَ اللهِ وَسُنّةَ نَبِيِّهِ ‘কুরআন মাজীদ এবং সুন্নাহ।’ لَنْ تَضِلّوا مَا تَمَسّكْتُمْ بِهِمَا - ‘যতক্ষণ তোমরা এ কুরআন-সুন্নাহ ধরে রাখবে ততক্ষণ গোমরাহ হবে না।’ এ হাদীসটি মুয়াত্তা মালেকসহ বিভিন্ন কিতাবে আছে।

আরেকটি হাদীস নাসাঈ শরীফ, তিরমিযী শরীফ, আবু দাউদ শরীফ ও মুসনাদে আহমাদসহ অনেক কিতাবে আছে। এ হাদীসের একটি প্রেক্ষাপট আছে। হযরত ইরবায ইবনে সারিয়া রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহু রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশিষ্ট সাহাবী। একদিন কিছু তাবেয়ী ইচ্ছা করলেন, আমরা তাঁর ইয়াদত করতে যাব। রোগী দেখতে যাওয়াকে বলে ইয়াদত করতে যাওয়া। পূর্বাপর থেকে বোঝা যায়, তিনি খুব বেশি অসুস্থ ছিলেন না। সেজন্য একদিকে ইয়াদতও হল, সাথে কিছু ইসতেফাদা এবং কিছু হাসিলও করা হল। কিছু শিখলাম তাঁর কাছ থেকে। সে হিসেবে তারা গেলেন এবং বললেন, আমাদেরকে কিছু শোনান। তিনি বললেন-

একদিন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিয়ে ফজরের নামায পড়লেন। এরপর আমাদের দিকে ফিরে এক সারগর্ভ বক্তৃতা করলেন। এতে আমাদের চোখ অশ্রুসজল হল এবং হৃদয় ভীতকম্পিত হল। একজন বললেন, আল্লাহর রাসূল! এ যেন বিদায়কালের উপদেশ। অতএব আমাদের প্রতি আপনার (আরো) কী অসীয়ত?

এরপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের উদ্দেশে কিছু অসীয়ত করেন। তন্মধ্যে একটি অসীয়ত হল-

مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا.

আমার পর তোমাদের যারা বেঁচে থাকবে তারা বহু মতভেদ দেখতে পাবে।

অর্থাৎ আমাকে তো আল্লাহ তাআলা নিয়ে যাবেন। আমার পর তোমরা থাকবে এবং পরবর্তী উম্মত আসতে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। তখন বিভিন্ন বিষয়ে তোমরা দেখবে শুধু দ্বন্দ্ব আর দ্বন্দ্ব। কেউ এদিকে টানে, কেউ ওদিকে টানে। তখন কী করবে তোমরা? আল্লাহর রাসূল বলেন-

فَعَلَيْكُمْ بِسُنّتِي وَسُنّةِ الْخُلَفَاءِ الرّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ، تَمَسّكُوا بِهَا وَعَضّوا عَلَيْهَا بِالنّوَاجِذِ.

তখন তোমরা আমার সুন্নাহ ও আমার হেদায়েতের পথের পথিক খলীফাগণের সুন্নাহকে সর্বশক্তি দিয়ে ধারণ করবে।

এই হাদীসে খোলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাহর কথা বর্ণিত হয়েছে। আরেক হাদীসে নাজাতপ্রাপ্ত দলের পরিচয় দিতে গিয়ে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي

(নাজাতের পথ সেটা) যে পথে আমি ও আমার সাহাবীরা আছি। (জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৪৮)

قال الترمذي: هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيْبٌ مُفَسَّرٌ، لاَ نَعْرِفُهُ مِثْلَ هَذَا إِلاَّ مِنْ هَذَا الْوَجْهِ.

অর্থাৎ নাজাতপ্রাপ্ত তারা, যারা ঐ পথে আছে, যে পথে আমি ও আমার সাহাবীরা রয়েছি। এখানে ‘মা’ দ্বারা সুন্নাহকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ তোমরা আমার সুন্নাহ ও আমার সাহাবীদের সুন্নাহকে আঁকড়ে ধর।

যাইহোক, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, হকের উপর থাকতে হলে আমার সুন্নাহ ও আমার খোলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাহ মজবুতভাবে আঁকড়ে ধর।

এরপর বলেন-

وَإِيّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ، فَإِنّ كُلّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ، وَكُلّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ.

আর সকল নব উদ্ভাবিত বিষয় থেকে দূরে থাকবে। কারণ, সকল নব উদ্ভাবিত বিষয় বিদআত। আর সকল বিদআত গোমরাহী ও ভ্রষ্টতা।’ (দ্র. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭১৪২, ১৭১৪৫)

অর্থাৎ দ্বীনের নামে যত নতুন জিনিস আসবে তা থেকে বিরত থাকবে। দেখুন, বলা হয়েছে- ‘দ্বীনের নামে যত নতুন জিনিস আসবে।’ কারণ জাগতিক বিষয়ে নতুন নতুন জিনিস আসতে পারে। এ মসজিদে আপনারা পাখা লাগিয়েছেন; আগে কি পাখা ছিল? না। এই যে আমরা মাইক ব্যবহার করছি, আগে কি মাইক ছিল? ছিল না। এগুলো জাগতিক বিষয়। আর জাগতিক বিষয়ে নীতি হল, যদি শরীয়তবিরোধী না হয়, আপনি তা গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু দ্বীনী বিষয়ে কোনো ‘নতুন’ নেই। এক্ষেত্রে কোনো ‘নতুন’ গ্রহণযোগ্য নয়। নতুন বলতে প্রত্যেক এমন বিষয়, যা শরীয়তের দলীলের মধ্যে মওজুদ নেই। শরীয়তের দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয় এমন কোনো জিনিসকে কেউ দ্বীন ও শরীয়ত বানিয়ে দিবে- এটা হতে পারে না। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ

‘(দ্বীনের নামে) নবউদ্ভাবিত সকল বিষয় থেকে দূরে থাক।’

আরেক হাদীসে আছে-

مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدّ .

‘যে আমাদের এই বিষয়ে (অর্থাৎ দ্বীন ও শরীয়তে) এমন কিছু উদ্ভাবন করবে, যা তার অংশ নয়, তা প্রত্যাখাত।’ -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭১৮; সহীহ বুখারী, হাদীস ২৬৯৭

তাহলে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই হাদীসদ্বয়ে

(تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ ও فَعَلَيْكُمْ بِسُنّتِي وَسُنّةِ الْخُلَفَاءِ الرّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ )

হক চেনা ও বোঝার দুটি মানদ- উল্লেখ করেছেন।

১. কুরআন মাজীদ

২. সুন্নাহ তথা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও খোলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাহ, যা সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাহও বটে।

সুতরাং শরীয়তে হক নির্ণয়ের মাপকাঠি হল, কুরআন ও সুন্নাহ। পাশাপাশি কুরআন-সুন্নাহয় যেসব বিষয়কে শরীয়তের দলিল ও হক নির্ণয়ের মাপকাঠি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে সেগুলো। তাই যেখানে হক-বাতিল নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিবে সেখানেই হক নিরূপণের জন্য শরীয়তের এই মানদ- ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখন মানদ- নিয়েই বিদআত শুরু হয়ে গেছে। শরীয়ত প্রদত্ত মানদ-ের বাইরে নতুন নতুন মানদ- ‘আবিষ্কার’ করা হচ্ছে! আপনারাই বলুন, হক নির্ণয়ের জন্য শরীয়ত প্রদত্ত মানদ-ের বিপরীতে নতুন নতুন মানদ- দাঁড় করানো- এটা হক নাকি বাতিল? বাতিল। সুন্নাহ নাকি বিদআত? বিদআত। হেদায়েত নাকি গোমরাহী? গোমরাহী। অথচ দাওয়াত ও তাবলীগের সাথে সংশ্লিষ্ট একশ্রেণীর ভাইয়েরা এই কাজটাই করছেন। তারা শরীয়ত প্রদত্ত মানদ- বাদ দিয়ে হক নিরূপণের নতুন নতুন মানদ- আবিষ্কার করছেন এবং সাধারণ ও নতুন সাথীদের বিভ্রান্ত করছেন। আসলে এ ধরনের বাতিল ও গোমরাহীপূর্ণ মানদ- বিদআতীদের মধ্যে আগে থেকেই ছিল। আল্লাহ তাআলা তাবলীগ জামাতকে এসব থেকে রক্ষা করেছিলেন। আফসোস, এখন এখানেও এসব ঢুকে পড়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের মাফ করুন। গোনাহ থেকে বাঁচার তাওফীক দান করুন এবং এ ধরনের বিদআতী মাপকাঠির পিছনে পড়া থেকে হেফাজত করুন- আমীন।

তো, কী কী নতুন মাপকাঠি অবিষ্কার করা হয়েছে? সেগুলোর কয়েকটি আজকে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

১. স্বপ্ন

একটা হল স্বপ্ন। যেমন কেউ বলল, স্বপ্নে আমার বাবা, দাদা বা শায়েখ বলেছেন, এটা হক আর ওটা বাতিল। অথবা স্বপ্নে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন, এইদিক হক আর ওইদিক না-হক! আর এই স্বপ্নের ভিত্তিতেই সে ফায়সালা করে ফেলল, এরা হকপন্থী আর ওরা হকবিরোধী! সুবহানাল্লাহিল আযীম!

মনে রাখবেন, নবীগণের স্বপ্ন ছাড়া আর কারো স্বপ্নকে শরীয়ত দলীলের মর্যাদা দেয়নি। শরীয়ত স্বপ্নকে শুধু সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারীরূপে স্বীকৃতি দিয়েছে; এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। আর সেটাও শুধু ঐ স্বপ্নের ক্ষেত্রে, যেটাকে ভালো স্বপ্ন বলা যায়; অর্থাৎ যেটা শয়তানের পক্ষ থেকেও নয় এবং কল্পনাপ্রসূতও নয়। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

الرّؤْيَا الصّالِحَةُ مِنَ اللهِ، وَالرّؤْيَا السّوْءُ مِنَ الشّيْطَانِ، فَمَنْ رَأَى رُؤْيَا فَكَرِهَ مِنْهَا شَيْئًا فَلْيَنْفُثْ عَنْ يَسَارِهِ، وَلْيَتَعَوّذْ بِاللهِ مِنَ الشّيْطَانِ، لَا تَضُرّهُ وَلَا يُخْبِرْ بِهَا أَحَدًا، فَإِنْ رَأَى رُؤْيَا حَسَنَةً، فَلْيُبْشِرْ وَلَا يُخْبِرْ إِلّا مَنْ يُحِبّ.

ভালো স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে আর মন্দ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে। কেউ খারাপ স্বপ্ন দেখলে বাম দিকে থুথু দিবে এবং আল্লাহর নিকট বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং এ স্বপ্ন তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর এ দুঃস্বপ্নের কথা কারো কাছে বলবে না। অপরদিকে ভালো স্বপ্ন দেখলে সুসংবাদ গ্রহণ করবে এবং এ স্বপ্নের কথা (একান্ত বর্ণনা করতে হলে) মহব্বতের লোকদের নিকটই বর্ণনা করবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৬১

আরেক হাদীসে আল্লাহর রাসূল বলেন-

الرّؤْيَا ثَلَاثَةٌ: فالرّؤْيَا الصّالِحَةُ بُشْرَى مِنَ اللهِ، وَرُؤْيَا تَحْزِينٌ مِنَ الشّيْطَانِ، وَرُؤْيَا مِمّا يُحَدِّثُ الْمَرْءُ نَفْسَهُ، فَإِنْ رَأَى أَحَدُكُمْ مَا يَكْرَهُ فَلْيَقُمْ فَلْيُصَلِّ، وَلَا يُحَدِّثْ بِهَا النّاسَ.

স্বপ্ন তিন প্রকার। এক. ভালো স্বপ্ন। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদস্বরূপ। দুই. শয়তানের পক্ষ থেকে পেরেশানকারী স্বপ্ন। তিন. কল্পনাপ্রসূত স্বপ্ন। তোমাদের কেউ যদি স্বপ্নে অপ্রীতিকর কিছু দেখে তাহলে সে যেন উঠে নামায আদায় করে এবং মানুষের কাছে সে স্বপ্ন বর্ণনা না করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৬৩; জামে তিরমিযী, হাদীস ২২৭০

পার্থিব বিষয়ের ভালো-মন্দ তো মানুষ বিবেক দ্বারা নির্ধারণ করতে পারে। কিন্তু দ্বীনী বিষয়ের ভালো-মন্দ নির্ণয় করবে কীভাবে? দ্বীনী বিষয়ের ভালো-মন্দ তো শরীয়তের দলীল ছাড়া বোঝা সম্ভব নয়। তাই দলীলের আলোকেই কোনো স্বপ্নের বিষয়বস্তু শরীয়তসম্মত প্রমাণিত হলে তা ভালো স্বপ্ন আর শরীয়ত পরিপন্থী সাব্যস্ত হলে তা মন্দ স্বপ্ন। সেজন্য কোনো স্বপ্নকে ভালো বলতে হলে শরীয়তের কোনো না কোনো দলীলের আলোকেই বলতে হবে। এবার আপনারাই বলুন, যে স্বপ্নের ভালো-মন্দ নির্ধারণের একমাত্র মাপকাঠি শরীয়ত, সে স্বপ্ন কীভাবে আবার শরীয়তের দলীল হতে পারে?! তাছাড়া স্বপ্ন তো স্বপ্নই। স্বপ্ন দিয়ে তো পার্থিব বিষয়েই বিচার করা যায় না। যেমন এক ব্যক্তি নিহত হল। হত্যাকারীকে কোনোভাবেই চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় মহল্লার একজন (হয়ত সে ভালো মানুষ) এসে বলল, এ লোকের হত্যাকারী কে- আমি জানি। গত রাতে আমি অমুক বুযুর্গকে স্বপ্নে দেখেছি। তিনি বলেছেন, এই ব্যক্তির হত্যাকারী হল অমুক। কিংবা বলল, স্বপ্নে নিহতব্যক্তি নিজেই আমাকে বলে গেছে, তার হত্যাকারী হল অমুক। এখন এই স্বপ্নের ভিত্তিতে কি (হোক তা কোনো নেককার মানুষের স্বপ্ন) কোনো ফায়সালা করা সম্ভব? না। অতএব পার্থিব বিষয়েই যদি স্বপ্ন দলীল না হয় এবং এর ভিত্তিতে ফায়সালা না করা যায় তাহলে দ্বীন ও শরীয়তের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ও নাযুক বিষয়ে কীভাবে স্বপ্ন দ্বারা ফায়সালা করে ফেলবে যে, কোন্্্টা হক আর কোন্টা না-হক!

বাকি রইল, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখার বিষয়টি। সে সম্পর্কে হাদীসে কী আছে শুনুন-

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

مَنْ رَآنِي فِي الْمَنَامِ فَقَدْ رَآنِي، فَإِنّ الشّيْطَانَ لَا يَتَمَثّلُ بِي.

‘যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্নে দেখল সে সত্যই আমাকে দেখল। কারণ, শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৬৬

আপনারা হাদীসের বক্তব্য ভালোভাবে লক্ষ করুন। হাদীসে শুধু আল্লাহর রাসূলকে দেখার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে; কিন্তু তাঁর কথা ঠিক ঠিকভাবে শোনা, সঠিকভাবে বোঝা এবং জাগ্রত হওয়ার পর তা যথাযথ স্মরণ থাকা এসব বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি। একথাও বলা হয়নি যে, এসব ক্ষেত্রে শয়তান কোনোরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। তাই কেউ স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোনো কিছু বলতে শুনলে তার শোনা ও মনে রাখাটা সঠিক ও নির্ভুল হয়েছে কি না, তা যাচাই করার একমাত্র মাধ্যম শরীয়ত। যে কথাটার বিষয়ে তার মনে হচ্ছে যে, সে এটা স্বপ্নে শুনেছে, সেটা যদি শরীয়তসম্মত হয় ভালো; নতুবা বুঝতে হবে, অবশ্যই কোথাও না কোথাও তার ভুল হয়েছে।

শায়েখ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলবী রাহ. (১০৫২ হি.)-এর নাম শুনেছেন কি না আপনারা? শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (১১৭৬ হি.) রাহ.-এর আগের মানুষ। তিনি ‘মা সাবাতা বিসসুন্নাহ ফী আইয়ামিস সানাহ’ কিতাবে (পৃষ্ঠা ৩৩৫) এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন, কানযুল উম্মাল কিতাবের সংকলক শায়েখ আলী আলমুত্তাকী (৯৭৫ হি.)-এর সূত্রে। ঘটনাটি হল,

এক ব্যক্তি দাবি করে, স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন-

اشرب الخمر

‘তুমি মদ পান কর!’

তখন শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনে ইরাক (৯৩৩ হি.) রাহ. জীবিত। তাঁর কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘নিঃসন্দেহে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

لا تشرب الخمر

‘তুমি মদ পান করবে না।’

কিন্তু সে শুনতে ভুল করেছে। কারণ, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন মদ পান করতে। এমন স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞার পর তিনি কখনো স্বপ্নে পুনরায় মদপানের আদেশ করতে পারেন না।

অতএব আল্লাহর রাসূল মূলত বলেছেন, তুমি মদ পান করো না। কিন্তু সে ভুল শুনেছে যে, ‘তুমি মদ পান কর!’

দেখুন, মানুষকে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন। মানুষের সব ধরনের অবস্থা সম্পর্কে তিনিই ভালো জানেন। নবী-রাসূল ছাড়া আর কারো স্বপ্ন যদি দলীল হতো তাহলে অবশ্যই তিনি তা বলে দিতেন। কিন্তু কুরআন-সুন্নাহর কোথাও তো এমন কথা নেই। এরপরও যদি কেউ নিজের বা অন্যের স্বপ্নকে দলীলের পর্যায়ের বলে দাবি করে এবং এর ভিত্তিতে হক-বাতিলের ফায়সালা করে ফেলে তাহলে তা গোমরাহী ছাড়া আর কী! কারণ সে তো নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্য আর কিছু না পেয়ে অবশেষে স্বপ্নের আশ্রয় নিয়েছে। এদের সম্পর্কে ইমাম শাতেবী রাহ. (৭৯০ হি.) অতি চমৎকার বলেছেন। ‘আল ই‘তিসাম’ গ্রন্থে তিনি বলেন-

وأَضعف هؤلاءِ احْتِجَاجًا: قَوْمٌ اسْتَنَدُوا فِي أَخذ الأَعمال إِلى الْمَنَامَاتِ، وأَقبلوا وأَعرضوا بِسَبَبِهَا، فيقولون: رأَينا فلاناً الرجل الصالح في النوم، فَقَالَ لَنَا: اتْرُكُوا كَذَا، وَاعْمَلُوا كَذَا. وَيَتّفِقُ مثل هذا كثيراً للمُتَرَسِّمين برَسْم التّصَوّفِ، وَرُبّمَا قَالَ بَعْضُهُمْ: رأَيت النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فِي النّوْمِ، فَقَالَ لِي كَذَا، وأَمرني بِكَذَا؛ فَيَعْمَلُ بِهَا، وَيَتْرُكُ بِهَا، مُعْرِضًا عَنِ الْحُدُودِ الْمَوْضُوعَةِ فِي الشّرِيعَةِ، وَهُوَ خَطَأٌ؛ لأَن الرّؤْيَا مِنْ غَيْرِ الأَنبياءِ لَا يُحْكَمُ بِهَا شَرْعًا عَلَى حَالٍ، إِلا أَن نعرضها عَلَى مَا فِي أَيدينا مِنَ الأَحكام الشّرْعِيّةِ، فإِن سَوّغَتْهَا عُمل بِمُقْتَضَاهَا، وإِلا وَجَبَ تَرْكُهَا والإعراض عنها، وإِنما فائدتها البشارة والنذارة خَاصّةً، وأَما اسْتِفَادَةُ الأَحكام فَلَا...

فَلَوْ رأَى فِي النّوْمِ قائلاً يقول له: إِن فُلَانًا سَرَقَ فَاقْطَعْهُ، أَو عَالِمٌ فاسأَله، أَو اعْمَلْ بِمَا يَقُولُ لَكَ، أَو فُلَانٌ زنى فحُدّه، أَوْ ما أَشبه ذَلِكَ؛ لَمْ يَصِحّ لَهُ الْعَمَلُ حَتّى يَقُومَ لَهُ الشّاهِدُ فِي الْيَقَظَةِ، وإِلا كَانَ عَامِلًا بِغَيْرِ شَرِيعَةٍ؛ إِذ لَيْسَ بَعْدَ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ وَحْيٌ...

يُحْكَى أَن شَرِيكَ بْنَ عَبْدِ اللهِ القاضي دخل يوماً عَلَى الْمَهْدِيِّ، فَلَمّا رَآهُ قَالَ: علَيّ بِالسّيْفِ والنّطْع! قَالَ: ولِمَ يَا أَمير الْمُؤْمِنِينَ؟ قَالَ: رأَيت فِي مَنَامِي كأَنك تطأُ بِسَاطِي وأَنت مُعْرِضٌ عَنِّي، فَقَصَصْتُ رُؤْيَايَ عَلَى مَنْ عَبرَهَا. فَقَالَ لِي: يُظْهِرُ لَكَ طَاعَةً وَيُضْمِرُ مَعْصِيَةً. فَقَالَ لَهُ شَرِيكٌ: وَاللهِ! مَا رُؤْيَاكَ بِرُؤْيَا إِبراهيم الخليل عليه السلام، ولا مُعَبِّرُكَ بيوسف الصديق عليه السلام، أَفبالأَحلام الكاذبة تضرب أَعناق المؤمنين؟ فاسْتَحْيَى المهدي، وقال له: اخرج عني، ثم صرفه وأَبعده...

وأَما الرّؤْيَا الّتِي يُخْبِرُ فِيهَا رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ الرّائِي بِالْحُكْمِ، فَلَا بُدّ مِنَ النّظَرِ فِيهَا أَيضاً؛ لأَنه إِذا أَخبر بحكم موافق لشريعته، فالعمل بما استقرّ من شريعته، وإِن أَخبر بمخالف، فمحال؛ لأَنه عليه السلام لَا يَنْسَخُ بَعْدَ مَوْتِهِ شَرِيعَتَهُ الْمُسْتَقرّةَ فِي حَيَاتِهِ؛ لأَن الدِّينَ لَا يَتَوَقّفُ اسْتِقْرَارُهُ بَعْدَ مَوْتِهِ عَلَى حُصُولِ الْمَرَائِي النّوْمِيّةِ؛ لأَن ذَلِكَ بَاطِلٌ بالإِجماع. فَمَنْ رأَى شَيْئًا مِنْ ذَلِكَ فَلَا عَمَلَ عَلَيْهِ.

‘এসকল বিদআতের মধ্যে দলীলের বিচারে সবচাইতে দুর্বল হল সে দল, যারা তাদের আমল ও বিধি-বিধান গ্রহণের ভিত্তি বানিয়েছে স্বপ্নকে। স্বপ্নের ভিত্তিতেই তারা কোনো আমলের প্রতি অগ্রসর হয় বা বিরত থাকে। এরা বলে থাকে, আমরা অমুক নেককার ব্যক্তিকে স্বপ্নে দেখেছি। তিনি আমাদের বলেছেন, ‘তোমরা অমুক কাজ করো না বা অমুক কাজ কর।’ প্রথাগত তাসাওউফের দাবিদারদের মধ্যে এসব বেশি হয়ে থাকে।

কখনো বা বলে, আমি স্বপ্নে রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দর্শন লাভ করেছি; তিনি আমাকে এরূপ বলেছেন বা এরূপ নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর শরীয়তের সীমা লংঘন করে স্বপ্ন অনুযায়ী কোনো কাজ করে বা বর্জন করে।

এ সবই ভুল। কেননা শরীয়তে কোনো অবস্থাতেই নবীগণের স্বপ্ন ছাড়া আর কারো স্বপ্নের উপর ভিত্তি করে কোনো নির্দেশ জারি করা যায় না; বরং আমাদের কাছে শরীয়তের যে বিধানাবলি আছে, স্বপ্নকে সেগুলোর মানদ-ে বিচার করা হবে। শরীয়তের বিধান যদি সে স্বপ্নকে সমর্থন করে- আমল করা যাবে; নতুবা তা পরিত্যাগ করা এবং তা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। স্বপ্নের উপকারিতা শুধু এটুকু যে, (যদি তা ভালো হয়) তা থেকে সুসংবাদ ও সতর্কতার ইঙ্গিত গ্রহণ করা যায় মাত্র। স্বপ্নের মাধ্যমে নতুন কোনো বিধান লাভ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।...

সুতরাং কেউ যদি স্বপ্নে কাউকে বলতে শুনে, ‘নিশ্চয়ই অমুক ব্যক্তি চুরি করেছে, তুমি তার হাত কেটে দাও; অমুক ব্যক্তি আলেম, তুমি তার কাছে ইলম শেখ; অমুকের কথা মত কাজ কর অথবা অমুক ব্যক্তি যিনা করেছে, তুমি তাকে হদ লাগাও ইত্যাদি তাহলে তার জন্য সে অনুযায়ী কাজ করা বিলকুল বৈধ হবে না, যতক্ষণ না বাস্তবে তার কোনো সাক্ষী থাকবে। সাক্ষী ছাড়া শুধু স্বপ্ন মোতাবেক কাজ করলে সে শরীয়ত গর্হিত কর্মসম্পাদনকারী বলে বিবেচিত হবে; যেহেতু রাসূলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে কোনো ওহী নেই।...

বর্ণিত আছে, একদা বিচারপতি শরীক ইবনে আবদুল্লাহ খলীফা মাহদীর দরবারে গেলেন। খলীফা তাকে দেখেই একজনকে নির্দেশ দিলেন, তরবারি আনো! তিনি বললেন, আমীরুল মুমিনীন! (আমার) কী অপরাধ? বাদশা বললেন, আমি স্বপ্নে তোমাকে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আমার ফরাশ মাড়াতে দেখেছি। আমার এ স্বপ্ন তাবীরকারকের নিকট বর্ণনা করলে সে তার এই ব্যাখ্যা করে যে, তুমি প্রকাশ্যে আনুগত্য দেখাও আর আড়ালে বিরোধিতা কর।

জবাবে শরীক ইবনে আবদুল্লাহ বললেন, আল্লাহর কসম! আপনার স্বপ্ন ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্বপ্ন নয় আর তাবীরদাতাও ইউসুফ আলাইহিস সালাম নন। এরূপ মিথ্যা স্বপ্নের ভিত্তিতে আপনি মুমিন-মুসলমানদের গর্দান উড়িয়ে দিবেন?! খলীফা মাহদী এতে লজ্জিত হন এবং বলেন, তুমি এখান থেকে বেরিয়ে যাও! তারপর তাকে দূরে সরিয়ে দেন...।

আর কেউ যদি স্বপ্নে দেখে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কোনো হুকুম করছেন তাহলে সেক্ষেত্রেও বিবেচনা করতে হবে। কারণ, যদি সে (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আনীত) শরীয়ত সমর্থিত কোনো হুকুম পালনের কথা স্বপ্নে শুনে থাকে, তাহলে হুকুম পালন শরীয়তের বিধান মোতাবেকই হল (স্বপ্ন মোতাবেক নয়) আর যদি স্বপ্নে শরীয়ত-বিরোধী কোনো হুকুম পালনের কথা শুনে থাকে, তাহলে এ শ্রবণ অবশ্যই ভুল। কেননা এটা অসম্ভব যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালের পর তাঁর জীবদ্দশার শাশ্বত শরীয়তকে তিনি স্বপ্নে রহিত করে দিবেন। এরূপ ধারণা (কুরআন হাদীস এবং) শরীয়তের ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাতিল। কাজেই স্বপ্নে শরীয়তের খেলাফ কোনো কিছু দেখলে কিছুতেই সে মোতাবেক আমল করা যাবে না।’ -আলই‘তিসাম ২/৭৮-৮২, প্রকাশনা : মাকতাবাতুত তাওহীদ

যাইহোক, আশাকরি বিষয়টি মোটামুটি পরিষ্কার হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে হক বোঝার ও জানার তাওফীক দান করুন- আমীন।

২. কাশফ ও ইলহাম

কেউ কেউ কাশফ ও ইলহামের হাওয়ালা দিয়ে প্রমাণ করতে চান যে, এরা সঠিক পথে আর ওরা ভুল পথে!

কাশফ ও ইলহাম কী- বুঝেন তো? কাশফ হল অদৃশ্য জগতের কোনো কথা প্রকাশিত হয়েছে বলে ধারণা হওয়া আর ইলহাম অর্থ চিন্তা ও চেষ্টা ছাড়াই কোনো কথা অন্তরে উদ্রেক হওয়া। তবে স্বপ্ন যেমন দলীল নয়, কাশফ-ইলহামও দলীল নয়।

হাদীস শরীফে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

إِنّ لِلشّيْطَانِ لِمّةً، وَلِلْمَلَكِ لِمّةً، فَأَمّا لِمّةُ الشّيْطَانِ فَإِيعَادٌ بِالشّرِّ، وَتَكْذِيبٌ بِالْحَقِّ، وَأَمّا لِمّةُ الْمَلَكِ فَإِيعَادٌ بِالْخَيْرِ، وَتَصْدِيقٌ بِالْحَقِّ، فَمَنْ وَجَدَ مِنْ ذَلِكَ فَلْيَعْلَمْ أَنّهُ مِنَ اللهِ، فَلْيَحْمَدِ اللهَ، وَمَنْ وَجَدَ مِنَ الْآخَرِ فَلْيَتَعَوّذْ مِنَ الشّيْطَانِ، ثُمّ قَرَأَ اَلشَّیْطٰنُ یَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَ یَاْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَآءِ وَ اللهُ یَعِدُكُمْ مَّغْفِرَةً مِّنْهُ وَ فَضْلًا.

নিশ্চয়ই মানুষের অন্তরে শয়তানের পক্ষ থেকেও কথার উদ্রেক হয়, ফেরেশতার পক্ষ থেকেও কথার উদ্রেক হয়। শয়তানের উদ্রেক হল, মন্দ প্রতিশ্রুতি ও সত্য অস্বীকার করা। আর ফেরেশতার উদ্রেক হল, কল্যাণের প্রতিশ্রুতি ও হকের সত্যায়ন। যে ব্যক্তি এটি (ভালো কিছুর উদ্রেক) অনুভব করবে তাকে বুঝতে হবে, এটি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে। তাই তার উচিত আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করা। আর যে দ্বিতীয়টি (অর্থাৎ খারাপ কিছুর উদ্রেক) অনুভব করবে সে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে। এরপর তিনি (সূরা বাকারর ২৬৮ নং আয়াত) পাঠ করেন-

اَلشَّیْطٰنُ یَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَ یَاْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَآءِ وَ اللهُ یَعِدُكُمْ مَّغْفِرَةً مِّنْهُ وَ فَضْلًا.

অর্থাৎ শয়তান তোমাদের অভাব-অনটনের ভীতি প্রদর্শন করে এবং অশ্লীলতার আদেশ দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তোমাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দান করেন। -সুনানে কুবরা, নাসাঈ, হাদীস ১১০৫১; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯৮৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯৯৮

এ হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছে, মনে যেসব কথার উদ্রেক হয় সেগুলোর কোনোটা ভালো, কোনোটা মন্দ। আর ভালোটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে। জানা কথা, কোন্টা ভালো আর কোন্টা মন্দ, তা নির্ণয়ের একমাত্র মাধ্যম হল শরীয়ত। শরীয়ত দ্বারাই তার ভালো-মন্দ যাচাই করতে হবে। সেজন্য তাসাওউফ শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমাম আবু সুলাইমান দারানী রাহ. (২০৫ হি.) বলেন-

رُبّمَا يَقَعُ فِي قَلْبِي النُكْتَةُ مِنْ نُكَتِ القَوْمِ أَيّاماً، فَلاَ أَقْبَلُ مِنْهُ إِلاّ بِشَاهِدَيْنِ عَدْلَينِ، الكِتَابُ وَالسّنّة.

প্রায়ই আমার অন্তরে (সূফী) সম্প্রদায়ের কোনো ভেদতত্ত্ব উদয় হয়। কিন্তু নির্ভরযোগ্য সাক্ষীদ্বয়- কুরআন ও সুন্নাহ-এর সাক্ষ্য ব্যতীত আমি তা গ্রহণ করি না।’ -সিয়ারু আলামিন নুবালা ৮/৪৭৩

বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে, যদি আপনারা স্বপ্ন, কাশফ ও ইলহাম বিষয়ক হাদীসগুলোর পাঠ গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। স্বপ্নের বিষয়ে হাদীসে একথা বলা হয়নি যে, যেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে সেটা ভালো। কাশফ-ইলহামের ক্ষেত্রেও বলা হয়নি, যেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে সেটা ভালো। বরং বলা হয়েছে, যেটা ভালো সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে। তাই কোনো স্বপ্ন কাশফ-ইলহামকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বলতে হলে আগে তা ভালো হওয়া প্রমাণিত হতে হবে। আর ভালো-মন্দ নির্ণয়ের মাপকাঠি হল শরীয়ত।

অতএব এটা স্পষ্ট হল যে, কাশফ-ইলহাম কখনো শরীয়তের দলীল ও হক-বাতিলের মাপকাঠি হতে পারে না।

হাঁ, এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়। ধরুন, শরীয়তের দলীলের আলোকে প্রমাণিত হল যে, এ বিষয়টা হক। এখন এর পক্ষে কেউ তার নিজের বা অন্য কারো স্বপ্ন, কাশফ বা ইলহাম পেশ করল; এতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ সে তো এসব দিয়ে দলীল পেশ করছে না এবং এসবকে হকের মাপকাঠি বানাচ্ছে না। বরং শরয়ী দলীলের আলোকে প্রমাণিত একটি বিষয়ের পক্ষে এগুলোকে পেশ করছে মাত্র। সমস্যা হয় তখন যখন শরয়ী দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয় এমন বিষয়কে স্বপ্ন-কাশফ বা ইলহামের কথা বলে প্রমাণের চেষ্টা করা হয়। এরচে ভয়াবহ হল, শরয়ী দলীলের ভিত্তিতে কোনো কিছু ভুল সাব্যস্ত হয়েছে অথচ সেটাকে ভুল না মেনে উল্টো স্বপ্ন-কাশফ বা ইলহাম দিয়ে তার পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়। এগুলো মারাত্মক অন্যায়। অতএব যাকেই দেখা যাবে, শরয়ী দলীলের বিপরীতে স্বপ্ন, কাশফ বা ইলহামকে দলীল হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে। বুঝতে হবে, এটা তার গোমরাহীর ও পথভ্রষ্টতার আরেকটা দলীল। কারণ, আগে এটুকু জানা ছিল যে, তার মধ্যে এই এই গোমরাহী আছে। এখন জানা গেল, সেগুলো প্রতিষ্ঠা করার জন্য সে হক-বাতিলের শরয়ী মাপকাঠি বাদ দিয়ে নতুন নতুন মাপকাঠি বানাচ্ছে। তাই এটা তার গোমরাহ হওয়ার নতুন আরেকটা দলীল।

৩. নির্দিষ্ট জায়গা

গোমরাহীর একটা বড় দিক হল, নির্দিষ্ট কোনো জায়গাকে (হোক তা বরকতপূর্ণ) শুধু সেই জায়গা হওয়ার কারণে হক-বাতিলের মাপকাঠি বানানো এবং এর ভিত্তিতে হক না-হকের ফয়সালা করে ফেলা। নিঃসন্দেহে এটা অনেক বড় গোমরাহী।

দেখুন, বাইতুল্লাহ, মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীর চাইতে বরকতময় ও মর্যাদাপূর্ণ জায়গা পৃথিবীতে আর কোথায় আছে? হাদীস শরীফে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

صَلَاةٌ فِي مَسْجِدِي هَذَا أَفْضَلُ مِنْ أَلْفِ صَلَاةٍ فِيمَا سِوَاهُ، إِلّا الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ، وَصَلَاةٌ فِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَفْضَلُ مِنْ مِائَةِ أَلْفِ صَلَاةٍ فِيمَا سِوَاهُ.

আমার এই মসজিদের (অর্থাৎ মসজিদে নববীর) একটি সালাত অন্য জায়াগার এক হাজার সালাতের চাইতে উত্তম- মসজিদে হারাম ভিন্ন। মসজিদে হারামের একটি সালাত অন্য জায়গার এক লক্ষ সালাতের চাইতে উত্তম। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৬৯৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৪০৬

বাইতুল্লাহ সম্পর্কে কুরআন মাজীদে সূরা আলে ইমরানের ৯৬ নম্বর আয়াতে আছে-

اِنَّ اَوَّلَ بَیْتٍ وُّضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِیْ بِبَكَّةَ مُبٰرَكًا وَّ هُدًی لِّلْعٰلَمِیْنَ.

মানুষের (ইবাদতের) জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর তৈরি করা হয়, নিশ্চয়ই তা সেটি, যা মক্কায় অবস্থিত, যা বরকতময় এবং সমগ্র জগতের মানুষের জন্য হেদায়েতের উপায়। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৯৬

এছাড়া আরো বহু ফযীলত বর্ণিত হয়েছে এই দুই মসজিদ সম্পর্কে। কিন্তু কুরআন-হাদীসের কোথাও এই নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি যে, ‘কিয়ামত পর্যন্ত এই দুই মসজিদের মিম্বর থেকে যা কিছু বলা হবে সব হক! এই দুই মসজিদে কখনো কোনো বিদআতী, কোনো গোমরাহ আসন গাড়তে পারবে না। তাই কিয়ামত পর্যন্ত এ দুই মসজিদের মিম্বর ও মেহরাব সবার জন্য আনুগত্যের কেন্দ্র থাকবে।’ আর বাস্তবতাও তাই বলে। জাহেলী যুগে বাইতুল্লাহ কাফের-মুশরিকদের দখলে ছিল। সেখানে মূর্তিপূজা হত; সেখান থেকে কুফর-শিরকের আওয়াজ আসত। কিন্তু বাইতুল্লাহ থেকে বলার কারণে কি সেখানকার সেসব শিরকী ও কুফরী কথাবার্তা ও কার্যকলাপ হক হয়ে যাবে? কখনও না। বাতিল যেখানেই থাকুক তা বাতিলই থাকবে। বিদআতী যেখানেই থাকুক সে বিদআতী; যত ভালো জায়গাতেই সে আসন গাড়–ক না কেন এবং যত বড় ঐতিহ্যবাহী জায়গাই সে দখল করে রাখুক না কেন। পাপী যেখানেই থাকুক সে পাপী। কোনো ভাল জায়গায় অবস্থান করার কারণে পাপী নেককার হয়ে যায় না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সালমান ফারসী রা.-এর বাণী স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখুন এবং অন্তরে গেঁথে রাখুন, যা তিনি বাইতুল মাকদিসের মত বরকতপূর্ণ জায়গার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন-

إِنّ الْأَرْضَ لاَ تُقَدِّسُ أَحَداً. وَإِنّمَا يُقَدِّسُ الْإِنْسَانَ عَمَلُهُ.

নিশ্চয়ই কোনো ভূখ- কাউকে পবিত্র করতে পারে না। মানুষ পবিত্র হতে পারে একমাত্র আমলের মাধ্যমে। -মুআত্তা মালেক, হাদীস ২৮৪২, অধ্যায়, জামিউল কাযা ওয়া কারাহিয়াতিহী

তাই ইসলাহ হবে ঈমান-আকীদা ঠিক করলে এবং আমল-আখলাক পরিশুদ্ধ করলে। আকীদাতে সমস্যা, চিন্তা-চেতনায় সমস্যা আর আছি ঐতিহ্যবাহী জায়গায়- এটা আখেরাতে কোনো কাজে আসবে না। এটা কখনো হক হওয়ার দলীল হতে পারে না।

সুতরাং বাইতুল্লাহ মসজিদে নববী ও বাইতুল মাকদিসের ক্ষেত্রেই যখন এ নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি যে, এখানের মিম্বর-মেহরাব থেকে যাই বলা হবে তাই হক তাহলে দুনিয়াতে আর কোন্ জায়গা আছে, যার বিষয়ে এমন কথা বলা যায়? কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, এমন কথাও বলা হচ্ছে! মাওলানা সা‘দ সাহেব বলেছেন! নিযামুদ্দীন মারকায সম্পর্কে তার বক্তব্য শুনুন-

ساری دنیا کا حال يہ ہے کہ مکہ مدینہ کے بعد اگر کوئی جگہ قابل احترام اور قابل اقتداء اور قابل اطاعت اور قابل عظمت ہے تو وہ مسجد نظام الدین ہے ... ، ہمیشہ کے لیے، ساری دنیا کے لیے ، سارے امور کا مرجع اور سارے امور کا مرکز وہ نظام الدین ہے۔

সারা দুনিয়ার অবস্থা হল, মক্কা-মদীনার পর যদি কোনো ইহতেরাম ও আজমতের জায়গা থাকে, যদি কোনো অনুসরণ ও এতাআতের জায়গা থাকে, সেটা হল মসজিদ নিযামুদ্দীন। ...সব সময়ের জন্য, পুরো দুনিয়ার জন্য, সকল বিষয়ে এটাই মারকায, সকল বিষয়ে এটাই কেন্দ্রস্থল।

অন্যত্র বলেন-

یہ دو چیزیں الگ الگ نہیں ہیں، کہ عالمی مشورہ الگ ہے اور مرکز الگ ہے، یہ ممکن نہیں ہے، یہ ممکن نہیں ، قیامت تک ممکن نہیں ، ایک عالمی مشورہ ہو اور ایک عالمی مرکز ہو یہ نہیں ہوگا، کیونکہ "یہ مرکز ہے اور تاقیامت مرکز ہے"۔

এ দুটি বিষয় ভিন্ন ভিন্ন নয় যে, আলমী মশওয়ারা ভিন্ন হবে এবং মারকায ভিন্ন হবে। এটা সম্ভব নয়, সম্ভব নয়, কিয়ামত পর্যন্ত সম্ভব নয়; একটা হবে আলমী মাশওয়ারা আর একটা হবে আলমী মারকায- এটা হতে পারে না। কারণ, এটিই (নিযামুদ্দীন) মারকায এবং কিয়ামত পর্যন্ত এটিই মারকায।

তিনি আরো বলেন-

شیطان نے ان لوگوں کو بڑی شکوک میں ڈالا ہوا ہے بڑی شکوک میں ڈالا ہوا ہے "سارے عالم کا یہ مرکز ہے اور سارےعالم کو یہاں سے رجوع کرنا ہے یہ اللہ کی طرف سے طئے شدہ بات ہے"۔

শয়তান এই লোকগুলোকে বড় সন্দেহে ফেলে দিয়েছে, বড় সন্দেহে ফেলে দিয়েছে। এটি (অর্থাৎ মারকায নিযামুদ্দীন) সারা বিশে^র মারকায। আর সারা বিশ্বকে এখানেই রুজু করতে হবে- এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে চূড়ান্ত কথা!!

নাউযুবিল্লাহ! কিসের ভিত্তিতে তিনি বললেন, কিয়ামত পর্যন্ত নিযামুদ্দীনই মারকায? শুধু তাই নয়, আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছেন-

یہ اللہ کی طرف سے طئے شدہ بات ہے

এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে চূড়ান্ত কথা!!

ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! এমন দলীলবিহীন গায়েবী কথা মানুষ কীভাবে বলে! তিনি দুআ করতে পারেন, আল্লাহ! আমাদের এই মসজিদকে, এই মারকাযকে কিয়ামত পর্যন্ত বাকি রাখুন! সব ধরনের বিদআত ও গোমরাহী থেকে হেফাযত করুন! কিন্তু একেবারে দলীল ছাড়া এমন গায়েবী কথা কীভাবে বললেন যে, কিয়ামত পর্যন্ত এটি মারকায এবং তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে চূড়ান্ত কথা!! মনে রাখুন, এ ধরণের গায়েবী কথা বলা এবং এ ধরনের মুখস্থ দাবির মাধ্যমে নিজের ভ্রান্তি ও গোমরাহীকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা কোনো গোমরাহ ও বিদআতী লোকেরই কাজ হতে পারে।

কোনো কোনো এতাআতী ভাই বলেন, নিযামুদ্দীন থেকে তাবলীগের কাজ শুরু হয়েছে। কাজেই সর্বাবস্থায় নিযামুদ্দীনেরই অনুসরণ করতে হবে। আরে ভাই! নিযামুদ্দীনের মিম্বর থেকে যত দিন হেদায়েতের কথা এসেছে আমরা তার অনুসরণ করেছি। কিন্তু যখন নিযামুদ্দীন থেকে অনবরত বিদআত ও গোমরাহীপূর্ণ কথা আসতে শুরু করেছে তখনও কি আমাদেরকে নিযামুদ্দীনের অনুসরণ করতে হবে- শুধু এ কারণে যে, এখান থেকে তাবলীগের কাজ শুরু হয়েছিল?! কোনো জায়গায় কোনো দ্বীনী কাজ আরম্ভ হলে সর্বদা তার অনুসরণ করে যেতে হবে; এমনকি সে জায়গা বিদআত ও গোমরাহীতে ছেয়ে গেলেও- একথার দলীল কী? কেউ দেখাতে পারবে একথার দলীল? কেউ দেখাতে পারবে না। এটা তো আরেক বিদআতী নীতি। এ নীতি সম্পূর্ণ শরীয়ত বিরোধী।

দেখুন, কুরআন-সুন্নাহকে আল্লাহ তাআলা শরীয়তের দলীল বানিয়েছেন; তাই কুরআন-সুন্নাহকে হেফাযত করেছেন। খুলাফায়ে রাশিদীন ও সাহাবায়ে কেরামের জামাআতকেও শরীয়তের দলীল ও হকের মাপকাঠি বানিয়েছেন; তাই তাঁদেরকেও হেফাযত করেছেন। অর্থাৎ যেসব বিষয়কে আল্লাহ তাআলা শরীয়তের দলীল ও হকের মাপকাঠি বানিয়েছেন সেসব বিষয়কে তিনি হেফাযতও করেছেন। আর যেসব বিষয়কে শরীয়তের দলীল বা হকের মাপকাঠি হিসেবে স্বীকৃতি দেননি সেসব বিষয়কে তিনি হেফাযতের নিশ্চয়তাও দেননি।

কোনো মসজিদ, দ্বীনী মাদরাসা বা প্রতিষ্ঠানকে আল্লাহ তাআলা হকের মাপকাঠি বানাননি। তাই কোনো মসজিদ, মারকায বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একথা নিশ্চিতভাবে বলার অবকাশ নেই যে, কিয়ামত পর্যন্ত তা হেদায়েতের মারকায থাকবে এবং এর ভিত্তিতে হক নির্ণয় করা হবে; যারা এর অনুসরণ করবে তারা হক আর যারা অনুসরণ করবে না তারা না-হক; বরং পুরো বিষয়টি শরীয়তের দলীল ও শরীয়ত প্রদত্ত মানদ-ের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ যতদিন হক ও সুন্নাহর উপর থাকবে ততদিন তা অনুসরণযোগ্য থাকবে।

আর যখন হক ও সুন্নাহ থেকে সরে গিয়ে বিদআত ও গোমরাহীতে নিপতিত হবে তখন তা আর অনুসরণীয় থাকবে না। দুনিয়াতে কত মসজিদ বা দ্বীনী প্রতিষ্ঠান এমন আছে, যেগুলো একসময় হেদায়েতের কেন্দ্র ছিল, অথচ এখন সেগুলো বিদআতী ও বাতিলপন্থীদের হাতে চলে গেছে। আল্লাহ তাআলা সকল মসজিদ সকল দ্বীনী মারকায ও প্রতিষ্ঠানকে হেফাযত করুন এবং কিয়ামত পর্যন্ত হক ও হেদায়েতের কেন্দ্র হিসেবে বাকি রাখুন- আমীন।

৪. যার মাধ্যমে দ্বীনের পথে এসেছে তার অন্ধ অনুসরণ করা

কোনো কোনো এতাআতী ভাইয়ের মুখে এ ধরনের কথাও শোনা যায় যে, ‘আমরা তো দ্বীনের পথে এসেছি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও সাধারণ পেশাজীবী দ্বীনদার তাবলীগী মানুষের দাওয়াতে। তাদের মেহনতে আমরা দ্বীন পেয়েছি এবং এই কাজ পেয়েছি। তাই তাদের সঙ্গেই আমরা থাকব। আমরা তো উলামায়ে কেরামের মেহনতে দ্বীন পাইনি। অতএব এখন কেন আমরা তাদের কথা শুনব? বরং যাদের মাধ্যমে দ্বীন পেয়েছি তাদের কথাই শুনব; তারা যেদিকে যাবে আমরাও সেদিকে যাব এবং তারা এতাআতী হলে আমরাও এতাআতী হব’, নাউযুবিল্লাহ।

ভাই! এটা কেমন কথা হল! দ্বীনের পথে তো মানুষ যে কোনো মাধ্যমেই আসতে পারে। এটা তাকভীনী বিষয়। যেমন এক ব্যক্তি বিদআতীদের দাওয়াত ও মেহনতে দ্বীনের পথে এসেছে বা দ্বীনের প্রতি আগ্রহী হয়েছে। এটা সম্ভব কি না এবং এর বাস্তবতা আছে কি না? আছে। তাহলে এখন তার কী করণীয়? সে কি চোখ বন্ধ করে বিদআতীদের সঙ্গেই থাকবে না দ্বীনের সহীহ ইলম ও সঠিক বুঝ অর্জন করে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সঙ্গে যুক্ত হবে? আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সঙ্গে যুক্ত হবে। এটাই শরীয়তের নির্দেশ। কিন্তু তা না করে যদি নতুন নীতি আবিষ্কার করে আর বলে, যার মাধ্যমে দ্বীন পেয়েছি তার কথাই শুনব, তাহলে কেমন হবে বিষয়টা? কর্তব্য হল, যার মাধ্যমে দ্বীন পেয়েছে তার শোকর আদায় করবে তার জন্য দুআ করবে এবং চেষ্টা করবে, সেও যেন গোমরাহী ছেড়ে হকের পথে চলে আসে। হাতে-পায়ে ধরে তাকে বোঝাবে। কিন্তু সেটা না করে যদি তার পেছনে ছুটে তাহলে কি শোকর আদায় হবে, না তার উপর যুলুম হবে? যুলুম হবে। কারণ সে তার অনুসরণ করে শরীয়ত পরিপন্থী যা কিছু করবে সবকিছুর গোনাহ তো তার উপরও বর্তাবে।

তাদের এ নীতিটা যে শরীয়ত-বিরোধী তা ভালোভাবে বোঝার জন্য আরেকটা দৃষ্টান্ত পেশ করছি। আপনারা জানেন, কাদিয়ানীরা মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য ইসলামের দায়ী সেজে দাওয়াত দিয়ে থাকে। অনেক অমুসলিম তাদের হাতে ইসলাম গ্রহণ করে। অনেক বে-নামাযী তাদের হাতে নামায শুরু করে।

পরে কারো কারো হুঁশ হয় যে, এরা আখেরী নবী ও দ্বীন শরীয়তের দুশমন। বলুন, হুঁশ হওয়ার পর তারা কী করবে? নিশ্চয়ই তাদেরকে ত্যাগ করে কাদিয়ানিয়াত থেকে তওবা করে মুসলামানদের সাথে মিলিত হতে হবে। আজকাল এতাআতী ভাইয়েরা যে নীতির কথা বলেন সে নীতি যদি সঠিক হয় তাহলে এ লোকদের তো সহীহ রাস্তায় আসার কোনো উপায় নেই। তারা বলবে, যাদের মাধ্যমে ইসলামের সন্ধান পেয়েছি এবং যাদের হাতে নামায শুরু করেছি আমরা তো তাদের সঙ্গেই থাকব। নাউযুবিল্লাহ। দেখলেন তো, ভুল নীতি মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়। তাই শরীয়তের উসুল হল, যেটা হক সেদিকে আমি নিজেও আসব এবং যার মাধ্যমে দ্বীন পেয়েছি তাকেও নিয়ে আসার চেষ্টা করব। এর বিপরীতে গোমরাহী নীতি হল, যার মাধ্যমে দ্বীন পেয়েছি তার সঙ্গেই থাকব। তার আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা ও নীতি-আদর্শে যতই গোমরাহী থাকুক না কেন; আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে গোমরাহীর সকল রীতিনীতি থেকে বাঁচার তাওফীক দান করুন- আমীন।

আর যে কথা তারা বলে বেড়াচ্ছে যে, তাদের দ্বীনের পথে আসার এবং তাবলীগের এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পেছনে নাকি উলামায়ে কেরামের অবদান নেই- এটা একদম বাস্তবতা বিরোধী কথা। যাদের ইতিহাস জানা আছে, তারা জানেন, এ দেশে তাবলীগের এই প্রচলিত মেহনতকে উলামায়ে কেরামই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। উলামায়ে কেরামের দুআ ও মেহনতের বরকতে এই দেশে তাবলীগের কাজ শুরু হয়েছে, বিস্তার লাভ করেছে এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নতুন প্রজন্মের অনেকে এই ইতিহাস জানে না। এ বিষয়টা স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে। আজকে শুধু একটু ইশারাই করলাম।

আমি অনেক দিন থেকেই একটা বিষয়ে বলতে ও লিখতে চেয়েছিলাম; কিন্তু তার আগেই সমস্যা শুরু হয়ে গেল। সেটা হল, অনেক তাবলীগী ভাই এমন ছিলেন, যারা শুধু সালওয়ালা মুফতী সাহেবের কাছে মাসআলা জিজ্ঞেস করতেন। কিন্তু আরেকজন আরো ভালো মুফতী, আরো বিজ্ঞ আলেম, তবু তার কাছে মাসআলা জিজ্ঞেস করতেন না; কারণ তিনি সালওয়ালা নন। অনেকে তো অন্যকেও উপদেশ দিত যে, শুধু সালওয়ালা আলেমকে মাসআলা জিজ্ঞেস করবে! এমন হয়েছে কি হয়নি? হয়েছে। অনেক হয়েছে। কাজটা কি ঠিক ছিল? না। মুফতী সালওয়ালা হোন বা সালছাড়া; জানার বিষয় হল, তিনি বাস্তবে মুফতী কি না? এমনিতে নামের মুফতী তো কত? সে বিষয়ে বলছি না। বলছি বাস্তবে মুফতী হওয়া সত্ত্বেও শুধু সালওয়ালা না হওয়ার কারণে তার কাছে মাসআলা জানতে চাওয়া হবে না- এমন মাসআলা কি আছে শরীয়তে? নেই।

আমি এ বিষয়ে লিখতে ও বলতে চেয়েছিলাম; কিন্তু তার আগেই সমস্যা শুরু হয়ে গেল। এখন দুঃখ হল, আগে তো বলা হত, আলেম যদি সালওয়ালা হন তাহলে তার কথা শোনা যাবে। কিন্তু এখন? মাওলানা যোবায়ের ছাহেব ও মাওলানা রবিউল হক ছাহেব সালওয়ালা আলেম কি না? তারা এবং একসঙ্গে আরো যেসকল আলেম আছেন কাকরাইলে, রায়বেন্ডে ও প্রকৃত নিযামুদ্দীনে, তারা সালওয়ালা আলেম কি না? সালওয়ালা আলেম। প্রকৃত নিযামুদ্দীনের অর্থ বুঝেছেন তো? প্রকৃত নিযামুদ্দীন কি এখন বস্তি নিযামুদ্দীনের ভেতরে না বাইরে? বাইরে। প্রকৃত নিযামুদ্দীন তো তারা, যারা নিযামুদ্দীনের আদর্শকে ধরে রেখেছেন; অর্থাৎ যারা হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ., হযরত মাওলানা ইউসুফ রাহ. ও হযরত মাওলানা এনামুল হাসান রাহ.-এর যামানার নিযামুদ্দীনের আদর্শকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করেছেন। কেননা তারাই হলেন নিযামুদ্দীনের ওয়ারিস। যেখানেই থাকুন, তারাই নিযামুদ্দীনের প্রকৃত ওয়ারিস।

... وَ مَا كَانُوْۤا اَوْلِیَآءَهٗ اِنْ اَوْلِیَآؤُهٗۤ اِلَّا الْمُتَّقُوْنَ وَ لٰكِنَّ اَكْثَرَهُمْ لَا یَعْلَمُوْنَ.

তাফসীর আর এখন করলাম না। ইশারা করে দিলাম; যারা আলেম আছেন তারা বুঝবেন। দখলে থাকলেই অভিভাবক হওয়া যায় না। অভিভাবক তো সে, যে আদর্শকে ধরে রেখেছে।

নিযামুদ্দীনের আদর্শ হল কুরআন-সুন্নাহর সঠিক অনুসরণ করা এবং দ্বীন ও শরীয়ত এবং দাওয়াত ও তাবলীগের ক্ষেত্রে সালাফ ও আকাবিরের মুতাওয়ারাসা ও যুগ পরম্পরায় চলে আসা উসূল ও তরীকাকে আঁকড়ে ধরা। সুতরাং যারা মুজতাহিদসুলভ ভঙ্গি নিয়ে দলীল-প্রমাণের ভুল প্রয়োগ ও শরয়ী নুসূসের অপপ্রয়োগ করে এবং তাবলীগী কাজের সংস্কারের নামে সালাফ ও আকাবিরের উসূল ও তরীকাকে বাদ দিয়ে নতুন নতুন বিদআতী উসূল আবিষ্কার করে তারা কখনো নিযামুদ্দীনের ওয়ারিস নয়।

তো বলছিলাম, মাওলানা যোবায়ের ছাহেব, মাওলানা রবিউল হক ছাহেব এবং একসঙ্গে আরো যেসকল আলেম আছেন কাকরাইলে, রায়বেন্ডে ও প্রকৃত নিযামুদ্দীনে, যারা নিজেদের জিন্দেগীটা ওয়াকফ করে দিয়েছেন তাবলীগের জন্যে, এখন কোন্ যুক্তিতে আপনারা তাদের কথা শুনছেন না? তাদের ছেড়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদেরকে কোন্ যুক্তিতে প্রাধান্য দিচ্ছেন? উত্তর দিন। এসব ভাবলে দুঃখে আমার কলিজা ফেটে যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হক বোঝার তাওফীক দান করুন- আমীন।

৫. সুন্দর আচরণ

সেদিন এক ভাই আমাকে বললেন, আগে এতাআতী ছিলাম, এখন এদিকে এসেছি। ঠিক আছে, এটা হক। তবে একটা কথা আপনাকে বলি। সেখানে কিন্তু মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হয়। কেউ মশওয়ারা দিলে তার মশওয়ারার গুরুত্ব দেওয়া হয়। অথচ এখানে অতটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আরেকটা হল, সেখানে সুন্দর ও ভালো ব্যবহার পাওয়া যায়।

কিন্তু এখানে তেমন সুন্দর ও ভালো ব্যবহার পাওয়া যায় না। আমি সবার কথা বলছি না; আমার আশপাশের কথা বলছি। আমি বললাম, এটা আমাদের ত্রুটি। আমাদের সংশোধন হতে হবে এবং ব্যবহার ভালো করতে হবে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, কারো আচার-ব্যবহার ভালো হলেই সে হকের উপর আছে একথা বলা যায় না। ব্যবহার সুন্দর হওয়া ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। কিন্তু কারো ব্যবহার সুন্দর, সেজন্য সে হকের উপর আছে- এমন কথা কুরআন-হাদীসের কোথাও নেই। কত বে-ঈমান, অমুসলিম, কাফের আছে, যার আখলাক ও সূরত দেখে আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। কিন্তু আপনি যতই মুগ্ধ হোন, কাফের কিন্তু কাফেরই!

তো ঈমান-কুফরের ক্ষেত্রে যে কথা, সুন্নত-বিদআত এবং হক-বাতিলের ক্ষেত্রেও সে কথা। বিদআতীর কথাবার্তা ও আমল-আখলাক আকর্ষণীয় হলেই সে হক হয়ে যাবে না। তার বিদআত বিদআতই থাকবে। কারণ সুন্দর বয়ান সুন্দর আখলাক ও সুন্দর মেহনমানদারি- এগুলো সবই ভাল কাজ; কিন্তু এগুলোর কোনোটিকেই শরীয়ত হক নির্ণয়ের মাপকাঠি বানায়নি।

৬. কোনো বিশেষ খান্দান

কেউ আবার হক-বাতিলের মাপকাঠি মনে করে বিশেষ খান্দানকে। বলে, অমুক খান্দান হকের মাপকাঠি। মনে রাখতে হবে- এটাও শরীয়ত-বিরোধী নীতি।

কোনো খান্দান যদি হকের মাপকাঠি হত তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খান্দানকেই হকের মাপকাঠি হিসেবে ঘোষণা করা হত। কিন্তু কুরআন-সুন্নাহয় তা করা হয়নি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কোনো ঘোষণা দেননি। বরং এর বিপরীতে কুরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরতে বলেছেন এবং নিজের খান্দানকেও এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বলেছেন।

এখন তো শোনা যাচ্ছে, কেউ কুরাইশ বংশের হওয়াকেও তার হক হওয়া ও অনুসরণীয় হওয়ার দলীল হিসেবে পেশ করা হচ্ছে। তাদের হয়ত খবর নেই, আবু লাহাব ও আবু জাহলও কুরাইশ বংশের ছিল এবং তারা হয়ত এটাও ভুলে গিয়েছে, কোনো খান্দানকে হক ও অনুসরণীয় হওয়ার মাপকাঠি বানানো এটা শীয়াদের নীতি, মুসলমানদের নীতি নয়।

কথা দীর্ঘ হয়ে গেল। সংক্ষেপে বলছি, কাফের-মুশরিকদের এবং বাতিল ফেরকাগুলোর জাহেলি নিয়ম-নীতির কোনো শেষ নেই। জাহেলি নিয়মনীতি কিন্তু অনেক। কুরআন-হাদীসে ওসব জাহেলি নিয়ম-নীতিকে খ-ন করা হয়েছে। এখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি মাত্র।

مَنْ بَطّأَ بِهِ عَمَلُهُ، لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ.

আমল যাকে পিছিয়ে রেখেছে বংশ তাকে এগিয়ে নিতে পারে না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯৯

এবার বলুন, কারো আকীদা-বিশ্বাস এবং চিন্তা-চেতনায়-ই যদি তাকে পিছিয়ে রাখে তাহলে তার বংশ কি তাকে এগিয়ে নিতে পারবে?

এ প্রসঙ্গে বলার আরো অনেক কিছু আছে। কিন্তু এখন সময় নেই। সংক্ষেপে কথা হল, কুরআন-সুন্নাহর মানদ-ের ভিত্তিতে বিচার করুন। জাহেলিয়্যাতের নিয়মনীতি থেকে বেঁচে থাকুন এবং নিজ থেকেও নিয়মনীতি আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকুন।

৭. সাধারণ জনতার ঢল

সাধারণ জনতার ঢলও মাপকাঠি নয়। সাধারণদের মধ্যে ঐ বিশিষ্টজনরাও আছেন, যাদের জাগতিক শিক্ষা আছে, পদ আছে, ক্ষমতা আছে, কিন্তু দ্বীনী ইলম নেই, শরীয়তের উসূল ও হকের মি‘য়ার সম্পর্কেও সঠিক ইলম নেই; তারাও শরীয়তের দৃষ্টিতে সাধারণ। এরা কোনো পক্ষ গ্রহণ করার বিশেষ কোনো গুরুত্ব নেই। যদি এরা আহলে হকের পক্ষ গ্রহণ করে থাকে তো এটা তাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। অপরটা হয়ে থাকলে তা আফসোসের বিষয়। তাদের মুহাসাবা করা উচিত। বোঝা উচিত, এটা হয়ত ইংরেজি শিক্ষার কুপ্রভাব যা তারা তাবলীগে এসেও দূর করতে সক্ষম হয়নি।

যারা শরীয়তের দলীল দিয়ে হক-বাতিলের বিশ্লেষণ করতে জানেন তারা বুঝেন, এমন জনতার ঢলকে দলীল ও মাপকাঠি বানানো যায় না। হাঁ, এ জনতার ঢল যদি হকের পক্ষে থাকে, আল্লাহর শোকর করা এবং বলা- আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহ এদেরকে সহীহ রাস্তায় রেখেছেন। কিন্তু এই ঢল যদি বিদআতীদের পক্ষে চলে যায় এবং ভুল রাস্তা অবলম্বন করে, সেজন্য বিদআতীরা যদি বলে, জনতার ঢল যেহেতু আমাদের দিকে তাই আমরা হক- তাহলে কি তা সহীহ হবে? কখনো না।

কারণ সাধারণ জনতার ঢলকে শরীয়ত মাপকাঠি বানায়নি। মাপকাঠি বানিয়েছে সুন্নতের অনুসারী অধিকাংশ আহলে হক উলামায়ে কেরামের একমত হওয়াকে। عَلَيْكُم بِالسّوَادِ الأَعْظَمِ বলে এই ‘সাওয়াদে আ‘যম’-এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আপনারা ‘জুমহুর উলামায়ে কেরাম’ এই শব্দটা শুনেছেন কি না? এই শব্দ দ্বারা ‘সাওয়াদে আ‘যম’ই উদ্দেশ্য। এখন তো অনেকে জুমহুর বলে ব্যঙ্গ করে। হায়, ব্যঙ্গ যে করে, কী বুঝে ব্যঙ্গ করে- আল্লাহই ভালো জানেন? জুমহুর অর্থ অধিকাংশ। প্রশ্ন হল, কাদের অধিকাংশ? কাফেরদের অধিকাংশ? মুনাফিকদের অধিকাংশ?

বিদআতীদের অধিকাংশ? মুর্খদের অধিকাংশ? সাধারণ মানুষদের অধিকাংশ? কাদের অধিকাংশ- সেটা বুঝতে হবে তো? বলা হয়েছে, জুমহুর উলামায়ে কেরাম। মানে, আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের অধিকাংশ। এখন বলুন, এই জুমহুরকে যদি কেউ কাফের, মুশরিক, মুনাফিক ও বিদআতীদের জুমহুরের সঙ্গে মিলিয়ে দেয় তাহলে তা বিকৃতি কি না? অবশ্যই বিকৃতি। কারণ জুমহুর উলামায়ে কেরাম এরা হলেন হকের তরজুমান ও মুখপাত্র।

কিন্তু ‘জুমহুরুন নাস’, যারা দলীলের আলোকে হক-বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করতে জানে না। তারা কিন্তু হকের তরজুমান নয়। হকের মাপকাঠি এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটা খেয়াল রাখুন। শরীয়ত নির্ধারিত মাপকাঠিতে যারা উত্তীর্ণ তারাই হকের উপর আছে। এর বাইরে যত কল্পিত মাপকাঠি আছে সেগুলোর কোনো মূল্য নেই। তাই কেউ যদি শরীয়ত নির্ধারিত মাপকাঠির পরিবর্তে কল্পিত অন্য কোনো মাপকাঠি দিয়ে হক নির্ণয় করতে যায় তাহলে তার বাতিল হওয়াটা আমাদের কাছে আরো স্পষ্ট হয়ে যাবে।

এখন আপনারাই চোখ বুলিয়ে দেখুন, কারা নতুন নতুন মাপাকঠি দিয়ে নিজেদেরকে হক সাব্যস্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছে। তাবলীগের এ নতুন সংকটের মধ্য দিয়ে একটা বিভক্তি তৈরি হয়েছে কি না? হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত একটা বিভক্তি। আমরা এ বিভক্তি চাই না। আমরা চাই, সবাই এক হয়ে যাক, তবে হকের ভিত্তিতে। হকের ভিত্তিতে সবাই এক হয়ে যাক। কিন্তু তা না করে যারা নিজেদের গলত রাস্তাকে সহীহ প্রমাণ করার জন্য নতুন নতুন মাপকাঠি আবিষ্কার করছে তারা নিজেদেরকে আরো ডুবাচ্ছে কি না? অবশ্যই।

কথা অনেক হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সহীহ বুঝ দান করুন এবং হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফীক দান করুন- আমীন।

হাঁ, আরেকটা কথা বলি। সেটা হল, বিভক্তি ও দ্বন্দ্বের কারণে আমাদের কাজ দুর্বল হয়ে গেছে । দ্বন্দ্ব হলে তো কাজ দুর্বল হবেই। কাজ দুর্বল হয়ে গেছে, এটা আফসোসের বিষয়। তবে এ কারণে হীনম্মন্যতায় ভুগবেন না। কাজ একদিকে দুর্বল হলেও আরেকদিকে মজবুত হচ্ছে। পুরো দেশ এবং পুরো বিশ্বের খবর রাখবেন। কাজ একদিকে কমছে ঠিক, কিন্তু আরেকদিকে বাড়ছে হক তরিকায়। আমি সহীহ তরিকার কথা বলছি। তবে এটাও ঠিক যে, অনেক জায়গায় কাজ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

এজন্য আমাদের মেহনত বাড়াতে হবে। কাজকে মজবুত করতে হবে। আপনি কাজে নিমগ্ন হোন। পাঁচ কাজে নিমগ্ন হোন। আগে যেভাবে করতেন, এরচে’ অনেক গুরুত্বের সাথে পাঁচ কাজ করুন। ইনশাআল্লাহ কাজ দুর্বল হবে না। নতুন সাথীরা বেশি সতর্ক থাকুন, আপনাদেরকে সহজে খপ্পরে ফেলে অনেকে নিয়ে যেতে চাইবে। পুরনো সাথীরাও সতর্ক হোন! কারণ তাদের অনেকেও ধোঁকার শিকার হচ্ছেন।

খবরদার! হকের মাপকাঠি কুরআন-সুন্নাহর আলোকে বলা হল। সে মাপকাঠিতে যারা হকের উপরে আছেন আপনারা তাদের সঙ্গে থাকুন, দাওয়াতের কাজ করুন এবং উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দ্বীনের সোহবত গ্রহণ করুন। নিজের সময়কে ভাগ করে নিন। বিশেষকরে কলেজ-ভার্সিটির সাথী যারা, আপনারা সবাই রুটিন করে কাজ করুন, যেন আপনাদের প্রাতিষ্ঠানিক যে পড়াশোনা সেটা দুর্বল না হয়ে পড়ে। আবার কাজও যেন ঠিকমতো চলে। এটা সম্ভব। রুটিনমাফিক কাজ করলে আল্লাহ সময়ে বরকত দিবেন ইনশাল্লাহ।

কিন্তু একটা করতে গিয়ে যদি আরেকটা ভুলে যান তাহলে হবে না; বরং বে-বরকতি হবে আর আপনার কারণে অন্যরা তাবলীগ থেকে দূরে সরে যাবে। অতএব আপনি এমন তাবলীগী ছাত্র হোন, আপনাকে দেখে যেন আরো দশ জন চিল্লা দিতে চলে আসে। আর আপনার ছাত্রত্ব ও পড়াশোনা যদি দুর্বল হয়ে যায়, ফলাফল কাক্সিক্ষত না হয় কিংবা অন্যদের সাথে আপনার আচরণ ভিন্ন রকমের হয়ে যায় তাহলে মানুষ বলবে, দেখ, তাবলীগে গেলে এরকম হয়ে যায়। তাবলীগে গেলে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। তাবলীগে গেলে পরীক্ষার ফলাফল ভালো হয় না।

এজন্য সে আর তাবলীগে যাবে না। কাজেই আপনি একজন আদর্শ তাবলীগী সাথী হোন। তার পদ্ধতি হল আপনি রুটিন তৈরি করে রুটিনমাফিক কাজ করুন। প্রয়োজনে আপনার কোনো অভিজ্ঞ পুরনো সাথীর সঙ্গে মশওয়ারা করুন।

পুরনো আলেম সাথী হলে বেশি ভালো। তাঁর সাথে মশওয়ারা করে আপনার পুরো বছরের, পুরো সেমিস্টারের, পুরো মাসের এবং পুরো দিনের রুটিন তৈরি করুন। যদি রুটিনমাফিক কাজ করেন, সব কাজ ঠিকমতো হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন- আমীন। সূত্র: আল কাউসার

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ