নুরুদ্দীন তাসলিম।।
রবিউল আউয়াল অর্থ প্রথম বসন্ত। ঘটনা-দুর্ঘটনা স্মৃতি বিজড়িত এ মাসেই পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন মানবতার মুক্তিরদূত নবীজি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এ মাসেই তাঁর ওপর অর্পিত রিসালাতের দায়িত্ব পালন শেষে আপন রবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন তিনি।
এ মাসটি মুসলিম উম্মাহর জন্য স্মৃতিবিজড়িত ও গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ মাসকে ঘিরে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের নামে ছড়িয়ে পড়েছে নানা বিভ্রান্তি। শরীয়তের পরিভাষায় যাকে বেদয়াত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো এ মাসের ১২ তারিখকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম-এর জন্মদিন হিসেবে পালন করা এবং সে উপলক্ষে ঢোল তবলা ও বিভিন্ন র্যালির আয়োজন করা।
‘জন্মদিন উদযাপন ইসলামে স্বীকৃত নয়’
জন্মদিন উদযাপন ইসলাম স্বীকৃত কোন বিষয় নয়। ইতিহাসবিদদের মতে ইসলাম-পূর্ব বাইবেল, রোমান ও গ্রীক সভ্যতায় জন্মদিন পালনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। স্বভাবতই ইসলামী শরীয়তে নেই এমন কাজকে কখনোই সমর্থন করেন না আলেম সমাজ। ঢোল তবলাসহ বিভিন্ন বাদ্যের সাথে যখন বিষয়টিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম-এর পৃথিবীতে আগমনের দিন হিসেবে বিশেষভাবে উদযাপন করা হয় -এর কঠোর সমালোচনা করে থাকেন ইসলামী চিন্তাবিদগণ। একে গর্হিত কাজ বলেও অভিহিত করেন তারা।
তবে রবিউল আউয়াল মাস নিয়ে সমাজে ‘প্রতিষ্ঠিত’ এসব বিভ্রান্তি দূর করতে সূচনা থেকেই কাজ করে যাচ্ছেন আহলে হকের মশালধারী আলেম সমাজ। এক্ষেত্রে জুমার মেম্বার থেকে বয়ানের মাধ্যমে বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছেন সমাজের খতিবগণ।
‘জুমার খুতবা ও বয়ানে বিষয়ভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি’
বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি নিরসন ও সচেতনতা তৈরিতে কিভাবে কাজ করে চলেছেন সমাজের খতিবগণ এবং আরো কিভাবে কাজ করতে পারেন? এ বিষয়ে রাজধানীর বিসিএসআইআর (সাইন্স ল্যাবরেটরী) কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মুফতি শামসুদ্দোহা কাসেমীর মুখোমুখি হলে তিনি বলেন, ‘জুমার খুতবা ও বয়ানে বিষয়ভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টিতে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করা যায়। এভাবে দেশের খতিবগণ কার্যকর ভূমিকা রাখছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি’।
তার মতে, ‘দ্বিতীয় পর্যায় হিসেবে সিরাত কেন্দ্রিক আলোচনা অন্যতম ফলপ্রসূ উপায়। তবে সিরাত কেন্দ্রিক আলোচনাগুলো শুধু রবিউল আউয়াল মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকা কাম্য বলে মনে করেন তিনি’।
‘গঠনমূলক কাজ এবং দালিলিক প্রমাণ দিয়ে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করা উচিত। তবে এক্ষেত্রে আক্রমনাত্মক ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার পন্থায় না যাওয়াই উত্তম’- তার মতে।
তার মতে, ‘রবিউল আউয়াল মাসকে ঘিরে যারা বিভিন্ন বেদয়াত ও এ জাতীয় কাজে জড়িয়ে পড়েছেন, তারা মূলত নবীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়েই এসব করছেন। সবাই হৃদয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালোবাসা লালন করেন। তবে প্রকাশের সঠিক পন্থা না জানার কারণে অনেকেই বেদয়াত মূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছেন’। তাই তাদের আবেগকে তাচ্ছিল্য না করে ভালোবাসা প্রকাশে যে ত্রুটি রয়েছে তা সংশোধনের চেষ্টা করা উচিত’।
মুফতি শামসুদ্দোহা কাসেমীর মতে, ‘কোন খতিবের পক্ষে এসব নিয়ে মিম্বারে আলোচনা করা সম্ভব না হলে তিনি কমিটির সাথে আলাদাভাবে বসে এবং ব্যক্তিগতভাবে মুসল্লিদের সাথে কথা বলেও বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করতে পারেন’।
‘সিরাতের সঠিক চর্চা প্রয়োজন’
মুফতি শামসুদ্দোহা কাসেমীর মত ঢাকা কেরানীগঞ্জের বরিশুর দারুন নাঈম জামে মসজিদের খতিব মুফতি নাজমুল হক সাকিবও মনে করেন, রবিউল আউয়াল মাস নিয়ে সমাজে প্রচলিত বিভ্রান্তি ও বেদয়াত দূর করতে খুতবাই সচেতনতা তৈরির অন্যতম মাধ্যম।
তবে তার মতে, ‘সচেতনতা তৈরীর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও লক্ষণীয় বিষয় হলো; বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির পন্থা বাদ দিয়ে মধ্যম অবলম্বন কর ‘।
‘এছাড়া সামাজিক বিভিন্ন ইভেন্টে সিরাত চর্চা, সিরাত নিয়ে প্রতিযোগিতা ও বিভিন্ন আলোচনর ক্ষেত্র তৈরি করা যেতে পারে’।
মুফতি সাকিবের ভাষায়, ‘রবিউল আওয়ালে সিরাত সংক্রান্ত আলোচনা হবে না, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্মরণ করা হরে না, আমরা এমন বলতে চাই না; তবে সিরাতের নামে ‘প্রতিষ্ঠিত’ বেদয়াত দেখতে চাই না’।
‘দেশের ওয়াজ মাহফিলের স্টেজগুলো সিরাত চর্চা ও এসব বিভ্রান্তি নিরসনের অন্যতম ক্ষেত্র হতে পারে বলে মতামত দিয়েছেন তিনি’।
তার মতে, ‘আমাদের দেশের ওয়াজ মাহফিলের মঞ্চে গুলোতে গঠনমূলক আলোচনা আরো বাড়ানো দরকার এবং এক্ষেত্রে সিরাত চর্চা বিষয়গুলোর দিকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে’।
সচেতনতা তৈরি করতে গিয়ে কি ধরণের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন খতিবগণ?
রবিউল আউয়াল মাস নিয়ে ছড়িয়ে পড়া বিভ্রান্তি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে গিয়ে খতিবদের কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় কিনা-এ বিষয়ে মুফতি শামসুদ্দোহা কাসেমী বলেন, ‘প্রতিবন্ধকতা শুধু রবিউল আউয়াল মাস কেন্দ্রিক আলোচনাগুলোর ক্ষেত্রেই নয়, বর্তমানে প্রায় সব বিষয়েই খতিবদের বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়; তবে এক্ষেত্রে শব্দচয়নে কৌশল অবলম্বন; আক্রমণাত্মক ভাব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলেই প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা র মুখোমুখি হওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারেন খতিবগণ’।
এদিকে মুফতি নাজমুল হক সাকিবের মতে প্রতিবন্ধকতা তৈরীর বিষয়টি আপেক্ষিক। এটা নির্ভর করে মসজিদভিত্তিক সমাজের উপর। যেখানে কমিটি এবং এলাকার মানুষজন এসব কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত সেখানে আলোচনা করার ক্ষেত্রে খতিবদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আর সমাজ এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত না থাকলে বেগ পেতে হয় না খতিবদের।
তবে তিনি মনে করেন, ‘বর্তমানে দেশের মূলধারার ইসলামপন্থীরা নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত, তাই রবিউল আউয়াল মাস, সিরাত চর্চা নিয়ে বিভ্রান্তি সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে সমস্যা তৈরির সম্ভাবনা থাকলে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো’।
এটি