ইসমাইল মাদানি।।
মদিনা মুনাওয়ারা, সৌদী আরব থেকে>
সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য, যিনি মানুষের কাছে সুস্পষ্ট ভাবে বিধিবিধানকে বর্ণনা করে দিয়েছেন।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ রব্বুল আলামীন ছাড়া প্রকৃত কোন মাবুদ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও প্রেরিত রসূল। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম এবং তার পরিবারবর্গের উপর শান্তি রহমত ও বরকত বর্ষন করুন।
অতঃপর হে মুসলিমগন! আপনারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে যথাযথভাবে ভয় করুন এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের তাকওয়া অবলম্বন করুন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর এবং প্রকৃত মুমিন না হয় কোন অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করো না। সুরা আলে ইমরান, আয়াত -১০২
হে মুসলমানগন! আপনারা সুপথকে প্রকাশ করুন ভ্রান্ত পথ থেকে। সত্যকে পৃথক করুন মিথ্যা থেকে। পার্থিব ভোগ বিলাসিতা ও চাকচিক্যতার প্রতি আসক্তি যেন আপনাকে পরকালের প্রস্তুতি থেকে দূরে সরিয়ে না রাখে।
তাদের মত হবেন না, যারা আল্লাহ সম্পর্কে ধোঁকায় পতিত আছে। যারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিশাল দয়া ও নেয়ামতের প্রবঞ্চনায় পড়ে তার ক্ষমা লাভের আশায় আল্লাহর করুণা ও ক্ষমার উপর ভরসা করে একের পর এক নিষিদ্ধ কাজে জড়িত হয়ে নানাবিধ অন্যায় ও অশ্লীল কাজে আবির্ভূত হয় ও হারাম কাজ করে। আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ অমান্য করে।
সৎ কাজ পরিত্যাগ করে এবং অনবরত অন্যায় ও অবাধ্যতামূলক কাজ করেই চলে। যখন তাদেরকে তাদের অপরাধের জন্য তিরস্কার করা হয় বা অন্যায় কাজে বারণ করা হয় এবং নসিহত করা হয় তখন তারা আশাব্যঞ্জক দলিলের দ্বারস্থ হয় এবং সেগুলোর উপর নির্ভর করে।
তাই তারা বলতে থাকে তারা ক্ষমা লাভের আশা করে।
অথচ প্রকাশ্যে অন্যায় করে বেড়ায় এবং তওবা করতে গড়িমসি করে, নসিহত অপছন্দ করে এবং পাপ কাজে অবিচল থাকে। একই রকম অন্যায় কাজে বারবার জড়িত হয় অথচ তওবা করে না। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউত বলে, যত পারো পাপ করো, পরম করুণময় আল্লাহ রব্বুল আলামীনের নিকটতই ফিরে যাব।
এমন স্বভাব ও কাজত প্রতারিত ও প্রবঞ্চিতদের এবং অন্যায়ে অবিচল ও হঠকারীদের। এরা সতর্কবাণীকে তুচ্ছ জ্ঞানকারী ঐসকল দুর্ভাগা, যাদেরকে মিথ্যুক ও প্রতারক শয়তান প্ররোচিত করেছে। অসৎ কাজ, উদাসীনতা ও পাপাচার এবং প্রবৃত্তির অনুসরণে প্রলুব্ধ করেছে।
শয়তান তাদেরকে অসৎ পথে পরিচালিত করছে। দুঃখ ও আফসোসে পতিত করছে।
মিথ্যা ও ধোকর দিকে প্ররোচিত করছে এবং তাদেরকে ব্যর্থ ও মিথ্যা আশায় নিমজ্জিত করে রাখছে। এ ধরনের লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, অতঃপর তাদের পরে স্থলাভিষিক্ত হয়েছে এমন অযোগ্য বংশধর, যারা উত্তরাধিকারী হয়েছে, তারা এ তুচ্ছ দুনিয়ার সামগ্রী গ্রহণ করে এবং বলে আমাদেরকে তো শীঘ্রই ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সুরা আরাফ, আয়াত ১৬৯।
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুজাহিদ রহিমাহুল্লাহ বলেন বস্তুতঃ দুনিয়ার যে বস্তুতেই তাদের চোখ পড়বে সেটা হালাল বা হারাম যাই হোক না কেন সেটাই তারা গ্রহণ করবে তারপর তারা ক্ষমার তালাশে থাকে আর বলে শীঘ্রই আমাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হবে।
ইমাম কুরতুবী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই সমস্ত লোকদেরকে তিরস্কার করেছেন তাদের উক্তির জন্য যে, শীঘ্রই আমাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। এ কথার দ্বারা প্রতারিত হবার কারণে তারা এরপরেও অসৎ কাজে জড়িত থাকে।
বস্তুত শীঘ্রই আমাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হবে একথা বলবে তো সেই ব্যক্তি যে পাপ কাজ পরিহার করে ও অনুতপ্ত হয়। যে অভ্যাসের কারণে আল্লাহ রব্বুল আলামীন ঐ সমস্ত লোকদের সমালোচনা করেছেন এবং তিরস্কার করেছেন তা আমাদের মধ্যেও বিদ্যমান রয়েছে।
মুয়াজ বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন কাপড় যেমন পুরাতন ও ক্ষয় হয় তেমনি ভাবে কোরআন ও কিছু লোকের হৃদয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। তারা কোরআন পাঠ করবে কিন্তু তাতে তৃপ্তি পাবে না। তারা ভেড়ার চামড়ার মত নরম ও কোমল পোশাক ব্যবহার করবে কিন্তু তাদের অন্তর হবে নেকড়ে বাঘের মত হিংস্র।
তাদের কার্যকলাপ হবে লোভ-লালসায় ভরপুর। তাদের অন্তরে কোন ভয় থাকবে না। তারা ত্রুটি করলেও বলে অচিরেই লক্ষ্যে পৌঁছ যাবে আর অন্যায় ও ভুল করলে বলে শীঘ্রই আমাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হবে এবং আমরা তো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর সাথে কোন শিরিক করি নাই।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা যদি গুনাহ না করতে তাহলে তোমাদেরকে বাদ দিয়ে এমন জাতি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সৃষ্টি করতেন যারা গুনা করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট ক্ষমা চাইত আর তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন।
এই হাদিস সম্পর্কে ফজলুল্লাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি কে সান্তনা দিতে এবং অন্তরের গভীরে বিষয়টিকে তুচ্ছ করে তুলতে বা এমন অঘটন কে ছোট ভাবাতে এই হাদীসটি আসেনি, যেমনটি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সম্পর্কে ধোকায় নিমজ্জিত ব্যক্তিরা ধারণা করে থাকে।
কেননা নবী-রাসূলগণ প্রেরিত হয়েছেন মানুষকে পঙ্কিলতার আবর্জনা ও তাতে নিজেদেরকে লাগামহীনভাবে ছেড়ে দেয়া থেকে বিরত রাখতে।
বরং হাদীসটি এসেছে পাপীদেরকে আল্লাহর ক্ষমা ও সুন্দরভাবে মার্জনার বিষয়টি বর্ণনা করতে, যাতে তারা তওবা ও ইস্তেগফার এর দিকে প্রবলভাবে আগ্রহী হয়ে উঠে।
হাদীসটির ভাব অর্থ হচ্ছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেমনভাবে সৎকর্মশীল বান্দার প্রতি ইহসান করা পছন্দ করেন, তেমনিভাবে পাপীদেরকেও ক্ষমা ও মার্জনা করতে পছন্দ করেন।
ইবনুল কাইয়ুম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আশা তিন রকমের। দু'রকমের আশা প্রশংসনীয়, আর এক রকমের আশা ছলনাময়ী ও নিন্দনীয়। প্রথম দুটির মধ্যে একটি হলো সেই ব্যক্তির আশা, যে ব্যক্তি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হেদায়েত ও নূরের উপর অবিচল থাকে ও তার আনুগত্য করে চলে এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট তার প্রতিদান ও নেকির আশা রাখে।
দ্বিতীয়টি হল কোন ব্যক্তি গুনাহ করে তা থেকে যথাযথভাবে তওবা করে আর সে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের ক্ষমা,মার্জনা, দয়া ও করুণা এবং ইহসান পাওয়ার আশা পোষণ করেন।
আর তৃতীয় প্রকার আশার উদাহরণ হল, ওই ব্যক্তির আশা, যে ব্যক্তি পাপাচার ও সীমালঙ্ঘনে জড়িত ও অবিচল রয়েছে এবং সৎকাজ না করেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট রহমতের আশা পোষণ করে। এমন আশাই ছলনাময়ী প্রতারণা ও মিথ্যা আশা।
হাসান বসরি রহিমাহুল্লাহ বলেন, একদল মানুষকে অলিক আকাঙ্ক্ষা মহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল, অবশেষে তারা পৃথিবী থেকে বিদায় নিল এমন অবস্থায় যে, তাদের কোন সৎকর্ম ই ছিল না। তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বলত যে আমি আমার রবের প্রতি সুধারণা রাখি অথচ সে তার দাবির প্রতি মিথ্যাবাদী ছিল, কেননা সে যদি তার দাবিতে সত্যবাদী হত তাহলে সে সৎ আমল করত। তারপর তিনি এই আয়াতটি পাঠ করলেন, আর তোমাদের রব সম্পর্কে এ ধারণাই তোমাদেরকে ধ্বংস করেছে, ফলে তোমরা হয়েছ ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। সুরা হামিম সাজদাহ, আয়াত ২৩।
সাঈদ বিন জুবায়ের রদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সম্পর্কে ধোকায় পতিত হওয়া বলতে পাপ কর্ম অব্যাহত রাখা সেই সাথে ক্ষমা প্রত্যাশাকে বুঝায়।
ইয়াহিয়া বিন মুয়াজ রহিমাহুল্লাহ বলেন, বড় ধোকা হচ্ছে, পাপ কাজ অব্যাহত রেখে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট ক্ষমা প্রত্যাশা করা এবং ইবাদত না করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য লাভ করতে চাওয়া, জাহান্নামের বীজ বপন করে জান্নাতের ফল ভোগ করতে চাওয়া, অসৎ কর্ম করে সৎকর্মশীলদের মতো প্রতিদান আশা করা।
সীমালংঘন করেও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে মিথ্যা প্রত্যাশা করা।
আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন আল্লাহভীতির জন্য সঠিক ইলমই যথেষ্ট, আর প্রবঞ্চিত হওয়ার জন্য অজ্ঞতাই যথেষ্ট।
কাজেই হে আল্লাহর বান্দা! কোন নিরাপত্তা আপনাকে অজ্ঞতা ও প্রবঞ্চনায় নিমজ্জিত করে রেখেছে? পাপ-পঙ্কিলতায় জড়িত হতে দুঃসাহস যুগিয়েছে? অনবরত অন্যায় কাজ করতে প্ররোচিত করেছে?
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সুন্দরভাবে আপনার দোষ-ত্রুটি,গুনাহ ও অন্যায়কে গোপন রেখেছেন, এটাই কি আপনাকে প্ররোচিত করেছে অন্যায় করতে? নাকি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আপনাকে দীর্ঘ ছাড় ও সুযোগ দিয়েছেন এ কারণে আপনি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর সাথে অন্যায় করে যাচ্ছেন? নাকি আপনাকে এটা প্রবঞ্চনায় ফেলেছে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আপনার অপরাধের উপস্থিত শাস্তি না দিয়ে তওবার সুযোগ দিয়েছে?।
বস্তুতঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আপনার অন্যায় ও দোষ-ত্রুটি কে গোপন রেখেছেন এবং এবং আপনার ভাল দিক গুলো প্রকাশ করেছন এ জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা আদায় আপনার উপর আবশ্যক হয়ে যায়।
কাজেই হে মুসলমানগন আপনারা ধোকার পথ থেকে ফিরে আসুন এবং আল্লাহকে ভয় করুন। পাপ পঙ্কিলতা মুক্ত হন, আল্লাহর আবরণে আবরিত হন, এবং তার কাছেই লজ্জিত হন।
সাবধান! মানুষেরা দোষারোপ করবে, কিন্তু সংশোধন করবে না। তারা আপনাকে অপদস্ত করবে কিন্তু আপনার দোষ গোপন রাখবে না।
তারা আপনার অন্যায় প্রচার করবে কিন্তু সতর্ক করবে না।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি,আপনারাও আল্লাহ রব্বুল আলামিনের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল ও চুড়ান্ত দয়ালু।
-এটি