শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


পিতা-মাতার উপর সন্তানের হক্ব ও তা আদায়ের গুরুত্ব!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আব্দুল কাদির আল মাহদি।।
বার্সেলোনা থেকে>

শিশুদেরকে সাত বছর বয়সে নামাজের নির্দেশ দাও, আর দশ বছর বয়স থেকে প্রয়োজনবোধে তাদের শাসন কর যদি তারা তা না করে, আর তাদেরকে নিজ নিজ বিছানায় আলাদা করে দাও। (আবু দাউদ ও তিরমিজি)

৩। সন্তানদের সুন্দর জীবন গঠনের তারবিয়্যাত দেয়া। ভাল ব্যবহার ও সুন্দর গুণাগুণের শিক্ষা দেয়া। আহলে ইলম তথা আলেম-উলামা ও সৎ, ন্যায়পরান মানুষের সঙ্গে উঠাবসা করানো। খারাপ, অসৎ ও মিথ্যাবাদীদের সঙ্গে উঠাবসা না করার নির্দেশ দেয়া। এমনকি অসৎ ও মিথ্যাবাদি ব্যক্তিদের সাথে খেলাধুলা না করা ও সঙ্গ ত্যাগ করার জন্য সচেতন করা। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন لأَنْ يُؤَدِّبَ الرَّجُلُ وَلَدَهُ خَيْرٌ مِنْ أَنْ يَتَصَدَّقَ بِصَاعٍ".
নিজের সন্তানকে শিষ্টাচার ও আদব-কায়দা শিক্ষা দেয়া এক ‘সা’ পরিমাণ বস্তু দান-খাইরাত করার চেয়েও উত্তম। (তিরমিজি)
তিনি (সা) আরও বলেন -: "مَا نَحَلَ وَالِدٌ وَلَدًا مِنْ نِحْلَةٍ أَفْضَلَ مِنْ أَدَبٍ حَسَنٍ".

কোন পিতা তার সন্তানকে উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার চেয়ে বেশি উত্তম কোন জিনিস দিতে পারে না।(তিরমিজি) অন্য জাগায় রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন "عَلِّمُوا أَوْلاَدَكُمْ وَأَهْلِيكُمُ الْخَيْرَ وَأَدِّبُوهُمْ". তোমাদের সন্তান ও পরিবারকে ভাল জিনিস, উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দাও।

৪। সন্তানের ভরণপোষণ অপরিহার্য বিষয়। এ ব্যপারে সন্তানের পিতা সচেষ্ট থাকা। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ ۖ لِمَنْ أَرَادَ أَن يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ ۚ وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ ۚ
সন্তানবতী নারীরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ন দু’বছর দুধ খাওয়াবে, যদি দুধ খাওয়াবার পূর্ণ মেয়াদ সমাপ্ত করতে চায়। আর সন্তানের অধিকারী অর্থাৎ, পিতার উপর হলো সে সমস্ত নারীর খোর-পোষের দায়িত্ব প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী। (সুরা বাকারাহ ২৩৩)

৫। সন্তান ছেলে হওক মেয়ে হওক ভরণপোষণ, ভালবাসা ও গিফট বা হদিয়া অথবা ওয়ারাছতী সম্পদ বা অন্য যেকোন কিছুর ক্ষেত্রে ইনসাফ ও ভারসম্য বজায় রাখা। নোমান বিন বশির (রা) থেকে হাদিস-
عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ -رَضِيَ الله عَنْهُمَا- أَنَّ أَبَاهُ أَتَى بِهِ رَسُولَ الله -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ: إِنِّي نَحَلْتُ ابْنِي هَذَا -أَيْ أَعْطَيْتُهُ- غُلاَمًا كَانَ لِي. فَقَالَ رَسُولُ الله -صلى الله عليه وسلم-: "أَكُلَّ وَلَدِكَ نَحَلْتَهُ مِثْلَ هَذَا؟"، فَقَالَ: لاَ. فَقَالَ رَسُولُ الله -صلى الله عليه وسلم-: "فَأَرْجِعْهُ". وَفِي رِوَايَةٍ: فَقَالَ رَسُولُ الله -صلى الله عليه وسلم-: "أَفَعَلْتَ هَذَا بِوَلَدِكَ كُلِّهِمْ؟!"، قَالَ: لاَ. فقال -صلى الله عليه وسلم-: "اتَّقُوا اللَّهَ وَاعْدِلُوا فِي أَوْلادِكُمْ
তিনি বলেন তার পিতা তাকে নিয়ে রসুলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এলেন এবং বললেন, আমি আমার এই পুত্রকে একটি গোলাম দান করেছি। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সব পুত্রকেই কি তুমি এরূপ দান করেছ। তিনি বললেন, না; তিনি বললেন, তবে তুমি তা ফিরিয়ে নাও।
অন্য হাদিসে আসছে- রসুলুল্লাহ (সা) বলছিলেন, আল্লাহকে ভয় কর এবং আপন সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা কর। [নু‘মান (রাঃ)] বলেন, অতঃপর তিনি ফিরে গেলেন এবং তার দান ফিরিয়ে নিলেন। (সহিহ বুখারি)

৬। পিতা স্বীয় সন্তানের সুন্দর ও ভাল অর্থবোধক নাম রাখা। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন "إِنَّكُمْ تُدْعَوْنَ بِأَسْمَائِكُمْ وَأَسْمَاءِ آبَائِكُمْ، فَأَحْسِنُوا أَسْمَاءَكُمْ"
ক্বিয়ামাতের দিন তোমাদেরকে, তোমাদের ও তোমাদের পিতাদের নাম ধরে ডাকা হবে। তাই তোমরা তোমাদের সুন্দর নামকরণ করো। (আবু দাউদ)

৭। পিতা স্বীয় সন্তান জন্মের পর আক্বিকাহ করা তথা আল্লাহ তা’আলার নামে জবেহ করা। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন
"عَنِ الْغُلاَمِ شَاتَانِ مُتَكَافِئَتَانِ -أَيْ مُتَسَاوِيَتَانِ سِنًّا وَشَبَهًا- وَعَنِ الْجَارِيَةِ شَاةٌ"

‏ছেলে সন্তানের পক্ষে দু’টি বকরী এবং মেয়ে সন্তানের পক্ষে একটি বকরী (আকীকা দিতে হবে)। আকীকার পশু নর বা মাদী যাই হোক না কেন তাতে তোমাদের কোন অসুবিধা নেই। (তিরমিজি)

৮। সন্তানের খতনা দেয়ার ক্ষেত্রে যত দ্রত সম্ভব এগিয়ে আসা। একবারে শিশুকাল খতনা দেয়ার উত্তম সময় । রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন
"الْفِطْرَةُ خَمْسٌ: الْخِتَانُ...". পাঁচটি বিষয় মানুষের ফিতরাতের অন্তর্গত। খাতনা করা।

হে পরিবারের অভিবাক! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন। সন্তানদের হক্ব যাহা অপরিহার্য তা আদায় করুন। কেননা আমাদের সমাজে অনেক মানুষ সন্তানের হক্বের ব্যপারে গুরুত্ব দেয়েনা।

সমাজের মানুষ হয়ত এতটা ব্যস্ত যে কেউ আছে ব্যবসার পেছনে। আবার, কেউ কর্মস্থানে কাজ নিয়ে ব্যাস্ত। আবার, কেউ ভিবিন্ন ক্রিয়েটিভ কাজে ব্যস্ত। পরিবার ও সন্তান থেকে মাল অর্জনে বেশি গুরুত্ব সহ সময় দেয়া হচ্ছে। হ্যাঁ, মাল অর্জন মন্দ কিছু নয়। কিন্তু, এই মাল অর্জন আমার ভবিষ্যতের জন্য ভালোর নাকি মন্দের? কোন এক বিজ্ঞজন বলছিলেন- ‎اشبع ولدك واحسن ادبه واجمع له ادبه ولا تكسب له ذهبا

আপনার সন্তানদের পরিপূর্ণ করুন, তাদের আচার -আচরণ উন্নত করুন, তাদের উত্তম আচার -আচরণের ব্যবস্থা করুন এবং শুধু শুধু তাদের জন্য সোনা (ধন সম্পদ) ব্যবস্থা করবেন না।

সন্তানরা হচ্ছে পিতামাতার উত্তরাধিকার। কাজেই যেভাবে আমাদের সন্তানদের চাইব উন্নতি বা অবনতি করতে পারব। নিশ্চয় সন্তানরা হচ্ছে পিতামাতার গুপ্তধনের মত। আল্লাহ তা’আলা বলেন
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُم بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَمَا أَلَتْنَاهُم مِّنْ عَمَلِهِم مِّن شَيْءٍ ۚ كُلُّ امْرِئٍ بِمَا كَسَبَ رَهِينٌ
যারা ঈমানদার এবং যাদের সন্তানরা ঈমানে তাদের অনুগামী, আমি তাদেরকে তাদের পিতৃপুরুষদের সাথে মিলিত করে দেব এবং তাদের আমল বিন্দুমাত্রও হ্রাস করব না। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃত কর্মের জন্য দায়ী। (সুরা তুর ২১)

শিশু সন্তানরা হচ্ছে সাদা স্ক্রিনের ন্যায়। অভিবাকগন যেমন রং লাগাতে চাইবেন তেমন রং ধরবে। এক ব্যক্তি উমর (রা) এর দরবারে আসল। সে উমর (রা) তার সন্তানের অবাধ্যতার অভিযোগ তুলল-
جَاءَ رَجُلٌ إِلَى عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ -رَضِيَ الله عَنْهُ- يَشْكُو إِلَيْهِ عُقُوقَ ابْنِهِ، فَأَحْضَرَ عُمَرُ الْوَلَدَ، وَأَنَّبَهُ عَلَى عُقُوقِهِ لأَبِيهِ وَنِسْيَانِهِ لِحُقُوقِهِ، فَقَالَ الْوَلَدُ: يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ: أَلَيْسَ لِلْوَلَدِ حُقُوقٌ عَلَى أَبِيهِ؟! قَالَ عُمَرُ: بَلَى. قَالَ: فَمَا هِيَ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ؟! قَالَ عُمَرُ: أَنْ يَنْتَقِيَ أُمَّهُ، وَيُحْسِنَ اسْمَهُ، وَيُعَلِّمَهُ الْكِتَابَ -أَيِ الْقُرْآنَ-. قَالَ الْوَلَدُ: يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ: إِنَّ أَبِي لَمْ يَفْعَلْ شَيْئًا مِنْ ذَلِكَ؛ أَمَّا أُمِّي فَإِنَّهَا زِنْجِيَّةٌ كَانَتْ لِمَجُوسِيٍّ، وَقَدْ سَمَّانِي جُعَلاً، وَلَمْ يُعَلِّمْنِي مِنَ الْكِتَابِ حَرْفًا وَاحِدًا. فَالْتَفَتَ عُمَرُ إِلَى الرَّجُلِ، وَقَالَ لَهُ: جِئْتَ إِلَيَّ تَشْكُو عُقُوقَ ابْنِكَ، وَقَدْ عَقَقْتَهُ قَبْلَ أَنْ يَعُقَّكَ، وَأَسَأْتَ إِلَيْهِ قَبْلَ أَنْ يُسِيءَ إِلَيْكَ
হে আমিরুল মুমিনিন আমার এই ছেলে আমার অবাধ্য, সে আমার কোন কথা শুনেনা এরকম অনেক অভিযোগ করলো। উমর (রাঃ) পিতার কথা শুনলেন এবং তরুন বালককে ডেকে উপদেশ দিতে শুরু করলেন, তোমার বাবা তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে তোমার উচিত তোমার বাবার অধিকার পুরন করা।

তরুন সেই বালক জিজ্ঞেস করলো। আমার কি পিতার উপর কোন অধিকার আছে? উমর (র) জবাব দিলেন। হ্যাঁ তোমারও তোমার পিতার উপর অধিকার আছে। বালকটি জানতে চাইল। আমার অধিকার গুলো কি? হযরত উমর (রাঃ) বালকের কাছে তার অধিকার গুলো ব্যাখ্যা করে বললেন।

বাবা-মায়ের প্রতি বাচ্চাদের প্রথম অধিকার হলো, বাবার উচিত উত্তম স্ত্রী সাথে সংসার করা। বাচ্চা জন্মের পূর্বেই ভবিষ্যত বাচ্চার অধিকার হলো সঠিক স্ত্রী বা স্বামীকে খুঁজে নেয়া।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি উমর (রাঃ) বলেছেন সেটি হলো, তোমার বাবার দ্বিতীয় কর্তব্য হলো তোমার সুন্দর নাম দেয়া। সুন্দর অর্থপূর্ণ নাম। যে নামে ডাকলেই বাবা-মায়ের প্রশান্তি লাগে।

তৃতীয় যে অধিকারের কথা উমর (রাঃ) উল্লেখ করেছিলেন, তুমি যখন বড় হওয়া শুরু করবে প্রথম যে জিনিসটি তোমাকে শিক্ষা দিতে হবে সেটি হলো আল-কুরআন। কুরআন নির্দেশিত পথে সন্তানকে লালন-পালন করা। তখন বালকটি উমর (রাঃ) কে বললো। আমি বলতে চাই আমার বাবা কোনটাই পুরন করেননি। বালকটি বললো যে আমার বাবা পথের এক মহিলাকে বিয়ে করেছে। আমাকে একটা সাংঘাতিক নাম দিয়েছে এবং কুরআন কি জিনিস আমি কিছুই জানিনা, আমাকে কুরআন কি শিক্ষা দেয়া হয়নি।

তখন উমর (রাঃ) ডাইভার্ট হয়ে বাবাকে বললেন। তুমি তোমার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে এসেছো? অথচ তুমি এমন একজন বাবা যে তোমার ছেলের একটি অধিকারও পূরন করোনি।

আমাদের সমাজে স্বামীদের অধিকার নিয়ে যেমন বেশি আলোচনা হয় ঠিক তেমনি বাবা-মায়ের অধিকার নিয়ে বেশি আলোচনা হয়। সন্তানের অধিকার নিয়ে আলোচনা হয় খুব কম। অথচ সন্তানের অধিকারের প্রতি মনোযোগী হলে পিতা-মাতার অধিকারের ব্যাপারে সন্তানরা এমনিতেই মনোযোগী হয়ে যাবে।

কাজেই হে অভিবাকবৃন্দ! সন্তানের হক্বের ব্যপারে আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, যেমন আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে ওসিয়ত তথা উপদেশ করছেন। আল্লাহ তাআলার ঘোষণা- يُوصِيكُمُ اللَّهُ فِي أَوْلَادِكُمْ আল্লাহ তোমাদের সন্তান-সন্ততি সম্পর্কে তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন। (সুরা নিসা ১১)
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে যেন সবার হক্ব পুরাপুরি আদায় করার তাওফিক দান করেন। আমিন

বার্সেলোনা মসজিদে আলীতে আব্দুল কাদির আল মাহদি প্রদত্ত খুতবা।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ