আব্দুল কাইয়ুম।।
হৃদ্রোগ সংক্রামক ব্যাধি না যে আপনার কাছ থেকে তিন-চার হাত দূরে থাকতে হবে, মুখে মাস্ক পরতে হবে, বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হবে। তারপরও দেখুন, দেশে এক নম্বর ঘাতক ব্যাধি এখনো হৃদ্রোগ। ২০২০ সালে দেশে যত মানুষ মারা গেছে, তার এক-পঞ্চমাংশের বেশি মৃত্যু হয়েছে হার্ট অ্যাটাকে। এটা বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের (বিবিএস) তথ্য (গত ১০ মার্চ, দ্য ডেইলি স্টার)।
অথচ এখন হৃদ্রোগের চিকিৎসা অনেক উন্নত হয়েছে। দেশেই বিশ্বমানের চিকিৎসা পাওয়া যায়। কিন্তু রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। এর অনেক কারণ আছে। আমরা যদি একটু সচেতন থাকি, তাহলে হৃদ্রোগে মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য দরকার হৃদ্-স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে একাগ্রতা। এ জন্যই এবারের বিশ্ব হার্ট দিবসের মূল স্লোগান ‘হৃদয় দিয়ে হৃদয়ের যত্ন নিন’। আমাদের আলোচনা হয় মূলত এ বিষয়েই। এখানে আন্তরিক বা একাগ্রতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
আমাদের হৃদ্যন্ত্র কিন্তু নিজেকে সব সময় সচল রাখার জন্য যথেষ্ট আন্তরিক। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আমাদের অনেকের ফুসফুসের ক্যানসার হয়, রক্তের ক্যানসার, অন্ত্রের ক্যানসার হয়, কিন্তু সাধারণত হার্টের ক্যানসার হয় না। এর একটি কারণ হলো হৃৎপিণ্ডে কোষ বিভাজন সাধারণত হয় না। আর অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনই তো ক্যানসারের অন্যতম কারণ। সেটাই হৃৎপিণ্ড হতে দেয় না। অন্যদিকে, রক্তবাহিত ক্যানসারের উপাদান কার্সিনোজেন সাধারণত হৃৎপিণ্ডে শোষিত হয় না। তাহলে দেখুন, হৃৎপিণ্ড নিজেই নিজের প্রতি কত যত্নবান। আমরা হব না কেন?
প্রথম কাজ হবে সারা দিনে কিছু কায়িক শ্রম করা। আমাদের ধরে নিতে হবে ২৩ ঘণ্টায় এক দিন। বাকি এক ঘণ্টা ব্যায়ামের জন্য থাকবে। সকাল বা সন্ধ্যায় ঘণ্টাখানেক হাঁটা ভালো ব্যায়াম। সময়ের অভাব থাকলে অন্তত আধা ঘণ্টা বা ১৫ মিনিটও যদি ব্যায়াম করি, যথেষ্ট। সেই সঙ্গে সকাল ও সন্ধ্যায় চার থেকে পাঁচ মিনিট শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম দরকার। বুকভরে শ্বাস নেওয়া ও একদম বুক খালি করে শ্বাস ছাড়াই হলো আসল ব্যাপার। আমরা সাধারণত অল্প শ্বাস নিই এবং সামান্য শ্বাস বের করে দিই। এ কারণে ফুসফুসের বায়ুথলিগুলোর (আলভিওলি) এক বড় অংশ অকেজো হয়ে পড়ে। হৃৎপিণ্ড যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেন পায় না। এ ব্যায়াম শুধু হৃৎপিণ্ডই নয়, সারা দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কোষগুলোয় পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং শরীর সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
দ্বিতীয়ত, খাওয়াদাওয়া। সম্পৃক্ত চর্বি, ভাজাপোড়া, অতিরিক্ত তেল-ঘির রান্না যথাসম্ভব কম খেতে হবে। চিনি খাওয়া একদম বন্ধ রাখাই ভালো। আমেরিকায় এখন অ্যান্টিসুগার মুভমেন্ট চলছে। একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের তো নামই হয়ে গেছে ‘অ্যান্টি-সুগারম্যান’!
চিনির ব্যাপারটা একটু খুলে বলি। আমরা মিষ্টি ফল খাই। সেটা বরং ভালো। এর মধ্যে চিনি তো থাকেই, আরও থাকে বিভিন্ন পুষ্টিকর উপাদান, খনিজ পদার্থ এবং বিশেষভাবে আঁশ। পরিপাক-প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত চিনি আমাদের শরীরে যায়। কিন্তু সরাসরি চিনি খেলে পরিপাক-প্রক্রিয়ার দরকার হয় না, চিনি সরাসরি রক্তে চলে যায়। এ কারণে খাদ্য থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয়ের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। আজকাল স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা চিনিকে ‘শ্বেত-বিষ’ বলেন!
তৃতীয়ত, শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ। মেদ-ভুঁড়ি যেন না জমে। বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী পরিমিত ওজন বজায় রাখতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে খাদ্যাভ্যাস বদলাতে হবে। শুধু পরিমিত খাবার ও কায়িক শ্রম অব্যাহত রাখলেই ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। অতিরিক্ত কোনো কিছু খাওয়া ভালো না।
চতুর্থত, একটি গুরুতর বিষয়। সিগারেট-তামাক খাওয়া একদম নিষেধ। কোনো রকম নেশা একদম বাদ। সিগারেট হৃদ্রোগ ডেকে আনে।
পঞ্চম এবং সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো নিয়মিত চেকআপ। ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সের পর প্রতি দু-চার বছর পরপর অন্তত লিপিড টেস্ট করানো দরকার। রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা লক্ষ রাখা বিশেষ প্রয়োজন। এসব বিষয়ে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এখন প্রশ্ন হলো, এই নিয়মিত চেকআপ কখন থেকে শুরু করব, তা বোঝার উপায় কী? নিজের অভিজ্ঞতাই বলি। সকালে নিয়মিত হাঁটতাম। তখন বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। এক দিন লক্ষ করলাম, ১০ থেকে ১২ মিনিট হাঁটার পর থেকে বাঁ হাতের আঙুলে মাথাগুলো ব্যথা করে। কিন্তু হাঁটা থামালে আবার ব্যথা চলে যায়। মাসখানেক একই অভিজ্ঞতা। আমি ভাবলাম, হয়তো অতিরিক্ত কায়িক শ্রমের সময় প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহ পাচ্ছে না বলেই আঙুলে ব্যথা হয়। এ ধারণা থেকে ডাক্তারের কাছে যাই। পরে দেখা গেল, হৃৎপিণ্ডের সব কটি ধমনিতে ভয়াবহ ব্লক। হার্ট অ্যাটাকের আগেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিয়ে সুফল পাই। এরপর থেকে নিয়মিত চেকআপ করি।
আজ বিশ্ব হার্ট দিবসে আসুন, আমরা সচেতন হই। আন্তরিকতার সঙ্গে নিয়ম মেনে চলি। হৃদ্রোগমুক্ত থাকার জন্য এর চেয়ে ভালো ওষুধ আর নেই।
লেখক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
-এএ