মাহমুদুল হাসান
বিশেষ প্রতিনিধি
কিশোরগঞ্জে করোনার ভয় ও আতঙ্ককে জয় করে কোভিড-১৯-এ মৃত্যু এবং করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণকারীদের জানাজা ও লাশ দাফন করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী সংস্থা আল্লামা আনোয়ার শাহ রহ. ফাউন্ডেশন।
সারাদেশে করোনা রোগী মারা গেলে সর্বত্র ভয় ও আতঙ্ক বিরাজ করে। মৃত ব্যক্তির প্রিয়জন-আপনজন ভয় ও আতঙ্কের কারণে লাশের ধারে কাছে যেতে চায় না। ক্ষেত্রবিশেষে আপনজনও আক্রান্ত থাকায় করোনায় মারা যাওয়া প্রিয়জনের কাছে ইচ্ছা থাকলেও তাদের শেষ বিদায়ের সময় থাকতে পারছেন না।
এমন কঠিন বাস্তবতা আর অপারগতার মধ্যে করোনার মৃতদেহ সৎকারে ঝুঁকি নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে অন্যন্য নজীর স্থাপন করছে আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ (রহ.) ফাউন্ডেশনের কিছু স্বেচ্ছাসেবক।
ফাউন্ডেশনের প্রায় ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবীকে নিয়ে ফাউন্ডেশনের ১০ জনের এককটি দল একের পর এক করে যাচ্ছে জানাজা ও দাফন। কিশোরগঞ্জের ১৩টি উপজেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় তারা করোনা লাশ দাফন-কাফনে মানবিক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কিশোরগঞ্জ জেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় এ পর্যন্ত ৩০০ টি লাশের ও বেশি দাফন-কাফন করেছেন তারা।
জানা যায়, মৃতদের সৎকারে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই কাজ করে যাচ্ছে আল্লামা আনোয়ার শাহ (রহ.) ফাউন্ডেশন। পুরো দলটি শহরের জামিয়া এমদাদিয়া মাদ্রাসায় তাদের অস্থায়ী প্রধান কার্যালয়ে থাকছে। মৃতদেহ সৎকারে কিশোরগঞ্জ ছাড়াও অন্যত্র ডাক পড়লে তারা ছুটে যান দেশের যে কোনো স্থানে। তাদের সঙ্গে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও দাফন টিমে অংশ নেন। আল্লামা আনোয়ার শাহ (রহ.) ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মাওলানা সাব্বির আহম্মদ রশিদ আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত আল্লামা আনোয়ার শাহ (রহ.) ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা করোনায় প্রায় ৩০০ শতাধিক মৃতদেহ দাফন করেছে। এর মধ্যে ৯-১০ জন ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কিশোরগঞ্জের বাইরে কমপক্ষে ৩০ টি লাশ তারা দাফন করেছে।
ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি ও ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের সহকারী ইমাম মাওলানা শোয়াইব আবদুর রউফ বলেন, 'দাফন-কাফনের সব ধরনের সরঞ্জাম কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী, সিভিল সার্জন ডা. মো. মজিবুর রহমান ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক তাদের সার্বক্ষণিক ব্যবহারের জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্স প্রদান করেছেন। আর খরচের টাকা ফাউন্ডেশন থেকেই দেওয়া হয়েছে। ৩০ জনের টিমে পাঁচজন নারী সদস্য রয়েছেন। খবর পেলেই সবাই পরিবার ছেড়ে মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করছেন।’
তিনি আরও জানান, ‘মুসলমান হিসেবে বিবেকের কারণেই আমরা এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনে এগিয়ে আসি। দেখা যায়, একটি লাশ সাত-আট ঘণ্টা মাটিতে পড়ে থাকলেও এর কাছে কেউ আসে না। আর আমাদের কাছে খবর এলে আমরা লাশগুলো সংগ্রহ করি।’
দেশে করোনা ভাইরাসের প্রভাব শুরু হওয়ার পর থেকে কিশোরগঞ্জ ও তার পার্শ্ববর্তী জেলায় করোনায় মৃতদের কাফন-দাফন ও দুর্যোগে ত্রাণ কার্যক্রমসহ গবেষণাধর্মী এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ রহ. ফাউন্ডেশনের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
সামাজিক কাজে সবার সম্মেলিত প্রচেষ্টায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে শান্তি শৃংখলার সাথে কিশোরগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী জেলায় কার্যক্রম চালিয়ে প্রশাংসা কুড়িয়েছে এ ফাউন্ডেশন। এছাড়া করোনাকালে ৩ শতাধিক দরিদ্র মানুষের মাঝে নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্য, প্রতি সপ্তাহে ছিন্নমূলদের মাঝে খাবার বিতরণ,সীরাতুন্নাবী সা. রচনা প্রতিযোগিতা, ফাউন্ডেশনের অধীনে হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা, বিনামূল্যে চিকিৎসা ক্যাম্প করে চিকিৎসা প্রদান, অক্সিজেন সেবা, চলমান রক্তদান কর্মসূচি ও কয়েক শতাধিক রুগির বিনামূল্যে চোখের ছানি অপারেশনসহ অসহায় দরিদ্র মাদরাসা ও মেডিকেল ছাত্রদের মাঝে বাৎসরিক শিক্ষা বৃত্তি প্রদান এবং সামাজিক নানান কাজের মাধ্যমে ফাউন্ডেশনটি ইতোমধ্যে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে।
আল্লামা আজহার আলী আনোয়ার শাহ রহ ফাউন্ডেশন এর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ধন্যবাদ জানিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ রহ. ফাউন্ডেশন-এর কর্মীরা করোনাকালীন পরিস্থিতিতে জনগণের মাঝে যেভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, আমার মনে হয় এই কাজের মাধ্যমে আপনারা একটা উদার মনের পরিচয় দিয়েছেন। নবী করিম সা. কিন্তু আমাদেরকে সেই শিক্ষাই দিয়েছেন। আমি মনে করি এটা একটা বিরাট কাজ আপনারা করেছেন—যেখানে আপনজনও লাশ রেখে চলে যায়, সেখানে এই ফাউন্ডেশন-এর কর্মীরা যেভাবে কাফন-দাফনের কাজ করছে। এর বদলে আল্লাহ তায়ালা আপনাদের উত্তম বিনিময় দিন।’
-কেএল