মাওলানা ইমদাদুল হক।।
জন্ম: বিশিষ্ট আলেমে দীন, মুবাল্লিগ ও মুফাক্কিরে ইসলাম, শিক্ষক, লেখক, অনুবাদক, সম্পাদক, সংগঠক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাওলানা আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী (রাহ.) ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর আলমডাঙ্গা উপজেলার কাবিলনগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
তার পিতার নাম মুফাজ্জল হোসেন মণ্ডল, মাতার নাম নেকজান নেসা। তাঁর বাবা ও দাদা ফুরফুরার হুযুরদের হাতে বায়আত ছিলেন। দাদা বায়আত ছিলেন শায়খ আবু বকর সিদ্দীক (রাহ.) এর নিকট এবং বাবা বায়আত ছিলেন মাওলানা রুহুল আমীন বশিরহাটি (রাহ.) এর হাতে।
শিক্ষা: পরিবারেই মাওলানার লেখাপড়ার হাতে খড়ি হয়। তবে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু হয় মাওলানা আর্শাদুল আলম (রাহ.) প্রতিষ্ঠিত কাবিলনগর মাদরাসায়। তিনি কুষ্টিয়া কুওয়াতুল ইসলাম মাদরাসা থেকে ১৯৬৫ সালে ফাযিল এবং ১৯৬৭ সালে পাবনা আলিয়া মাদরাসা থেকে হাদীস বিষয়ে কামিল পাশ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হন এবং অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে ১৯৭৫ সালে সেখান থেকে বের হন। তাঁর লেখাপড়া ও ব্যক্তিত্ব গঠনের পেছনে মায়ের ভূমিকার কথা তিনি বারবার উল্লেখ করতেন।
বিবাহ: তিনি আলমডাঙ্গার যাদবপুর গ্রামের মোশারেফ বিশ্বাসের মেজো কন্যা বেগম জেবুন্নেসার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর ঔরসে চারকন্যা ও একপুত্র জন্মগ্রহণ করেন। তারা হলেন: ১. যয়নব জামিলা তামান্না, ২. জামিলা কুলসুম শিরীন, ৩. জাবিদ ইকবাল টিপু, ৪. মরিয়ম জামিলা ও ৫. রুকাইয়া নারগিস নাহিদ।
কর্মজীবন: মাওলানা মাদরাসার লেখাপড়া শেষ করে কিছুদিন হরিণাকুণ্ডু উপজেলার বরিশখালি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। তারপর কিছুদিন কাবিলনগর মাদরাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনে যোগদান করেন। তারপর কিছুদিন টাঙ্গাইলে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি প্রতিষ্ঠিত সন্তোষ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। এ সময় ১৯৭৮ সালের দিকে বেশকিছু দিন তিনি ‘হককথা’ পত্রিকার সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন। তারপর রাজধানীতে ফিরে আবার ইসলামিক ফাউন্ডেশনে যোগদান করেন।
লেখালেখি: তিনি ‘হককথা’ ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। তাঁর কিছু মৌলিক রচনাও রয়েছে। তবে পাঠক মহলে তিনি অনুবাদক হিসাবেই পরিচিত। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বিস্ময়পুরুষ। আল্লামা মুশাহিদ বাইয়মপুরি রাহ.র সুকঠিন উর্দু গ্রন্থ ‘আল ফাতহুল কারীম ফী সিয়াসাতিন নাবিয়্যিল আমীনে’র অনুবাদের মাধ্যমে তিনি সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করেন। তারপর একে একে অনুবাদ করেছেন বেশকিছু কালজয়ী মুল্যবান গ্রন্থ। তাঁর অনূদিত গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে, ১. মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারালো?, ২. ঈমান যখন জাগলো, ৩. নবীয়ে রহমত, ৪. সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস, ৫. ইসলামের রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার, ৬. মহানবী (সা.) এর প্রতিরক্ষা কৌশল, ৭. খালিদ বিন ওয়ালিদ, ৮. মুহাম্মাদ বিন কাসিম, ৯. আমার আম্মা, ১০. সীরাতে রাসূলে আকরাম (সা.), ১১. সীরাতে সাইয়িদ আহমাদ শহীদ, ১২. প্রাচ্যের উপহার, ১৩. ইসলাম ধর্ম সমাজ সংস্কৃতি ও ১৪. হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) জীবন ও সংগ্রাম ইত্যাদি।
তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত ২৫ খণ্ডের ইসলামী বিশ্বকোষ, ১৪ খণ্ডের সীরাত বিশ্বকোষ ও আল কুরআন বিশ্বকোষ। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এই বিশ্বকোষ প্রকল্পের পরিচালক ও সম্পাদনা পরিষদের সদস্য সচিব ছিলেন।
তরজুমানে নদভি: লেখনীর মাধ্যমেই মাওলানা ওমর আলী (রাহ.) পরিচিত হন বিগত শতাব্দীর অবিসংবাদিত ইসলামি ব্যক্তিত্ব মুফাক্কিরুল ইসলাম সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভি (রাহ.) এর সাথে। সর্বপ্রথম তিনি হাতে পান নদভি (রাহ.) এর কিতাব ‘জব ঈমান কি বাহার আয়ে’। বইটির উন্নত ভাষাশৈলী ও চিন্তার উচ্চতা তাকে প্রভাবিত করে।
তিনি তখন ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কর্মরত। এই বইটি তিনি অনুবাদ করে ‘ঈমান যখন জাগল’ নামে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশ করেন। তারপর তাঁর হাতে আসে ‘তারীখে দাওয়াত ও আযীমাত’ সিরিজের দ্বিতীয় খণ্ড। এই বইটিও তিনি অনুবাদ করে ‘ইসলামি রেনেসাঁর অগ্রপথিক’ নামে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশ করেন।
তখন পর্যন্ত তিনি নদভি (রাহ.)-কে শুধু একজন লেখক-সাহিত্যিক হিসাবেই চিনতেন। আল্লাম ফরীদ উদ্দীন মাসউদের মাধ্যমে একদিন তিনি জানতে পারেন, মাওলানা নদভি আরবি-উর্দু সাহিত্যের কেবল একজন বড় লেখকই নন, বরং তিনি আধ্যাত্মিক জগতেরও একজন সালেক ও রাহবার।
মাওলানা সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভি (রাহ.) ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সফরে আসেন। তখন ওমর আলী তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে বায়আত গ্রহণ করেন। শুরু হয় মাওলানা ওমর আলীর জীবনের নতুন অধ্যায়। রমাযান আসলেই তিনি আপন মুরশিদের সান্নিধ্যে গিয়ে ই’তিকাফ করতেন। এভাবে তিনি মাওলানা নদভির অন্যতম প্রধান শাগরিদে পরিণত হন এবং তাঁর ফিকিরে ফিকিরমান্দ হয়ে হয়ে ওঠেন বাংলাভাষায় তার চিন্তার অন্যতম ভাষ্যকার তরজুমানে নদভি।
মাওলানা নদভি (রাহ.) এর নির্দেশেই মাওলানা ওমর আলী ‘মাযা খাসিরাল আলামু বি-ইনহিতাতিল মুসলিমীন’ এর অনুবাদ করেন। তারপর একে একে তিনি প্রিয় মুরশিদের অনেকগুলো কিতাব বাংলায় অনুবাদ করেন। অনেকেই মাওলানা নদভির বিভিন্ন কিতাবের অনুবাদ করেছেন। তবে বোদ্ধা পাঠকের স্বতস্ফূর্ত স্বীকৃতি এই যে, কেবলমাত্র ওমর আলী (রাহ.) এর অনুবাদেই রয়েছে নদভি (রাহ.) এর বক্তব্যের মূল প্রাণ ও ভাবমর্মের যথার্থ প্রকাশ।
দাওয়াতের ময়দানে: তাঁর শায়খ সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভি (রাহ.) ছিলেন মুফাক্কিরুল ইসলাম। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ প্রচেষ্টা ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। এ চিন্তা মাওলানা ওমর আলীর মধ্যেও প্রতিস্থাপন হয়েছিল। তিনি ছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কর্মরত। কিন্তু তিনি মাঝেমাঝেই বলতেন, ‘কবে যে অন্য সকল কাজ থেকে অবসর হয়ে নিজের কাজ শুরু করতে পারব!’ ‘নিজের কাজ’ বলতে তিনি দাওয়াতি কাজকে বোঝাতেন। দাওয়াতি কাজে তিনি দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ছুটে বেড়াতেন। তাঁর মূল দাওয়াত ছিল অমুসলিম, খ্রিষ্টান মিশনারির প্রতারণায় ঈমান হারানো মুসলিম সন্তান ও দীন বিমুখ মুসলিমদের মাঝে।
চুয়াডাঙ্গার পাঁচলিয়া গ্রামসহ আশপাশ গ্রামের বেশকিছু মানুষ যখন একবারে মিশনারি খপ্পরে পড়ে ঈমান হারিয়ে ফেলে, মাওলানা ওমর আলী (রাহ.) তখন ঢাকা থেকে ছুটে এসেছেন নিজ এলাকায়। বারবার তিনি এলাকার আলেমদের সাথে এ ব্যাপারে করণীয় বিষয়ে আলোচনায় বসেছেন। আল্লাহ তাআলা এ অধমকেও সে সফরে তাঁর সাথে থাকার তাওফীক দিয়েছিলেন।
ছোটদের প্রতি: তিনি ছোটদের প্রতি খুবই স্নেহময়ী ছিলেন। বিশেষ করে কোনো তরুণের মাঝে সম্ভাবনা দেখলে তাকে অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনা দিয়ে এগিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন। অসংখ্য তরুণ এসব কথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন।
ফরিদাবাদের বছর কোনো কোনোদিন আমি তাঁর অফিসে গিয়ে বসে থাকতাম। তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প করতেন। কোনো কোনোদিন নিজের জন্য নিয়ে আসা দুপুরের খাবার আমাকে দিয়ে দিতেন। অফিস শেষে বাসায় যাবার সময় আমাকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাত্রাবাড়ির মোড়ে নামিয়ে দিতেন।
এমনই একদিন আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, নদভী রাহ. তাঁর ‘মাযা খাসিরাল আলামু বি-ইনহিতাতিল মুসলিমীন’ বইয়ের ভূমিকা সাইয়িদ কুতুব শহীদকে দিয়ে লেখালেন কেন? তিনি তো বিতর্কিত লোক। তিনি বললেন, বিতর্কিত নয় এমন মানুষ কি আছে? যে কাজ করবে তাকে নিয়ে বিতর্ক তো হবেই। নদভী (রাহ.)-কে নিয়ে বিতর্ক কম হয়েছে। কিন্তু একবারেই হয়নি তা কিন্তু নয়।
তাঁর অনুবাদের ভাষা যে আমাদের ছোটদের বুঝতে কষ্ট হয়, সেটাও আমি গাড়িতে বসে তাঁকে বলেছি। তিনি বলেছেন, ভাষার কারণে নয়, তোমাদের কষ্ট হয় বিষয়ের কারণে। বিষয়ের সাথে মুনাসাবাত হলে দেখবে, ভাষা আর সমস্যা মনে হচ্ছে না।
একদিন তাঁর অফিসে ঢুকতে গিয়ে দেখি, ভেতরে কয়েকজন আলিম বসে আছেন। তিনি তাদের সাথে আলাপ করছেন।
আমি সালাম দিয়ে গেটে দাঁড়ালে তিনি বললেন, ইমদাদ, ভেতরে চলে আসো। আমি ভেতরে ঢুকলে তিনি তাদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেনÑ এ ইমদাদ। আমাদের এলাকার ছেলে। লেখালেখির চেষ্ট করে। সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন, আল্লামা সুলতান যওক নদভি, মাওলানা আব্দুর রাযযাক নদভিসহ আরো দুজন। ওমর আলী সাহেব আমার নাম বললে আব্দুর রাযযাক নদভি সাহেব বললেন, তুমি ইমদাদ? মনে হল তিনি আমার নাম আগে থেকেই শুনেছেন। সুলতান যওক সাহেব মাথায় হাত দিয়ে আমাকে দুআ করে দিলেন।
সেদিন তিনি গাড়িতে উঠে তাঁদেরকে নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। আমি গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তিনি গাড়ি থেকে নামলেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, আজকে যাও, আবার এসো।
অশ্রুসিক্ত নয়ন: ২০০৩/২০০৪ সালে ফরিদাবাদে দাওরা হাদীস পড়ার কালে মাঝেমাঝেই আমি বায়তুল মুর্কারমে তাঁর অফিসে যেতাম। সাধারণত আমি নীরব বসে থেকে তাঁর কর্মমগ্নতা দেখতাম। কখনো কখনো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথাও হত। আমরা একই ইউনিয়নের পাশাপাশি গ্রামের মানুষ। তাই আমাদের আলোচনায় মাঝেমাঝে নিজেদের এলাকার ধর্ম-আর্থ-সামাজিক অবস্থা, তাঁর শৈশব-কৌশরের অবস্থা উঠে আসত। তখন দেখেছি তিনটি বিষয়ের আলোচনায় তাঁর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠত।
তিনি বলতেন, আমার এ পর্যন্ত আসার পেছনে আমার মায়ের অবদানই সবচেয়ে বেশি। তিনি আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। মহান আল্লাহ যদি আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে কাউকে সুপারিশ করার অনুমতি দেন, আমি প্রথমেই আমার মায়ের জন্য সুপারিশ করব। একথা যখন তিনি বলতেন, দেখতাম, তাঁর চোখে অশ্রু টলোমলো করছে।
যাত্রাবাড়ি আহলে হাদীস মাদরাসা থেকে দাওরা শেষ করে গিয়ে আমাদের ইউনিয়নের একটি ছেলে তার নিজ গ্রামে ইখতিলাফি ফিকহি মাসআলা প্রচার শুরু করলে পুরো এলাকা আন্দোলিত হয়ে ওঠে। এখানে ওখানে ঘনঘন বাহাস-বিতর্ক হতে থাকে। তার কিছু অনুসারী জুটে গেলে তারা মসজিদ-ঈদগাহ আলাদা করে ফেলে।
এ সংবাদ যেদিন আমি তাঁকে শোনাই, তিনি খুব দুঃখ পান। তাঁর চক্ষু অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, উম্মাহর অস্তিত্ব যখন সঙ্কটাপন্ন, খ্রিস্টান মিশনারি যখন মুসলমানদের ঈমান চুরি করতে সর্বসাধ্য নিয়ে মাঠে নেমেছে তখন আমরা আছি ছোট ছোট মাসআলা নিয়ে বিবাদ-বিসংবাদে লিপ্ত। জানি না, আমাদের বোধদয় কবে হবে!
নিজ শায়খ আলী মিয়া নদভী রাহ.র স্মৃতিচারণ করতে গিয়েও তিনি মাঝেমাঝে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়তেন; বিশেষ করে যখন শেষ স্মৃতি বলতেন। শায়খ তাঁকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, চাকুরি আর কতদিন আছে? তিনি বলেন, আমি উত্তর দিলাম। শায়খ আর কিছুই বললেন না। সেটাই ছিল হযরতের সাথে আমার শেষকথা। আজ মনে হয়, তিনি হয়ত আমাকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজের কথা বলতে চেয়েছিলেন। তখন যদি বুঝতে পারতাম, বলতাম, হযরত, আদেশ করুন। কাজের জন্য প্রয়োজন হলে আমি চাকুরি ছেড়ে দেব।
নিজ এলাকার প্রতি দরদ: নিজ এলাকাকে তিনি খুবই ভালোবাসতেন। এলাকার জন্য কিছু করার চিন্তা-ফিকির তিনি সবমসময় করতেন। বিশেষ করে ধর্মীয় দিক দিয়ে তাঁর জন্ম এলাকা চুয়াডাঙ্গা বাংলাদেশের অন্য অনেক এলাকা থেকে অনেক পিছিয়ে। এখানে গ্রামের পর গ্রাম কোনো আলেম নেই। জাতীয় মানের বড় কোনো ইসলামি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান নেই। ইলমি ও ইসলামি পরিবেশও গড়ে ওঠেনি।
তিনি সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী (রাহ.) এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলতেন, তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। তবুও নিজ এলাকার কথা ভুলে যান নি। নিয়মিত গ্রামে যাওয়া-আসা করতেন। সেখানে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে দেখাশোনা করতেন। তিনি বলতেন, আমারও ইচ্ছা আছে, চাকুরির দায়িত্ব শেষ হলে এলাকায় চলে যাব। আলমডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র মীর মহিউদ্দীন আমার বন্ধু মানুষ। সে বধ্যভূমির পাশে অনেক জমি নিয়ে গোরস্থান-মসজিদ করেছে। আমি তার কাছ থেকে কিছু জমি চেয়ে নিয়ে মাদরাসা করব। সে নিশ্চয় দেবে, না করবে না।
মৃত্যু: ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট তিনি ঢাকায় ইন্তিকাল করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। পরদিন ১৫ আগস্ট গ্রামের বাড়িতে তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত মসজিদের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। মৃত্যুর সময় তিনি স্ত্রী, চারকন্যা ও একপুত্র রেখে যান।
কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি এলাকার বাইরে চলে গেছেন। মাঝেমাঝে শুধু বাড়িতে আসতেন। তবুও তাঁর বাল্যবন্ধু ও এলাকাবাসীর সাথে তাঁর সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয় নি। বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক নিত্যদিন দেখাসাক্ষাৎ হওয়া বন্ধু ও নিকট প্রতিবেশির মতোই অটুট ছিল। তাঁর মৃত্যু সংবাদ এলাকায় প্রচার করে জানাযার কথা জানানো হলে ১৫ তারিখ সকাল থেকেই লোকজন তাঁর বাড়িতে আসা শুরু করে। মরদেহ বাড়িতে পৌঁছনোর আগেই লোকজন ভরে যায়।
তখনো মরদেহ বাড়িতে পৌঁছে নি। আমরা বসে আছি তাঁর বাল্যবন্ধু মাওলানা আবু মুসা মোহাম্মাদ আলী (রাহ.) এর নিকট। তিনি তাঁদের বাল্যকালের স্মৃতিচারণ করছেন; চোখ তাঁর অশ্রুসিক্ত। তিনি বললেন, আমার এক জামাতা মারা গেছে, ব্যথা পেয়েছি। কিন্তু আজ ওমরের মৃত্যুতে মনে হচ্ছে আমার একটা হাত যেন ভেঙে গেল।
ইন্তিকালের কিছুদিন আগে আমি ও মুফতি হুমায়ুন কবীর তাঁর কোনাপাড়ার বাসায় গেছিলাম সাক্ষাৎ করতে। সেদিনের নাস্তায় আম ছিল। তিনিও আমাদের সাথে নাস্তায় শরিক হয়েছিলেন। আম খেতে খেতে তিনি বলছিলেন, আল কুরআন আরবে নাযিল হয়েছে। আরব দেশের ফল-ফলাদির বর্ণনা কুরআনে আছে। যদি বাংলায় কুরআন নাযিল হত, আমাদের আমের কথাও হয়ত কুরআনে উল্লেখ হত।
-এটি