মুশতারী তাসনীম মুননী।।
যা লিখেছি, তা বাবার প্রেরণায়। তখন কি ভেবেছিলাম, যার প্রেরণায় লেখার শুরু, তাঁর স্মৃতিগুলো লিখতে হবে!
বাবার সঙ্গে খুব কম সময় কাটিয়েছি। তাঁর দীর্ঘ জীবনের অবসর টাইম ছিলাম আমরা। সময়-সুযোগ হলেই আমরা তাকে অতিথি হিসেবে পেয়েছি।
বলা ভালো- আমরা বাবার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় দু’পরিবার হলে , যে কোনও এক পরিবার প্রাধান্য পায়। সবার ক্ষেত্রে দু’পরিবারে একইভাবে সময় দেয়া সম্ভব হয় না। তাই এক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে ছিলাম।
বাবার প্রথম পক্ষ নারায়ণগঞ্জ ওখানে বাবার রয়েছে পুরো পরিবার। আমাদের জন্য ওখানে রয়েছেন পাঁচ ভাই, তিন বোন। একজন মা।
সবই দূর থেকে জানা। বাবার মৃত্যুর আগে কখনও মুখোমুখি হইনি। বাবা চাইতেন না। আমরাও ইচ্ছে প্রকাশ করিনি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের জানার, দেখার, বোঝার ইচ্ছে ছিলো। কল্পনায় ভাইগুলোকে দেখতাম, বড় বোনদের দেখতাম। ভালোবাসতাম, ভালো লাগতো। কিন্তু তা গোপনে একেবারেই গোপনে।
বাবাকে শৈশবে খুব ভয় পেতাম, দূর থেকে দাঁড়িয়ে সালাম দিতাম। বাবাও ব্যাপারটা ওভাবেই গ্রহণ করতেন। সেই ছেলেবেলায় বাবা আমাদের নারায়ণগঞ্জ নিয়ে যায়। আমরা তখন অতশত বুঝি না। কিন্তু আমার মায়ের স্বপ্ন পুরন হয়। শুরু হয় তার নিজ সংসার। রোপন হয় ভবিষ্যত।
আমরা ছিলাম নারায়ণগঞ্জ জালকুড়ি এলাকায়। ছাব্বিশ রমজান, দাওয়াত ছিলো মিরপুরে। বড় খালার বাসায়। খালি ঘরে আমাদের স্বপ্নের ভবিষ্যতে আগুন জ্বলে। অঙ্গার হয়ে যায় মায়ের সাজানো সংসার।
সেদিনের মায়ের আহাজারি ছোট্ট হৃদয় দাগ কেটেছিলো। ফিরে আসি নানার দেশে বরিশাল। যেখানে আমার শৈশব, কৈশোর এবং বর্তমান। এখানেই এখন আমাদের আবাসস্থল। সেই ঘরপোড়ার আঘাতে বাবাকে প্রথম কাঁদতে দেখেছি। আর এখান থেকেই শুরু আমাদের সংগ্রাম।
সেই আঘাতের পরই মায়ের কোলজুড়ে আসে ছেলে সন্তান। বাবা বড় আদরে নাম রাখেন রেদোআন। কোলে নিয়ে দোয়া দিয়েছিলেন তিনি। মা কে বলেছিলেন, তোমার কোলজুড়ে ইউসুফ এসেছে। সাবধানে রেখো, আগলে রেখো।
আমার মা প্রায় বিশ বছর ধরে বিনামূল্যে মক্তব পড়িয়ে আসছে। বাবার অনুমতিতে বাসায় সপ্তাহিক তালিম হয়। বাবা প্রায়ই মাকে বলতো, তুমিতো আখিরাত গুছিয়ে নিচ্ছো। আখিরাতে আমাকে চিনবে তো?
আমাদের জন্য বাবা ছিলো এক সম্মান আর শ্রদ্ধার নাম। আরবির জগতে তিনি ছিলেন গুরুগম্ভীর উস্তাদ। আরবি হরফ থেকে আয়াতগুলো এমনভাবে ধরতেন, ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যেতো। আবার পড়া শেষ হলে আদরে পিঠ চাপড়ে দিতেন।
বাবা ভীষণ রকমের পড়ুয়া ছিলো। বইয়ের বিশাল এক সম্রাজ্য ছিলো তার। বাবার হাত ধরেই আমার বইয়ের রাজ্যে প্রবেশ। বাবা মেয়ে মিলে বইয়ের জন্য বহু বকা শুনেছি মায়ের। বইয়ের গল্পে খাবার ঠাণ্ডা হতো বলে।
কাবার পথে, আদর্শ নারী, নকীব, রাহমানি পয়গামসহ ছোট বড়ো লেখাগুলো বাবার প্রশংসা কুঁড়াতো খুব। বলতো একসময় যখন বয়স হবে আমার তখন আমি তোর লেখাগুলো শুয়ে শুয়ে পড়বো। আহা! অলসতা আমাকে লেখার জগত থেকে বহুদুরে সরিয়ে নিলো।
একটু বড় হতেই বাবা আমাকে মা বলে ডাকতো। বলতো, তুই আমার মায়ের মতো গোছালো। বাবা সবসময়ই পরিপাটি চলাফেরা পছন্দ করতো। পোশাকের ব্যাপারে তার রুচিবোধ ছিলো দারুন। পরিচ্ছন্ন জীবন যাপনে খুশি ছিলেন তিনি।
শুয়ে শুয়ে, বন্ধ চোখে তেলাওয়াত তার অন্যতম অভ্যাস। খুব ভালো লাগতো আমার। এই বয়সে এসেও বিভিন্ন ক্বারীদের তেলাওয়াতের সাথে সুর মেলাতেন তিনি। রেদোয়ান কে এভাবেই তেলাওয়াতের জন্য উৎসাহিত করতেন।
বাবা পিঠা ভীষণ রকমের পছন্দ করতো। আমার নানুমনি, খালামনি জীবদ্দশায় রকমারি পিঠার আয়োজন করতো বাবা এলেই। বাবা সেই মাঝরাতে শীতের দিনে খেজুর রসের পিঠা আস্বাদন করতেন। পরবর্তীতে আমরা বোনেরা বাবার জন্য বিভিন্ন পিঠা তৈরি করতাম। বাবাও পাশে বসে গল্প জমিয়ে বসতেন। কি মধুর সেই স্মৃতি।
বাবার উপস্থিতি যদিও ওভাবে আমাদের জন্য ছিল না, কিন্তু আমরা তার মতামত ইচ্ছেমতোই চলেছি। অবাধ্যতা কিংবা বেয়াদবী আমাদের লাইফ ডিকশনারীতে নেই। এটা মায়ের শিক্ষা।
বাবা কোনও দিন ধর্মীয় গোঁড়ামি দেখাননি। আবার ধর্মের ব্যাপারে শীথিলতাও ছিল না। আমাদের জন্য তিনি ছিলেন আদর্শের। তিনি বলতেন মেয়েদেরও যথেষ্ট পরিমাণে শিক্ষার প্রয়োজন আছে। আমাদের ভার্সিটিতে পড়াশোনায় তার কোনও আপত্তি ছিল না। ভার্সিটিতে পর্দার সাথে আমরা আপোষ করিনি। এজন্য শিক্ষক শ্রেণী বাবার সাথে প্রশংসা করলে তিনি খুব খুশি হতেন। বলতেন প্রয়োজনে পর্দার সাথে তোরা এগিয়ে যাবি। শুধু নিজ তাকওয়া বিসর্জন দিবি না, তবেই সফল হবি।
বাবার পছন্দের ছেলেকেই এক বাক্যে বিয়ের জন্য সম্মতি দিয়েছিলাম। জানতাম বাবা আমার জন্য সবচেয়ে চিন্তা করেন। আমাদের জন্য তিনি অবশ্যই উত্তম কাউকে বেছে নিবেন। বিশ্ব ইজতেমায় বাবার উপস্থিতিতে আমার বিয়ে হয়। বাবার মসজিদের সন্নিকটে। প্রতিটি জুমাবার বাবার খুতবা শুনতাম। আর মনে হতো বাবা আমার শিয়রে দাড়িয়ে আছেন।
আজ বাবা নেই, মসজিদের মিম্বর আমার জন্য শুন্য হয়ে গেছে। নেই চেনা সুর, নেই সেই উচ্ছ্বাস। মসজিদ ডিঙ্গিয়ে যতবার আসবো, ততবারই বাবার স্মৃতি আমার চোখের কোনে জমা হবে বিন্দু বিন্দু জলে।
বাবার স্মৃতিতে বিষাদেরও দিন আছে! আজ অব্দি কোনও ঈদেই আমাদের সঙ্গ দিতে পারেননি। ঈদের নামাজ শেষে তার গন্তব্য ছিলো নারায়ণগঞ্জ। সপ্তাহ শেষে আমরা তাকে পেতাম। এমনকি আমাদের পরিবারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে আমরা তাকে পাইনি ব্যস্ততার জন্য।
বাবার শুন্যতা আমাদের জন্য বিরহের ছিলো। তবুও প্রতীক্ষিত ছিলাম, বাবা আসবে। এখন সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে। চিরদিনের জন্য।
বাবা চাইতেন তার জীবদ্দশায় আমরা কখনও ওদিকে না যাই। বলতো আমি তোদের ভালোর জন্যই বলছি। তোদের সম্মান এতে অক্ষুণ্ণ থাকবে। আমরা এই ওয়াদা রেখেছি বাবা। বাবার প্রতি হাজার অভিযোগ, শুন্যতা স্বত্বেও আমরা অবাধ্যতা করিনি। উচ্চস্বরে কোনও দিন কথাও বলিনি। আমৃত্যু বাবা আমাদের প্রতি, আমার মায়ের প্রতি খুশি ছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ।
আমরা বাবার প্রভাব, পরিচয় খাটিয়ে কখনোই কোনও সুবিধা নেবার চেষ্টা করিনি। কেননা বাবা নিজেই আমাদের সম্পদ ছিলো। তার দোয়ার হাত দুটিই ছিলো আমাদের প্রপার্টি। আজ এই দোয়ার হাত দুটি নিথর হয়ে গেছে। বদ্ধ কবরে তিনি এখন সবার দোয়ার প্রত্যাশা করছেন। আহা, জীবন!
বাবা আপনি নেই, আপনার সম্মান আমরা আমৃত্যু বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করবো। আপনার আমার সৃষ্টিকর্তা আপনাকে ক্ষমা করুক। আমরা আপনার জন্য জান্নাতে অপেক্ষা করবো। আবার একসঙ্গে মিলিত হবার জন্য। আমাদের এই বিরহ যেন আল্লাহর জন্য হয়। আমরা যেন সবরের শিখরে থাকতে পারি।
লেখিকা: সাহেবজাদি, মাওলানা হাবীবুল্লাহ বাহার রহ.