।।মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন।।
আল্লামা ও বিশেষজ্ঞ- শব্দ দু’টো নিয়ে কিছু কথা বলার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। ইদানিং ব্যাপকহারে শব্দ দু’টোর অপব্যবহারই এই আবশ্যকতা দেখা দেয়ার কারণ। শব্দ দু’টোর এমন অপব্যবহার শুরু হয়েছে যে, শব্দ দু’টো তার আপন মর্যাদার উঁচু স্তর থেকে অধ:পতিত হয়ে রীতিমত ধুলোয় পদদলিত হচ্ছে। শব্দ দু’টো নিয়ে সংক্ষেপে পৃথক পৃথক আলোচনা পেশ করা গেল।
প্রসঙ্গ: আল্লামা
‘আল্লামা’ (علامة) শব্দটি আরবী মুবালাগা-এর সীগা (অর্থাৎ আধিক্য জ্ঞাপক শব্দ)। তাও সিঙ্গল মুবালাগা নয়, ডবল মুবালাগা। কেননা শব্দটির علام (আল্লাম)- এতটুকুই মুবালাগার সীগা, আবার তার সঙ্গে যুক্ত ة (গোল তা)ও মুবালাগাহ-এর অর্থ জ্ঞাপনের জন্য।
وفي المعجم المناهي اللفظية : صيغة علام صيغة مبالغة. وفي مختار الصحاح لمحمد الرازي وجمهرة اللغة لابن دريد : رجل علامة اي : عالم جدا والهاء للمبالغة.
আল্লামা শব্দটি মুবালাগার সীগা হিসেবে তার অর্থ কি হবে সে ব্যাপারে বিভিন্ন অভিধানের বর্ণনা ও উলামায়ে কেরামের ভাষ্য এরূপ- كثير العلم/غزير العلم (অনেক জ্ঞানী) واسع العلم (ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী/বিশাল পাণ্ডিত্বের অধিকারী) عالم كبير (বড় আলেম) عالم جدا (খুব জ্ঞানী) متبحر في العلوم (গভীর জ্ঞানের অধিকারী/জ্ঞানের সমুদ্র) এসব অভিব্যক্তিতে সিঙ্গল মুবালাগার অর্থ প্রকাশ পেয়েছে। সুতরাং ডবল মুবালাগা হিসেবে আল্লামা শব্দটির অর্থ দাঁড়াবে- অনেক অনেক জ্ঞানী, অত্যন্ত ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী, বিরাট বড় আলেম, জ্ঞানের বিশাল সমুদ্র।
আল্লামা-এর পরিচয়ে পেশকৃত এসব বর্ণনা সামনে রাখলে কোনক্রমেই একজন সাধারণ আলেমকে আল্লামা আখ্যায়িত করার অবকাশ বের হয়ে আসে না। যদিও অনেক অনেক জ্ঞানী কথাটির মধ্যকার ‘অনেক’ বলতে ঠিক পরিমাণ কতটা তার পরিমাপ নির্দিষ্ট করা কঠিন, এমনিভাবে বড় জ্ঞানী কথাটির মধ্যকার ‘বড়’ বলতে ঠিক কি সাইজের তা দৈর্ঘ প্রস্থ এঁটে বলা কঠিন, তবে ‘অনেক’ বলতে সাধারণ পরিমাণের চেয়ে যে বেশি তা তো স্পষ্টই।
এমনিভাবে ‘বড়’ শব্দ থেকেও সাধারণ মাপের যে নয় তা তো স্পষ্টই। আবার এটাও স্পষ্ট যে, জ্ঞানের পরিমাণ একটু বেশি হলেই তিনি আল্লামা আখ্যায়িত হবেন না, অনেক অনেক বেশি হতে হবে। কারণ আল্লামা অর্থ অনেক জ্ঞানী নয়, অনেক অনেক জ্ঞানী। অতএব ঢালাওভাবে সর্বস্তরের সব আলেমকে আল্লামা আখ্যায়িত করার অবকাশ যে কোনক্রমেই বের হবে না তা স্পষ্ট হতে আর বাকি রইল কোথায়। এখন রয়ে গেল তাহলে
আল্লামা-র পরিচয়ে উক্ত এই অনেক অনেক জ্ঞানী, অত্যন্ত ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী, বিরাট বড়, জ্ঞানের বিশাল সমুদ্র- এ বিশেষণগুলো কোন পর্যায়ের আলেমের ব্যাপারে প্রযোজ্য? তো কেউ কেউ বলেছেন, যিনি جامع المعقول والمنقول (জামিল মা’কূল ওয়াল মানকূল) তার ব্যাপারে প্রযোজ্য। আরবী এ কথাটির ব্যাখ্যা হল যার মধ্যে কুরআন, হাদীছ, তাফসীর, ফেকাহ প্রভৃতি বর্ণনাজাত শাস্ত্র তথা অহী নির্ভর শাস্ত্র এবং এ শাস্ত্রগুলো বোঝার জন্য আবশ্যক আনুষঙ্গিক বুদ্ধিজাত শাস্ত্রসমূহ- সবটার জ্ঞান রয়েছে তার ব্যাপারে আলেম আখ্যাটি প্রযোজ্য।
এই যেখানে ‘আল্লামা’ উপাধির মোটামুটি পরিচয়, সেখানে সম্প্রতি ছোট বড় নির্বিশেষে ঢালাওভাবে সব আলেমকেই আল্লামা উপাধিতে ভূষিত করার যে তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে সেটাকে কী বলা যায়? সেটাকে বলা যায় মূর্খতা প্রসূত তৎপরতা, বিচার বিবেচনাহীন তৎপরতা।
কঠিনভাবে বললে সেটা মিথাচারিতাও। কঠিনভাবে বললে সেটা প্রতারণাও বটে। কারণ এরূপ বলায় অনেক বড় না হওয়া সত্ত্বেও বহু লোক তাকে অনেক বড় ভেবে এবং সেভাবে তার কথাকে মূল্যায়ন করে প্রতারিত হবে। অতএব যারা প্রকৃত আল্লামা না হওয়া সত্ত্বেও অর্থাৎ অনেক অনেক জ্ঞানী না হওয়া সত্ত্বেও, বিরাট বড় আলেম না হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের নামের সঙ্গে আল্লামা খেতাব জুড়ে দেন, তারা মিথ্যাচারিতা ও প্রতারণার দায় এড়াতে পারেন না।
তদুপরি আল্লামা না হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে আল্লামা দাবি করা হচ্ছে নিজের যে গুণ-গরিমা নেই তা দাবি করা। আর হাদীছে এসেছে- রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ومن ادعى ما ليس له فليس منا وليتبوأ مقعده من النار অর্থাৎ যে নিজের জন্য দাবি করবে এমন গুণ-গরিমা প্রভৃতির কথা যা তার নেই সে আমাদের আদর্শভুক্ত নয়। সে যেন তার আসন জাহান্নামে স্থির করে নেয়। (মুসলিম)
এতক্ষণের আলোচনায় স্পষ্ট হল, আল্লামা না হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে আল্লামা দাবি করার মধ্যে রয়েছে বহুবিধ পাপ। এক পাপে বহু পাপ অন্তর্ভুক্ত। অতএব তা থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব, তাতে জড়িত হওয়া গোনাহে কাবীরা। এটা যে গোনাহে কাবীরা তা বুঝে আসে উপরোক্ত হাদীছে ব্যাক্ত জাহান্নামের ধমক থেকে। হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর বর্ণনামতে কোন গোনাহের ব্যাপারে জাহান্নামের ধমক বা শাস্তির ধমক আসা সেই গোনাহের গোনাহে কাবীরা হওয়া বোঝায়।
যদি এমন হয় যে, কোন আলেম আল্লামা নন আর তিনি নিজে নিজেকে আল্লামা বলে পরিচয়ও দিচ্ছেন না কিন্তু অন্যরা সেরূপ বলছে আর তিনি তা থেকে বাধা না দেয়ার মাধ্যমে কার্যত তার সমর্থন করে যাচ্ছেন, তাহলেও পাপকে সমর্থন করা পাপ- এর আওতা থেকে তিনি বের হতে পারবেন না।
হাস্যকর ব্যাপার হল- ইদানিং এমন অনেককেও আল্লামা আখ্যায়িত করতে শোনা যাচ্ছে যারা যের জবর ছাড়া আরবী ইবারত শুদ্ধভাবে পড়তে পর্যন্ত সক্ষম নয়, যাদের কুরআন হাদীছ বিশুদ্ধভাবে বোঝার জন্য আবশ্যক নাহু সরফ প্রভৃতি শাস্ত্রের পর্যাপ্ত পরিমাণ জ্ঞানও নেই। এ সমস্ত লোকদের কি নিজেদের এভাবে পরিচয় দিতে কিংবা তার সমর্থন করতে একটুও বাধে না? সামান্য জ্ঞান নিয়ে কীভাবে তারা নিজেদেরকে
আল্লামা তথা বিরাট বড় আলেম বা জ্ঞানের বিশাল সমুদ্র বলে পরিচয় দিতে পারেন বা সেরকম পরিচয় দেয়াকে সমর্থন করতে পারেন! এটা যে বোদ্ধাদের কাছে হাস্যকর মনে হয় তাও কি তারা আঁচ করতে পারেন না? তাদের উচিৎ নিজেদের কলবকে জিজ্ঞেস করা আসলেই কি তারা আল্লামা। তাদের কলব ঠিকই তাদেরকে প্রকৃত উত্তরটা দিয়ে দেবে। হাদীছের ভাষায় বলা যায়, استفت قلبك (তুমি তোমার কলবকে জিজ্ঞেস করে দেখো।)
বর্তমানে কেউ কেউ গণহারে আল্লামা উপাধি ব্যবহারের পক্ষে এরূপ একটা কথার অবতারণা করেছেন যে, একজন আলেম প্রসিদ্ধ হলেই তাকে আল্লামা বলা যায়। অর্থাৎ একজন আলেমের নাম-শোহরত হয়ে গেলেই তাকে আল্লামা উপাধি দেয়া যায়। কিন্তু এটা স্বকপোল কল্পিত ব্যাখ্যা। আল্লামা শব্দের সীগা ও ধাতুমূল এমনটা বলে না। আল্লামা শব্দের সীগা ও ধাতুমূলে জ্ঞানের আধিক্যের বিষয় রয়েছে নাম শোহরতের আধিক্যের নয়।
প্রসঙ্গ: বিশেষজ্ঞ
‘আল্লামা’-এর ন্যায় ‘বিশেষজ্ঞ’ শব্দেরও ঢালাও প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞ শব্দের আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে متخصص (মুতাখাসসিস) আর ইংরেজি প্রতিশব্দ Specialist (স্পেশ্যালিস্ট)।
ইদানিং অনেকে একটা শাস্ত্রের ছিটেফোটা দু’চারটে কথা শিখেই নিজেকে সেই শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ (বা ইংরেজিতে স্পেশ্যালিস্ট) বলে পরিচয় দিচ্ছেন, অথচ তাদের জন্য ‘বিশেষজ্ঞ’ উপাধি প্রযোজ্য নয়। কেননা বিশেষজ্ঞ শব্দটি গঠিত হয়েছে ‘বিশেষ’ ও ‘জ্ঞ’ যোগে (বিশেষ+জ্ঞ=বিশেষজ্ঞ)।
আর অভিধানের বর্ণনা মোতাবেক বিশেষ শব্দে আধিক্য ও অসাধারণত্বের অর্থ রয়েছে আর ‘জ্ঞ’ জ্ঞান অর্থ প্রদান করে। সেমতে কোন শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ তিনি যিনি ঐ শাস্ত্রে অধিক ও অসাধারণ জ্ঞান রাখেন। এজন্যই অভিধানে বলা হয়েছে, বিশেষজ্ঞ শব্দটি বিশেষণ, যার অর্থ সুপণ্ডিত, কোন বিষয়ে যিনি উত্তমরূপে জানেন। এখানেও লক্ষ্যণীয় শুধু পণ্ডিত বলা হয়নি বলা হয়েছে সুপণ্ডিত এবং কোন বিষয়ে যিনি জানেন বলা হয়নি উত্তমরূপে জানেন বলা হয়েছে।
অতএব একটা শাস্ত্রে সাধারণত মানুষের যতটুকু জ্ঞান থাকে তার চেয়ে অধিক জ্ঞান না থাকলে, সেই শাস্ত্রে সুপণ্ডিত না হলে, সেই শাস্ত্র উত্তমরূপে না জানলে কাউকে সেই শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ বলা যেতে পারে না। তাহলে কেউ একটা শাস্ত্রের ছিটেফোটা কিছু শিখেই কীভাবে নিজেকে সেই শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ বলে দাবি করতে পারেন বা কেউ তাকে সেরূপ আখ্যায়িত করলে তিনি তা সমর্থন করতে পারেন?
পূর্বে ভুয়া আল্লামা দাবি করলে কী কী খারাবী দেখা দেয় সে পর্যায়ে যে কথাগুলো বলা হয়েছে এখানেও সেগুলো প্রযোজ্য। অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ না হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে বিশেষজ্ঞ বলে দাবি করা মিথ্যাচারিতা ও প্রতারণা। আর সেরূপ দাবিকে সমর্থন করে যাওয়া পাপের সমর্থন হিসেবে পাপ। তদুপরি বিশেষজ্ঞ না হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে বিশেষজ্ঞ দাবি করা হচ্ছে নিজের যে গুণ-গরিমা নেই তা দাবি করা, পূর্বে বর্ণিত হাদীছের আলোকে যা কঠিন পাপ।
আল্লামা ও বিশেষজ্ঞ প্রসঙ্গে এতটুকুই। এর চেয়ে অধিক কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
আল্লাহ আমাদেরকে ভারসাম্য দান করুন। [লেখকের নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে নেয়া]
-কেএল