।।মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন।।
আদি কাল থেকে অফলাইনেই দ্বীনী ইলম অর্জনের ধারাবাহিকতা চলে আসছে। সরাসরি কোন ব্যক্তি থেকে শুনে বা কোন ব্যক্তির রচিত কিতাবপত্র পাঠ করে দ্বীনী ইলম অর্জনের যে ধারাবাহিকতা সেটিই হল অফলাইনের ধারাবাহিকতা।
কিন্তু সম্প্রতি অফলাইনের পাশাপাশি জ্ঞান অর্জনের আর একটা লাইন চালু হয়েছে, সেটার নাম অনলাইন। অনলাইন বলতে নেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব প্রভৃতি সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে। এই অনলাইনে এখন প্রচুর লোক জ্ঞান অর্জন করছে এবং এ লাইনটা সহজিয়া লাইন হওয়ার কারণে দিন দিন এখানে ভিড় বাড়ছে।
এটাকে সহজিয়া লাইন বললাম এ কারণে যে, এ লাইনে জ্ঞান অর্জন করার জন্য কিতাবপত্র সংগ্রহের ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয় না, কিতাবপত্র ঘাটাঘাটির কষ্ট করতে হয় না, জানার জন্য কারও কাছে যাওয়া বা কোথাও সফর করার কষ্টও সইতে হয় না। শুধু মোবাইলে বা কম্পিউটারে একটা কিছু লিখে সার্চ দিলেই সাজানো গোছানো রেডিমেড সব তথ্য সামনে চলে আসে।
এভাবে অনলাইনে জ্ঞান অর্জন করা সহজ বটে তবে তাতে বহুবিধ সমস্যাও রয়েছে। শুধু সমস্যা নেই অনলাইনে কেউ যদি কোন গ্রন্থের সফট কপি বা পিডিএফ সংগ্রহ করে তা অধ্যয়ন করে। সেটা অফলাইনে গ্রন্থ পাঠের মতই হবে। সেটা যেকোনো সময় প্রিন্ট দিয়ে হার্ড কপিতে পরিণত করে বই বানিয়ে নেয়া যায়।
নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণিত- এমন কোন লেখকের কোন ব্লগ (প্রবন্ধ/নিবন্ধ), স্ট্রোরি, স্টেটাস ইত্যাদি পাঠ করেও জ্ঞানার্জন করা যেতে পারে। এর বাইরে অনলাইনে জ্ঞানার্জনে রয়েছে বহুবিধ সমস্যা। যেমন:
১. অনলাইনে ইলম কার থেকে গ্রহণ করা হচ্ছে সাধারণত তা যাচাই করে নেয়া হয় না। কেউ যাচাই করে নিতে চাইলেও অনেক সময় প্রয়োজনীয় ডাটা না পাওয়ায় তা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না।
অথচ কারও থেকে দ্বীনী ইলম গ্রহণ করতে হলে আগে তার সম্বন্ধে যাচাই করে নিতে হয় তিনি নির্ভরযোগ্য লোক কি না, তিনি ভাল জাননেওয়ালা কি না, তিনি আমলওয়ালা কি না, তার আকীদা-বিশ্বাস ও চিন্তাধারা সহীহ কি না, তিনি হকপন্থী কি না ইত্যাদি। প্রসিদ্ধ তাবিয়ী হযরত ইবনে সিরীন রহ. বলেছেন, إن هذا العلم دين فانظروا عمن تأخذون دينكم. অর্থাৎ, ইলম হচ্ছে একটি দ্বীনী বিষয়। অতএব লক্ষ্য রেখো কার থেকে তোমরা তোমাদের দ্বীন গ্রহণ করছো। (মুকাদ্দামায়ে মুসলিম)
২. অনলাইনে ব্যক্তি সম্বন্ধে যাচাই করতে গিয়ে অনেক সময় বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। কারণ একজন লোক যেমন নয় তেমনই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তার সম্বন্ধে প্রচার পাওয়া যায়। পূর্বে ‘ফেসবুকে নামডাক: আহামরি কিছু নয়’ এবং ‘ফেসবুকে কিছু ভাইরাল হওয়া সত্য হওয়ার প্রমাণ নয়’ শিরোনামের দু’টো ব্লগে এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
৩. অনলাইনে যেসব ইসলামী শিক্ষামূলক অডিও ভিডিও পাওয়া যায়, তার মধ্যে প্রচুর ভিত্তিহীন অডিও ভিডিও রয়েছে। কোনটার ভিত্তি আছে কোনটা ভিত্তিহীন তা নির্ণয় করা অনেক সময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
ফলে সেগুলো থেকে অর্জিত জ্ঞানে বিভ্রাট-এর সম্ভাবনা থেকে যায়। এসব অডিও ভিডিও থেকে ইসলামী জ্ঞান অর্জনকারীরা ভুয়া কিংবা অনিশ্চিত জ্ঞানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। পূর্বে ‘ইউটিউবে ইসলামী ভিডিও: কতকিছু ভিত্তিহীন’ শিরোনামের একটি ব্লগে এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
৪. ইদানিং অডিও ভিডিওতে কোন ব্যক্তির কন্ঠে যেসব কথা উচ্চারিত হয় ঐ কথাগুলো যে ঐ ব্যক্তিরই তার নিশ্চয়তাও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি কানাডার কিছু বিজ্ঞানী এমন এক সফটওয়্যার আবিষ্কার করেছে যা দ্বারা যে কোন ব্যক্তির কন্ঠ কপি করে তা দিয়ে আরও বহু শব্দ ও কথা তৈরি করা যায়, যেগুলো শুনলে মনে হবে হুবহু সেই ব্যক্তিরই কথা।
যদিও মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই সফটওয়্যার অনুমতি পায়নি, তবে হ্যাকারদের হাতে ইতিমধ্যে তা পৌঁছে গেছে। তাই যেকোনো সময় এর অপব্যবহার ছড়িয়ে পড়তে পারে। (ইতিমধ্যে বিভিন্ন জনকে অন্যায়ভাবে ফাঁসানোর কাজে এর ব্যবহার শুরুও হয়ে গেছে।) এরূপ অপব্যবহার দ্বীনী অডিও ভিডিওর ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হতে পারে।
তাহলে কার অডিও ভিডিও শুনে আস্থা করা যাবে? সন্দেহের মধ্য দিয়েই চলবেন? তা কোন রকম সন্দেহ বা অস্পষ্টতা নিয়ে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা তো বিধিবদ্ধ নয়।
৫. বিভিন্ন ওয়েবসাইটে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তার ওপরই বা কতটুকু আস্থা করা যায়? অনেক সময় এমন হয় কিছুদিন পর খুঁজলে সেই ওয়েবসাইটের পাত্তাই নেই কিংবা ইতিমধ্যে পূর্বে পেশকৃত তথ্যের মাঝে আমূল পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। কেন পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে তার কোন ব্যাখ্যাও নেই।
কিছু লেখক ও গবেষককে আমরা দেখেছি যারা অফলাইনে পড়াশোনা ছাড়া শুধুই এ জাতীয় ওয়েবসাইট নির্ভর তথ্যের ভিত্তিতে কোন রচনা বা গবেষণাপত্র দাঁড় করেছে তারপর এক সময় তাদের কাছে কোন তথ্যের বরাত তলব করা হলে তারা সেসব ওয়েবসাইট খুঁজেই পায়নি। তখন তাদের অবস্থা হয়েছে শুধু কটমট করছে- শালার পুত তথ্যগুলো গেল কোথায়! কিংবা আমি এখন কার খালু।
অফলাইনে পড়াশোনা করলে এসব বিভ্রাট দেখা দেয় না। তবে হ্যাঁ অনলাইনে পেশকৃত তথ্যাবলির রেফারেন্স খুঁজে সেই রেফারেন্স বুকগুলোর সঙ্গে যদি সরাসরি মিলিয়ে নেয়া হয় এবং তার উপরই আস্থা করে সবকিছু দাঁড় করানো হয় তাহলে এমনতর সমস্যা দেখা দেয় না। এ পদ্ধতিতে অনলাইনের বর্ণনাকে ফাইনাল হিসেবে নয় বরং তথ্য খুঁজে পাওয়ার সহায়ক হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এটা লেখক গবেষকদের কাজে আসানী পয়দা করে।
৬. যারা লেখাজোখার কাজ করেন বা গবেষণা করেন তারা অনলাইনে পেশকৃত রেফারেন্স-এর ওপর কতটুকু ভরসা করতে পারেন? অনেকেই তো বরাত দিয়ে থাকে আরেকজনের বরাত দেখে।
অথচ সে বরাত হয়ে থাকে ভুল। এ সমস্যা অনলাইনের ন্যায় অফলাইনেও আছে, তবে পার্থক্য হল অফলাইনে বরাত প্রদানকারীদের খুঁজে পাওয়া যায়, প্রয়োজনে তাদের সাথে পর্যালোচনাও করে নেয়া যায়, কিন্তু অনলাইনের বরাত প্রদানকারীরা কোন ফাঁকে যে চুপচাপ কেটে পড়ে, তা মালূমও করা যায় না।
৭. অনলাইনে পেশকৃত দলীল-প্রমাণের টেক্সটগুলোর ওপর (যেমন হাদীছের মতনের ওপর) কতটুকু ভরসা করা যায়? যেখানে অফলাইনের কিতাবপত্রে বহু প্রুফ দেখা ও বহুবার যাচাই-বাছাই পূর্বক মুদ্রণ সত্ত্বেও হাদীছের মতনে এমনিভাবে তাফসীর, ফেকাহ প্রভৃতির মতনে প্রচুর গরমিল পাওয়া যায় (মূল কিতাবের মতনের সঙ্গে মিলালে যা অহরহ ধরা পড়ে)।
যেমন মেশকাত শরীফ ও কানযুল উম্মালে এমনটা প্রচুর ধরা পড়ে। বর্তমানে প্রচলিত মাকতাবায়ে শামেলাতেও প্রচুর এমন ভুল-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়। অথচ লেখক গবেষকদের দলীল-প্রমাণের টেক্সটগুলোর ওপর পূর্ণ নিশ্চয়তা অর্জন হওয়া আবশ্যক।
৮. অনেকেই মূল কিতাবের সাথে মতন না মিলিয়েই আরেকজনের বর্ণনা করা মতন নকল করে দেন, আর এভাবে নকল হতে হতে মতন কোথা থেকে কোথায় চলে যায়! এ সমস্যা অফলাইনেও হয়ে থাকে, তবে অনলাইনের সহজিয়া অঙ্গনে এটা খুব বেশি হয়ে থাকে। তাহলে শুধু অনলাইন নির্ভর ইলম দিয়ে কীভাবে নিশ্চিত পথ চলা সম্ভব?
৯. একটা সময় ছিল যখন গোটা দুনিয়ায় ইসলামী কিতাবপত্র ছিল দশ বিশটা, পঞ্চাশটা, একশ দু’শটা। তখন একজন লোকের পক্ষে সবগুলো কিতাব পাঠ করা এবং একই কিতাব বারবার পাঠ করে মুখস্থ বা আত্মস্থ করা সাধ্যের মধ্যে ছিল, সহজ ছিল। বলা যায় তখন আলেম ও পণ্ডিত হওয়া সহজ ছিল।
তখন একজন সম্বন্ধে বলা সহজ ছিল যে, সব কিতাবপত্র তার পড়া আছে। কিন্তু কালক্রমে এখন ইসলামী বইপত্রের সংখ্যা লাখো লাখো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন একজন আলেমের পক্ষে সব ইসলামী বই আদ্যোপান্ত পাঠ করা এবং কোন বইতে কী আছে তা সব তাফসীলী মনে রাখা সম্ভবপর থাকেনি।
এখন এতটুকু মনে রাখতে পারাই অনেক যে, অমুক বিষয়ের আলোচনা অমুক অমুক কিতাবে আছে, অমুক বিষয়ের আলোচনা অমুক অমুক কিতাবে আছে। প্রয়োজনের সময় সংশ্লিষ্ট কিতাবগুলো দেখে নেয়া। বর্তমান যুগে কেউ এতটুকু হতে পারলেই তিনি বড় আলেম বা বড় পণ্ডিত।
কিন্তু অনলাইনে এখান থেকে ওখান থেকে বিভিন্ন ওয়েবসাইটের ছড়ানো ছেটানো তথ্য সংগ্রহ করে পণ্ডিত হতে চাইলে তেমনটাও হবে না। কেননা প্রয়োজনের সময় হয়তো সেসব ওয়েবসাইটের পাত্তাই পাওয়া যাবে না। তদুপরি এসব নেট ফেট কতদিন থাকবে বা কীভাবে থাকবে, ভবিষ্যতে কী রূপ নেবে- সবই তো অনিশ্চিত।
১০. অনলাইনে কিতাব বা উস্তাদ সেভাবে সামনে না থাকায় ইলমের প্রতি যে আজমত জাগ্রত হওয়া কাম্য তা হয় না। এটা দ্বীনী ইলমের জন্য অনুকূল নয়।
১১. মূল কিতাবপত্র ঘাঁটলে যে নজর পয়দা হয় অনলাইনে তথ্য ঘাটার দ্বারা সে নজর পয়দা হয় না। এ নজর হল মনের নজর একজন পাঠক চর্মচক্ষু বন্ধ করার পরও মনের চক্ষু দিয়ে যে পঠিত বিষয় এবং কোথায় কীভাবে লেখা তা দেখতে পায় সেই নজর।
১২. সবশেষে কথা হল অনলাইনে বহু রকম সংশয় সন্দেহ বিদ্যমান থাকায় অনলাইন থেকে অর্জিত জ্ঞানে মনের দৃঢ়তা আসে না। অথচ দ্বীনী ইলমের জন্য দৃঢ়তা আবশ্যক। আগেও বলেছি কোন রকম অস্পষ্টতা নিয়ে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা বিধিবদ্ধ নয়।
অনলাইনে দ্বীনী ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে আরও বহু রকমের সমস্যা রয়েছে, এখানে বিশেষ বারটা সমস্যার কথা উল্লেখ করা হল।
এখন কথা হল- সাধারণ মানুষ এতসব সমস্যার আবর্ত থেকে কীকরে গা বাঁচিয়ে সুষ্ঠভাবে দ্বীনী ইলম অর্জন করতে পারবে? এটা তো বহু পঙ্কিল পথ, বহু ঝামেলাপূর্ণ পথ। তাই বলছিলাম, দ্বীনী ইলম অর্জন অনলাইনে নয় অফলাইনেই শ্রেয়! [লেখকের নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে নেয়া]
-কেএল