করোনাকালে বাংলাদেশের ৩৪ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ-তরুণীর মানসিক চাপ আগের চেয়ে অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের মানসিক অস্থিরতায় ভুগে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ-তরুণী শারীরিকভাবে নিজের ক্ষতি করছেন। মানসিক বিভিন্ন চাপের ফলে অনেকের মধ্যেই আত্মহত্যা করার প্রবণতা দেখা গেছে। এ সময় ৫০ দশমিক ১ শতাংশই আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেন। তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশনের ‘আত্মহত্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তরুণদের ভাবনা’ শীর্ষক নতুন এক জরিপে এমনটি উঠে এসেছে।
মানসিক চাপ, হতাশাসহ বিভিন্ন কারণে জীবনের প্রারম্ভেই যেন ঝরে পড়তে যাচ্ছে আমাদের তরুণ সমাজ। তরুণদের সমস্যা, প্রতিকার ও নানা দিক নিয়ে আওয়ার ইসলামের সাথে কথা বলেছেন প্রবীণ আলেম ও গবেষক মাওলানা শাহ নজরুল ইসলাম। আওয়ার ইসলামের পক্ষে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন নুরুদ্দীন তাসলিম।
তরুণদের মাঝে মানসিক চাপ ও আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়ছে, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এর কারণ হিসেবে কি চিহ্নিত করতে চান?
আসলে করোনা আমাদের হাতের কামাই। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
...ظهر الفساد في البر والبحر بما كسبت ايدي الناس
আমাদের পাপাচার-অনাচার, সীমালংঘন এসবের কারণেই আল্লাহ তাআলা শাস্তি হিসেবে এই রোগ দিয়েছেন। সঙ্গত কারণেই এ পরিস্থিতিতে আমাদের যুব সমাজের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। কারণ যুব সমাজের স্বভাবই এমন যে, তাদের ভেতর সবসময় এক ধরনের কর্মচাঞ্চল্যতা ও অ্যাক্টিভিটি কাজ করে।
প্রায় দু'বছর ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ আরো অনেক কিছু বন্ধ রয়েছে, এই সময়ে যুবসমাজ ঘরকুনো ও এক জায়গায় আবদ্ধ রয়েছে, কোন কাজ না করে বেকার ঘরে বসে আছে, যা যুবক ও তরুণদের স্বভাবের পুরোপুরি বিপরীত। এসব কারণে তাদের ভিতর এক ধরনের হতাশা তৈরি হচ্ছে যা কাটিয়ে উঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই সময়ে যুবকদের সামাজিক বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে যুক্ত করা উচিত। এক্ষেত্রে সমাজের উন্নয়নে কাজ করছে এমন সংগঠনগুলো এগিয়ে আসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদেরকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করা উচিত।
বর্তমানে ঘরে বসেই অনলাইনে অনেক ধরনের ইনকাম সোর্স রয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এই অলস সময়ে যুবকদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে এই প্ল্যাটফর্ম গুলো সচল করা যেতে পারে।
এক্ষেত্রে সরকার বিভিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। স্থানীয়, এলাকাভিত্তিক যেসব যুব সংগঠন আছে তারা এবং ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে আমাদের এগিয়ে আসা উচিত তাহলেই যুবসমাজ হতাশা এবং মানসিক চাপ থেকে ফিরে আসবেন বলে আশা করা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণরা তাদের সমস্যাগুলো খোলাখুলিভাবে কারো কাছে বলতে পারছেন না। এক্ষেত্রে পরিবার, বন্ধুবান্ধব কি তাদের আরো কাছে আসতে পারে, বা তারা কি ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
আমাদের তরুণরা বর্তমানে এমন পৃথিবীতে বসবাস করছে, যেখানে তাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য তিন ধরনের বাণিজ্য চলছে। যা সারা পৃথিবীর কর্মচঞ্চল যুব ও তরুণ সমাজের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে।
এক নম্বর হলো যৌন বাণিজ্য- যা তাদের মাঝে যৌন উন্মাদনা তৈরি করছে। এ থেকে বের হয়ে আসার উপায় তাদের জানাতে হবে। এসব বিষয়ে তাদের সঠিক তত্ত্বাবধায়ন ও দিকনির্দেশনা দিতে হবে, অন্যথায় তারা দিন দিন বিপথে চলে যাবে, তরুণরা কখনো মুখ ফুটে এসব সমস্যার কথা জানাবে না। তাই অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে, অভিভাবক কম বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে তাদের সাথে।
দ্বিতীয় হলো মাদক-বাণিজ্য। বিশ্বব্যাপী কাচা টাকা ইনকামের জন্য কিছু গ্রুপ অন্যায়ভাবে যুবসমাজকে মাদকের দিকে ধাবিত করছে। এর ভালো-মন্দ কোন দিক তারা বিবেচনা করছে না। যুবসমাজকে এই মাদকাসক্তি থেকে মুক্ত রাখতে অভিবাবকদের তাদের সময় দিতে হবে।
তৃতীয় হচ্ছে অস্ত্র বাণিজ্য। যারা অবৈধ অস্ত্র তৈরি করছে, তারা যুবসমাজকে এসবে দিকে ধাবিত করার চেষ্টা করছে।
এই তিন প্রকারের ভয়াবহ বাণিজ্যের টার্গেট আমাদের যুব সমাজ। তাই কর্মচঞ্চল তরুণদের তাদেরকে রক্ষা করতে আমাদের নিজেদের এগিয়ে আসতে হবে, তাদের মনের কথা আমাদের শুনতে হবে, সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে, তাদের বলতে দিতে হবে, সমাধানের পথ দেখাতে হবে।
এই তিন বাণিজ্য যা যুবসমাজকে প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে সেখান থেকে উত্তরণের চেষ্টা করতে হবে; আবারো বলছি অভিভাবক কম বন্ধু হয়ে তাদের মনের কথা শুনতে হবে।
স্বাভাবিকের তুলনায় সামাজিক মাধ্যমে অনেক বেশি সময় দেওয়া মানসিক চাপ বাড়ার একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন অনেকে- বর্তমান প্রযুক্তির এই সময়ে সামাজিক মাধ্যম থেকে পরিত্রাণের বিকল্প কোন উপায় আছে বলে মনে করেন কি?
আমাদের সবার ২৪ ঘন্টার কাজের রুটিন থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে যত সফল মানুষ আছেন সবার জীবনীতে দেখা যায় তারা টাইম মেইনটেন করেছেন, রোডম্যাপ তৈরি করে কাজ করেছেন। এসবের মাধ্যমে জীবনে সফলতার উচ্চ শিখরে পৌঁছেছেন।
আমি বলব না প্রযুক্তি থেকে আমাদের সরে আসতে হবে; কারণ এই বাস্তবতা থেকে সরে আসা সম্ভব নয়, প্রযুক্তির যে কল্যাণকর দিকগুলো আছে সেগুলো থেকে ভালো বিষয়গুলো নিতে হবে; কিন্তু এর মানে এটা নয় যে এখানে চব্বিশ ঘন্টা পরে থাকতে হবে।
দেখুন আমরা খাবার-দাবারের ক্ষেত্রে বাছ-বিচার ছাড়াই সবকিছুতে ঝাঁপিয়ে পড়ি না, হালাল-হারাম বিবেচনা করে খাই। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে, এখানে হালাল-হারাম অনেক বিষয় রয়েছে সেগুলো মানতে হবে এবং তা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। তাই দিনে কতটুকু সময় ইন্টারনেটে ব্যয় করবো তাও নির্ধারণ করে নিতে হবে। এর মাধ্যমে আমরা ক্ষতিকর দিকগুলো থেকে বাঁচতে পারবো।
[caption id="" align="alignnone" width="227"] প্রবীণ আলেম ও গবেষক মাওলানা শাহ নজরুল ইসলাম।[/caption]
আমি এখানে বলতে চাই আমাদের বইকে বন্ধু বানাতে হবে। ধর্মীয় বই-পত্র কুরআন-হাদীস এগুলোতে সময় দিতে হবে। কুরআন-হাদিসে নিমগ্নতা বাড়ালে এই সংকট উতরিয়ে ওঠা সম্ভব।
বইকে বন্ধু বানানো এবং ২৪ ঘন্টার রুটিনে অন্তত এক ঘন্টা কুরআন তেলাওয়াতে সময় দিলে এ থেকে সাহস, শান্ত্বনা ও সংকট কাটিয়ে ওঠার প্রত্যয় পাব।
এক কথায় জীবনকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। জীবনে যদি শৃঙ্খলা না থাকে, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে সময় কাটানো হয় তাহলে হতাশা তো বাড়বেই।
ডাক্তাররা বলছেন, মানসিক রোগের অন্যতম লক্ষণ হলো ভুলে যাওয়া, কোন কিছু মনে করতে না পারা-এক্ষেত্রে ইসলামি ও ডাক্তারি কি ধরণের পরামর্শ থাকতে পারে?
এটা সাইকোলজিক ব্যাপার; এটা নিয়ে সাইক্রেটিকদের সাথে কথা বলা যেতে পারে। তবে মেধা শক্তি বৃদ্ধি ও ভুলে যাওয়া এ জাতীয় জিনিসগুলো থেকে রক্ষা পেতে ইমাম শাফি রহ. তার ছাত্রকে বলেছেন পাপাচার, পঙ্কিলতা থেকে বেঁচে থাকতে। আমরাও এসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে পারি। এছাড়া দুরুদ শরীফ, ‘রব্বি জিদনি ইলমা’সহ হাদীসে যেসব মাসনূন দোয়া পড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে সেসব পড়া যেতে পারে।
মানসিক চাপ ও আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে মুক্তি পেতে ইসলাম ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাধান কি?
আত্মহত্যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কোরআন শরীফে বর্ণিত হয়েছে,
...لا تقتلوا انفسكم
আত্মহত্যা কবিরা গুনাহগুলোর মধ্যে থেকে অন্যতম এবং এটা মহাপাপ। দারিদ্র, দুর্ঘটনা, হতাশা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যা কোন সমাধান হতে পারে না। ইসলাম একে কোনভাবেই সমর্থন করে না।
[caption id="" align="alignnone" width="323"] ব্যক্তিগত, পেশাগত এবং পারিবারিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম পরিবর্তনের ভেতর দিয়েও যেতে হয় তারুণ্যকে।[/caption]
হতাশা ও যে সমস্ত অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে মানুষ যায়, এগুলো সাময়িক। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে আল্লাহ ওয়ালা বুজুর্গদের সোহবত, ডাক্তারদের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। হাদিসে যেসব মাসনুন দোয়া বর্ণিত হয়েছে সেগুলো নিয়মিত পাঠ করা উচিত। ধৈর্য, নামাজ আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার কাছে সাহায্য চাওয়া। কোরআন শরীফে বর্ণিত হয়েছে,
واستعينوا بالصبر والصلاه
আত্মহত্যা জাতীয় পাপগুলো মানুষ একাকী থাকলে করা সম্ভব হয়। তাই একাকী না থেকে মানুষের ভিড়ে থাকার চেষ্টা করা, একাকিত্ব ছেড়ে কোলাহলের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করা। কল্যাণমূলক যত কাজ আছে সেগুলোর সাথে সম্পৃক্ত থাকার চেষ্টা করা।
-কেএল