।।মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দিন।।
ইদানিং দেখা যাচ্ছে ফেসবুক ইউটিউব প্রভৃতি সোশ্যাল মিডিয়াতে আলেম সমাজের খুব বেশি সমালোচনা হচ্ছে। যাদের সমালোচনা করার মত যোগ্যতা ও নৈতিকতা নেই তারাও সমালোচনা করছে, যা অনাকাঙ্খিত, অবৈধ।
আলেমণমগণ সমালোচনার ঊদ্ধে তা বলছি না। আলেমদের কোনো দোষ-ত্রুটি নেই তা বলছি না। আলেমরা ফেরেশতা নন, তারা রক্ত মাংসের মানুষ। তাদের কিছু দোষ-ত্রুটি ভুল-বিচ্যুতি থাকতেই পারে। তার সমালোচনাও হতে পারে। কিন্তু যে কেউ চাইলেই তাদের সমালোচনায় লিপ্ত হতে পারে না। সমালোচনার জন্য কিছু যোগ্যতা ও শর্ত রয়েছে। সমালোচকদের মধ্যে সমালোচনা করার নৈতিকতাও থাকা চাই।
যিনি কোন বিষয়ে কোন আলেমের সমালোচনা করবেন তার মধ্যে ঐই সমালোচনা-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান থাকতে হবে এবং তার মধ্যে যে আলেমের সমালোচনা করবেন সেই আলেমের চেয়ে বেশি বা ন্যুনতম তার সম পর্যায়ের একাডেমিক জ্ঞান থাকতে হবে। চুনোপুঁটি নির্বিশেষে যার মনে চায় সমালোচনায় অবতীর্ণ হতে পারবে না।
এটাই যুক্তির কথা, এটাই নীতির কথা, এটাই শরীয়তের কথা। কেননা সমালোচনা হচ্ছে কোন একটা কিছুর পিছে পড়া (দোষের পিছে পড়া)। আর কুরআন কারীমে বলা হয়েছে, ولا تقف ما ليس لك به علم অর্থাৎ, যে বিষয়ে তোমার যথাযথ জ্ঞান নেই তার পিছে পড় না। (সূরা বনী ইসরাঈল: ৩৬) এ আয়াত দ্বারাই প্রমাণিত হয় সমালোচনাকারির মধ্যে যে বিষয় নিয়ে তিনি সমালোচনামূলক কিছু বলবেন সে বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান থাকতে হবে।
আর ব্যক্তির সমালোচনা করতে গেলে যেহেতু সেই ব্যক্তি তার জ্ঞানের যে স্তর থেকে কিছু বলবেন বা করবেন সে সম্বন্ধে যথাযথ জ্ঞান থাকা অপরিহার্য, তাই অনিবার্য কারণেই বলতে হবে কোন ব্যক্তির সমালোচনা করতে হলে তার চেয়ে বেশি বা ন্যুনতম তার সমপর্যায়ের একাডেমিক যোগ্যতা থাকতে হবে। কেউ এ পর্যায়ে উন্নীত না হলে তার জন্য সমালোচনা-কর্মে অবতীর্ণ হওয়ার বৈধতা নেই।
সমালোচনার বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান থাকা জরুরি- এ ব্যাপারে হজরত আয়েশা রা, থেকে একটি স্পষ্ট উক্তি রয়েছে। জানাযা সংক্রান্ত একটি বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ما اسرع الناس الى ان يعيبوا ما لا علم لهم به. অর্থাৎ, যে ব্যাপারে লোকদের জ্ঞান নেই সে ব্যাপারে তারা সমালোচনা করতে ত্বরা করল কেন? (মুসলিম: হাদীছ নং ২২২৬/১০০)
যারা আলেমদের সমালোচনা করতে উদ্যত হন তারা যেন নিজেদের জ্ঞানের পরিমাণ কতটুকু তা-ও একটু তলিয়ে দেখেন। একজন তালিবে ইলম -ফারেগ হওযার পূর্বে যার ইলমের যাত্রাও ভালভাবে শুরু হয় না- সে কীকরে একজন বিজ্ঞ আলেমের সমালোচনায় অবতীর্ণ হতে পারে? একজন সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ -যিনি আদৌ কুরআন হাদীছের সাথে একাডেমিক সম্পর্ক রাখেন না- তিনি কীকরে বিজ্ঞ আলেমদের সমালোচনায় অবতীর্ণ হতে পারেন? যিনি যে শাস্ত্রে বিজ্ঞ নন তিনি সে শাস্ত্রের কোন বিষয় নিয়ে সমালোচনায় লিপ্ত হতে পারেন না।
এটা সর্বজন স্বীকৃত নীতিকথা। কোন শাস্ত্রে অনভিজ্ঞ লোক যখন সেই শাস্ত্র নিয়ে পন্ডিতী ফলাতে আসে তখন সেই শাস্ত্রের বিজ্ঞ লোকদের কাছে তা কীভাবে কতটা হাস্যকর হয়ে ওঠে সেটা আঁচ করার মত যোগ্যতাও ঐই অনভিজ্ঞদের থাকে না।
সারকথা হল- আপনি যদি কোন আলেমের চেয়ে বড় বা ন্যুনতম তার সম পর্যায়ের একাডেমিক জ্ঞান সম্পন্ন না হয়ে থাকেন কিংবা আপনি যদি আদৌ আলেমই না হন তাহলে আপনি তার সমালোচনা থেকে বিরত থাকুন, বিষয়টা যোগ্য আলেমদের উপর ছেড়ে দিন।
এতক্ষণ গেল আলেমদের সমালোচনা কারা করতে পারবে সে সম্বন্ধে কিছু কথা। এবার সমালোচনা কীভাবে করা হবে এবং কাদের সামনে করা হবে সে প্রসঙ্গ। আলেমদের কোন মতাদর্শ বা চিন্তাধারার কিংবা তাদের কোন ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের সমালোচনা হতে হবে ইলমী ও একাডেমিক ভাষায়, কুরআন হাদীছের দলীল-আদিল্লাহ ভিত্তিক। কেননা তাদের ভিন্ন মতাদর্শ বা চিন্তা-চেতনা কিংবা ধর্মীয় কর্মকাণ্ড -যা নিয়ে সমালোচনা হবে- কুরআন হাদীছের দলীল-আদিল্লাহ ভিত্তিকই হয়ে থাকবে।
অতএব ইলমী ও একাডেমিক ভাষা যারা বোঝে, কুরআন ও হাদীছের দলীল-আদিল্লাহ ভিত্তিক আলোচনা বোঝার যোগ্যতা যাদের রয়েছে, কেবল তাদের সামনেই আলেমদের সমালোচনা করা যেতে পারে। সাধারণত সমালোচনামূলক গ্রন্থ বিজ্ঞজনরাই পাঠ করে থাকেন, তাই কোন আলেমের সমালোচনার একান্ত প্রয়োজন দেখা দিলে কোন সমালোচনামূলক গ্রন্থে তা করা যেতে পারে। কিংবা সরাসরি আলেমদের সাথে আলোচনা-মজলিসে তা করা যেতে পারে।
পাবলিক ফিল্ডে বিজ্ঞ-অজ্ঞ, সমঝদার-নাবুঝ সব ধরনের লোক থাকে বিধায় পাবলিক ফিল্ডে আলেমদের বিরুদ্ধে সমালোচনা চলতে পারে না। কারণ সে ফিল্ডের অনেকেই ইলমী ও একাডেমিক ভাষা এবং কুরআন হাদীছের দলীল-আদিল্লাহ ভিত্তিক আলোচনা বোঝার মত যোগ্যতা রাখে না। ইলমী ও একাডেমিক ভাষা এবং কুরআন হাদীছের দলীল-আদিল্লাহ ভিত্তিক আলোচনা বোঝার মত ধারণ ক্ষমতা তাদের নেই।
এমতাবস্থায় তাদের সামনে এরূপ আলোচনা তাদের জন্য ফিতনা তথা ভুল বোঝাবুঝি ও বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে। ইসলামের বিধানমতে কোন লোকের সামনেই দ্বীনের এমন কথা পেশ করা ঠিক নয় যা তার ধারণ-ক্ষমতার বাইরে। করলে সেটা তার জন্য ফিতনার কারণ হতে পারে।
এজন্যই হযরত ইবনে মাসঊদ রা. বলেছেন,
ما انت بمحدث قوما حديثا لا تبلغه عقولهم إلا كان لبعضهم فتنة. অর্থাৎ, তুমি লোকদের কাছে এমন হাদীছ বয়ান করবে না যা তাদের ধারণ ক্ষমতার বাইরে। করলে সেটা তাদের কারও কারও জন্য ফিতনার কারণ হবে। (মুকাদ্দামায়ে মুসলিম)
অতএব ফেসবুক ইউটিউব প্রভৃতি সোশ্যাল মিডিয়াতে যেহেতু প্রচুর সংখ্যক এমন সাধারণ মানুষের উপস্থিতি রয়েছে, যারা ইলমী ও একাডেমিক ভাষা বোঝে না, যারা শাস্ত্রীয় কথাবার্তা ও দলীল-আদিল্লাহ ভিত্তিক আলোচনা বোঝার মত যোগ্যতা ও ধারণ-ক্ষমতা রাখে না, তাই এসব সোশ্যাল মিডিয়ায় আলেমদের মতাদর্শ বা চিন্তা-চেতনা কিংবা তাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের সমালোচনা চলতে পারে না। কেউ করলে তার ওপর ধর্মীয় ফিতনা সৃষ্টির দায় বর্তাবে।
রয়ে গেল যদি আলেমদের এমন কোন দোষের বিষয় হয় যা তাদের ব্যক্তিগত, যার সাথে ধর্মীয় মতাদর্শ বা চিন্তাধারার কোন সম্পর্ক নেই, অতএব তার সাথে কুরআন হাদীছের দলীল-আদিল্লাহরও কোন সম্পর্ক নেই, তেমন বিষয়গুলো নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা করা যাবে কি না? এর জবাব হল- তাহলে সেটা হবে কোন আলেমের নিতান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। আর কারও নিতান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে অন্যের নাক গলানো অনুচিত। তদুপরি একান্তই ব্যক্তিগত দোষের বিষয় -যার সাথে কোন ইসলামী মতাদর্শ বা ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের সম্পর্ক নেই, কুরআন হাদীছের কোন সম্পর্ক নেই, তেমন বিষয়- নিয়ে আলোচনার দ্বীনী কোন প্রয়োজনও নেই। এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা হারাম গীবতের অন্তর্ভুক্ত বিধায় তা নিষিদ্ধ, তা সোশ্যাল মিডিয়ায় কেন যেকোনো অঙ্গনে হোক নিষিদ্ধ।
আল্লাহ্ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন! [লেখকের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া]
-কেএল