আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইমারাতে শারইয়্যাহ হিন্দের পঞ্চম আমিরুল হিন্দ নির্বাচিত হয়েছেন দারুল উলুম দেওবন্দের সদরুল মুদাররিসিন মাওলানা সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানী। শনিবার (৩ জুলাই) নয়াদিল্লির জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের কেন্দ্রীয় অফিসে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ভারতের শীর্ষ আলেমদের উপস্থিতিতে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের (একাংশ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাওলানা সাইয়্যিদ মাহমুদ মাদানী নতুন আমিরুল হিন্দ হিসেবে সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানীর নাম প্রস্তাব করেন। তার প্রস্তাবে উপস্থিত সদস্যরা একমত হওয়ায় দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মুফতি আবুল কাসেম নোমানী এ ঘোষণা দেন। পাশাপাশি সাইয়্যেদ মুহাম্মদ সালমান মানসুরপরীকে নায়েবে আমিরুল মু’মিনীন নির্বাচিত করা হয়।
আল্লামা আরশাদ মাদানীর সংক্ষিপ্ত জীবনী
সাইয়্যিদ আরশাদ মাদানি (জন্ম ১৯৪১) জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের প্রেসিডেন্ট। তার পিতার নাম হুসাইন আহমদ মাদানি। ২০০৬ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি বড় ভাই আসআদ মাদানির পর তিনি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।
শিক্ষাজীবন
মাত্র ৮ বছর বয়সে কুরআন হেফজ করেছিলেন মাওলানা সাইয়্যিদ আরশাদ মাদানি। তারপর দারুল উলুম দেওবন্দের নিয়ম অনুযায়ী তিনি পাঁচ বছর ফার্সি ভাষার ওপর পড়াশোনা করেন। এরপর ১৯৫৫ সালে তিনি আরবী পড়া শুরু করেন এবং ১৯৫৯ সালে দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। ১৯৬৩ সালে তিনি দাওরায়ে হাদিস শেষ করেন।
শিক্ষকমণ্ডলী
তার শিক্ষকগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন ক্বারী আসগার আলী, মাওলানা সৈয়দ ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী, মাওলানা ইজাজ আলী, আল্লামা মোহাম্মাদ ইব্রাহিম বলিয়াভী, মাওলানা জলীল আহমেদ কিরানভি, মাওলানা আখতার হুসাইন দেওবন্দি এবং মাওলানা ওয়াহেদুজ্জামান কিরানভি প্রমুখ। এছাড়া তিনি সৌদি আরবের মদীনায় থাকাকালীন অনেক আরব বিদ্বানদের কাছে জ্ঞানচর্চা করেন।
কর্মজীবন
আল্লামা আরশাদ মাদানি কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৬৫ সালে বিহার প্রদেশের প্রসিদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া কাসিমিয়া গয়ায় শিক্ষক হিসাবে যোগদানের মাধ্যমে। ১৯৬৯ সালে দারুল উলূম দেওবন্দের শাইখুল হাদীস এবং তৎকালীন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি সায়্যিদ ফখরুদ্দীনের হুকুমে জামিয়া কাসিমিয়া মাদরাসা শাহী মুরাদাবাদে মুদাররিস পদে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে মাওলানা ফখরুদ্দীন তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পরিচালনার দক্ষতা দেখে শিক্ষা কমিটির কনভেনার এবং ১৯৭২ সালে সহকারী শিক্ষা সচিব হিসাবে নিয়োগ দেন। তখন মাওলানা ফখরুদ্দীন নিজেই শিক্ষা সচিব ছিলেন। ১৯৮২ সালে দারুল উলূম দেওবন্দের মজলিসে শুরার আহবানে তিনি মুহাদ্দিস পদে যোগদান করেন। ১৯৯৬-২০০৮ সাল পর্যন্ত দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষা সচিব ছিলেন। তিনি তার দায়িত্ব পালনকালে হিফয বিভাগ, ক্বিরায়াত বিভাগও প্রথমিক আরবী বিভাগসমূহ অতুলনীয়ভাবে সফলতা লাভ করে। বর্তমানে তিরমিযি শরিফ অধ্যাপনায় নিয়োজিত আছেন। ২০১২ সালে রাবেতায়ে আলম আল ইসলামি এর সদস্য পদ লাভ করেন।
আধ্যাত্মিকতা
শিক্ষা জীবন শেষ করার পরপরই তিনি আধ্যাত্মিক সাধনা শুরু করেন। তার বড় ভাই আসআদ মাদানি র নিকট বাইআত হন। যেহেতু তার পিতা হুসাইন আহমদ মাদানির কাছ থেকে শৈশবে আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করেছেন, তাই অতি অল্প সময়ে তিনি স্বীয় লক্ষ্য অর্জন করেন। তিনি দীর্ঘ ১৪ মাস সৌদি আরবের মদীনায় অবস্থান করে ইসলামী জ্ঞান লাভ করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার মুরিদ তথা আধ্যাত্মিক শিষ্য রয়েছে।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
তিনি ভারতের বিভেদনীতির একজন কড়া সমালোচক ছিলেন। তিনি বলেন, এই বিভেদনীতির জন্য ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়েছে। তিনি বলেন, নরেন্দ্র মোদী ভারতের সব মুসলিমের কাছে গ্রহণযোগ্য না। সূত্র: উইকিপিয়া
উল্লেখ্য, ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই ভারতীয় মুসলমানদের ধর্মীয় বিষয়াদির সমাধান ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার লক্ষ্যে একজন আমিরুল হিন্দ নির্বাচন করার প্রয়োজন অনুভব করে।
সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে রেশমী রুমাল আন্দোলনের মহানায়ক শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী (১৮৫১-১৯২০) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু তখন পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকায় এই সিদ্ধান্ত গৃহীত না হলেও প্রাদেশিক পর্যায়ে বিহার রাজ্যে এর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি গোটা ভারতবর্ষের জন্য একজন আমিরুল হিন্দ নির্বাচন করার চেষ্টা অব্যাহত থাকে ।
সে ধারাবাহিকতায় ১৯৮৬ সালের নভেম্বরে পুরো ভারতবর্ষে ইমারাতে শারইয়্যাহ হিন্দের কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দিল্লিতে একটি বৃহত্তর প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে সর্বপ্রথম আমিরুল হিন্দ হিসেবে মাওলানা হাবিবুর রহমান আজমী (১৯০১-১৯৯২) নির্বাচিত হন।
১৯৯২ সালে মাওলানা হাবিবুর রহমান আজমীর ইন্তেকালের পর দ্বিতীয় আমিরুল হিন্দ হিসেবে নির্বাচিত হন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের তৎকালীন সভাপতি মাওলানা সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী (১৯২৮-২০০৬)।
তার ইন্তেকালের পর ২০০৬ সালে তৃতীয় আমিরুল হিন্দ হিসেবে নির্বাচিত হন দারুল উলুম দেওবন্দের দীর্ঘ ২৮ বছরের সফল মুহতামিম মাওলানা মারগুবুর রহমান বিজনুরী।
২০১১ সালে তার ইন্তেকালের পর চতুর্থ আমিরুল হিন্দ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন মাওলানা ক্বারী উসমান মানসুরপুরী।
গত মে মাসে তার মৃত্যুর পর আজকের অনুষ্ঠিত প্রতিনিধি সম্মেলনে পঞ্চম আমিরুল হিন্দ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন মাওলানা সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানী। আর তার সহযোগী হিসেবে কাজ করবেন মুফতি সালমান মানসূরপুরী।
প্রসঙ্গত, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ভারতীয় মুসলমানদের সর্ববৃহৎ পুরোনো প্লাটফর্ম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে এ সংগঠনটির জন্ম। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এ দলটির ব্যাপক অবদান রয়েছে।
তথ্যসহায়তা: জমিয়তের উলামায়ে হিন্দের মিডিয়া সেল ও মুফতি আশরাফ আলম কাসেমী নদবী