আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: আমাদের মাদরাসাগুলোতে একটি নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে আলহামদু লিল্লাহ! নতুনের শুরু আমাদের মনে নিয়ে আসে নতুন আগ্রহ, নতুন উদ্দীপনা। এ উদ্দীপনাও আল্লাহ তাআলার নিআমত। আমাদের কর্তব্য, তা কাজে লাগানোর চেষ্টা করা।
বর্তমান সময়টা যদিও নানা প্রতিকূলতায় ঘেরা, নতুন নতুন বাধা-বিপত্তিতে আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের জ্ঞান-চর্চাকেন্দ্রিক কর্মতৎপরতা, তবুও নতুনের আগমন আমাদের মনে নব উদ্দীপনা এনেই দেয়। নানা রকমের শঙ্কা, প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তির মধ্যেও এই উদ্দীপনাকে সজীব রেখে আমাদের জীবন-বৃক্ষ ফুলে-ফলে সুশোভিত করে তুলতেই হবে। আর সেজন্য দরকার দিনরাতের ঘাম ঝরানো পরিশ্রম আর আল্লাহ তাআলার রহমতের বারি বর্ষণের প্রার্থনা। এই দুই শর্ত পূরণ হলে আশা করা যায় আমাদের জীবনভূমি সুজলা সুফলা হয়ে উঠবে।
ইলমের পথে সফলতা অর্জন করতে হলে অবশ্যই সময়কে কাজে লাগাতে হবে। সময় আমাদের মহামূল্যবান সম্পদ। মহান আল্লাহর অন্যতম প্রধান নিআমত। আমাদের প্রজ্ঞাবান পূর্বসূরিরা যেসকল বিষয়কে জীবনের সমার্থক হিসেবে উল্লেখ করেছেন তার একটি হচ্ছে সময়। ইমাম হাসান বসরী রাহ.-এর তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি:
‘হে আদমের বেটা! তুমি কয়েকটি দিনের সমষ্টি ছাড়া আর কিছু নও। একটি দিন যখন অতীত হয় তখন আসলে তোমার জীবনেরই একটি অংশ অতীত হয়।’
আমাদের চিন্তা করতে হবে, জীবনের এক একটি অংশের বিনিময়ে কী আমরা অর্জন করছি! যা কিছু অর্জন করছি তা যদি জীবনের চেয়েও দামী না হয় তাহলে কি এই বাণিজ্য লোকসানের বাণিজ্য নয়? কাজেই নতুন বছরে আমাদের অন্যতম প্রধান সংকল্প হতে পারে, সময় নষ্ট না করা।
আমাদের চারপাশে এখন সময় নষ্ট করার অসংখ্য উপকরণ। এইসকল অনুষঙ্গ ও উপকরণের অনিষ্ট থেকে আত্মরক্ষার জন্য আমাদের অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে ইস্পাতকঠিন প্রতিজ্ঞা ।
ইলম-অন্বেষীর জন্যে এই প্রতিজ্ঞা আরো বেশি জরুরি। কারণ জগতের প্রত্যেক কাম্য বস্তুর ক্ষেত্রে যদি থাকে একটি করে বাধা তাহলে আসমানী ইলমের পথে সে বাধা আছে অন্তত তিনটি করে। কাজেই ইলমে দ্বীনের অন্বেষীকে মানযিলে মাকসুদে পৌঁছার জন্য অনেক বেশি সতর্কতা ও সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে।
সচেতনতার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা। আমাদের চেষ্টা-প্রচেষ্টার লক্ষ্য আমাদের কাছে পরিষ্কার থাকতে হবে। অন্যথায় পরিশ্রমের লক্ষ্যচ্যুতি ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। লক্ষ্যও বিভিন্ন পর্যায়ের হয়ে থাকে। এক হচ্ছে চূড়ান্ত লক্ষ্য, আরেক হচ্ছে সেই চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার বিভিন্ন ধাপ। এই ধাপগুলোও একেকটি লক্ষ্য। আমরা জানি, দ্বীনের আদর্শ ধারক-বাহক হওয়ার জন্য অনেক গুণ ও যোগ্যতা অর্জনের প্রয়োজন। প্রতিটি যোগ্যতা একেকটি ধাপ, তালিবে ইলমের চেষ্টা-প্রচেষ্টার একেকটি মানযিল। যিনি যে কয়টি ধাপ অতিক্রম করতে পারবেন তিনি সেই অনুপাতে উপরে উঠবেন। কাজেই আমাদের কর্তব্য হবে, জ্ঞান-প্রজ্ঞা, যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, চারিত্রিক গুণাবলি ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে ইলমে নববীর ওয়ারিছ ব্যক্তিত্বের যেসকল বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা এবং তা অর্জনে সচেষ্ট হওয়া।
আমাদের দরদী ও প্রজ্ঞাবান পূর্বসূরিগণ এসকল বৈশিষ্ট্য পরিষ্কার ভাষায় আলোচনা করেছেন। আত্ম-নিমার্ণের পিপাসা নিয়ে তাদের ঐসকল আলোচনা পাঠ করা হলে আশা করা যায় আমরা আমাদের ‘ছুরাগে যিন্দেগী’ পেয়ে যাব। উদূর্ ভাষার এক কবির কী অমর পংক্তি:
اپنے من میں ڈوب کر پا جا سراغ زندگی
تو اگر میرا نہیں بنتا ہے نہ بن اپنا تو بن
সচেতনতার দ্বিতীয় দিক হল, লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক পন্থা অবলম্বন করা। সঠিক উপায়ে পরিশ্রম করতে পারলেই আল্লাহর ইচ্ছায় লক্ষ্যে উপনীত হওয়া সম্ভব। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এক্ষেত্রেও তালিবে ইলমের নিজ সচেতনতা যেমন জরুরি তেমনি জরুরি প্রজ্ঞাবান কল্যাণকামী পূর্বসূরিদের প্রতি আস্থা রাখা। ইলমের পথে যারা অগ্রজ, অগ্রগামী, তাদের সুপরামর্শ গ্রহণ, তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা থেকে সামনের পথ সম্পর্কে অবগতি অর্জন অতি প্রয়োজন। এতে আমাদের ইলমের সফর সহজ ও নির্বিঘ্ন হবে আশা করা যায়।
এক্ষেত্রে তালিবে ইলমকে তার শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে নির্ধারিত পাঠ্যসূচি ও কর্মসূচি নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করতে হবে। প্রতি শিক্ষাবর্ষের অধ্যয়ন ও দক্ষতার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আত্মনিয়োগ করতে হবে। একই সাথে ইলম অর্জনের সকল নীতি, যা আমাদের প্রজ্ঞাবান মনীষীগণ আলোচনা করেছেন তা সির্ঠকভাবে উপলব্ধি করে নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করে যেতে হবে। তন্মধ্যে একটি নীতি, যার শব্দ সরাসরি হাদীস শরীফ থেকে গৃহীত তা এই:
كُلّ امْرِئٍ حَسِيبُ نَفْسِهِ
প্রত্যেকে তার নিজের তত্ত্বাবধায়ক। প্রত্যেককে তার নিজের হিসাব রাখতে হবে। সময়ের হিসাব, কাজের হিসাব, কাজের পরিমাণ ও গুণগত মানের হিসাব, নিয়ত ও প্রেরণার হিসাবÑ এই সবগুলোর হিসাব আমাদের নিজেদেরকেই রাখতে হবে। নতুবা জ্ঞান চর্চার পরিবেশ ও কাঠামো এবং বাহ্যত জ্ঞানানুশীলনের ব্যস্ততার মধ্যেও ঘটতে পারে ঘুণপোকা লেগে যাওয়ার মতো ব্যাপার, যা ভিতর থেকে জীবন ও সময়কে খোকলা করে দিতে পারে।
ইলমের পথে যত প্রতিবন্ধক রয়েছে, ইলমে দ্বীনের ধারক-বাহক হিসেবে গড়ে ওঠার পথে যত বাধা-বিপত্তি আছে সেসবকে জয় করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেকে নিজের কাছে জবাবদিহিতার স্তরে রাখা প্রয়োজন। এই নীতি মেনে চলতে পারলে আমাদের বাইরের তত্ত্বাবধান, সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দের উপদেশ ও নির্দেশনা, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-কানুন ইত্যাদি আমাদের ইলমী জীবন গঠনের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত হওয়ার এবং নিজের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে ওঠার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আল কাউসার-এর সৌজন্যে
এনটি