শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


‘আব্বাজান রহ. শত ব্যস্ততার মাঝেও আমাদেরকে আনন্দভ্রমণে নিয়ে যেতেন’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

[জামিয়া দারুল উলুম করাচির মুখপাত্র ‘ماہنامہ البلاغ মাহনামা আল-বালাগ’ এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বিশ্বনন্দিত আলেম, স্কলার আল্লামা তাকি উসমানির আত্মজীবনী আওয়ার ইসলামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ।

এ বিষয়ে আল্লামা তাকি উসমানি আনুষ্ঠানকিভাবে আওয়ার ইসলামকে ভাষান্তর করে প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন। গত ২ জানুয়ারি জামিয়া দারুল উলুম করাচির তাখাসসুস ফিল ইফতার শিক্ষার্থী, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের শুভাকাঙ্ক্ষি উমর ফারুক ইবরাহীমীর মাধ্যমে আল্লামা তাকি উসমানি ও পত্রিকা কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মজীবনী ‘ইয়াদে’ অনুবাদের অনুমতি চাওয়া হলে তারা খুশি মনে রাজি হন এবং আওয়ার ইসলামকে ধন্যবাদ জানান বাংলাভাষায় ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য।

আল্লামা তাকি উসমানির নতুন ধারাবাহিক আত্মজীবনী “یادیں ইয়াদেঁ ” মাহনামা আল-বালাগে সফর ১৪৩৯ হিজরি, নভেম্বর ২০১৭ ইংরেজি মাস থেকে। আওয়ার ইসলামে লেখাটি প্রতি রোববার ও বুধবার প্রকাশ হবে ইনশাল্লাহ। আজ ছাপা হলো ২৬ তম কিস্তি। অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ উমর ফারুক ইবরাহীমী।]


পূর্ব প্রকাশের পর: পাহাড়সম ব্যস্ততার মাঝেও আব্বাজান আমাদের মনোতুষ্টির জন্য কখনো আমাদেরকে আনন্দভ্রমণে নিয়ে যেতেন। সেসময় করাচিতে আনন্দভ্রমণের জন্য সবচে চিত্তাকর্ষক ও দর্শনীয় স্থান ছিলো ক্লিফটন সমুদ্রসৈকত।

সেটাকে তখন "হাওয়া বন্দর" বলা হতো। সে জায়গাটা শহর থেকে বেশ দূরে হওয়ায় সেখানে গাড়িঘোড়াও তেমন যেতোনা। তাই দিনের বেলায়ও বিরাজ করতো সুনসান নীরবতা। আব্বাজান ঠিক সে সময়েই ঘরের সবাইকে সেখানে নিয়ে যেতেন।

আজ সেখানে বিশালায়তনের পার্ক বানিয়ে রাখা হয়েছে। সে সময়ে ঠিক এখানেই সমুদ্রের তীর ছিলো। আর সেই পুরোনো পুল যেটি এখন পূর্বপ্রান্ত থেকে পশ্চিমপ্রান্তে গিয়ে মিশেছে, সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ সেই পুলের অগ্রভাগে এসে আছড়ে পড়তো। এখানেই আমরা সমুদ্রের ঢেউয়ের তানে তানে সাধ্যমতো গোসল করতাম।

ঘর থেকে সঙ্গে করে দুপুরের খাবার নিয়ে যেতাম। সবাই মিলেমিশে খেয়েদেয়ে সন্ধ্যে নাগাদ ঘরে ফিরে আসতাম। এমনিভাবে আব্বাজান রহ. কখনো আমাদেরকে নিয়ে নৌভ্রমণে বেরোতেন।

সমুদ্রের কোলঘেষে পাল উড়িয়ে ছুটে চলা নৌকাগুলো "মানোড়া" গিয়ে ঘাঁট বাঁধতো। দিনভর সেই আনন্দভ্রমণ আমাদের ছোটদের জন্যে কতইনা আনন্দঘন ছিলো!

একদিকে তিনি উপরোল্লিখিত নানাবিধ সমস্যাপীড়িত থাকা সত্বেও আমাদের মনোতুষ্টির জন্যে এধরনের আনন্দভ্রমণে নিয়ে যেতেন। এবং আনন্দভ্রমণের ফাঁকে ফাঁকে তিনি বুযুর্গদের ঘটনাবলী এবং মূল্যবান নসিহত শুনিয়ে শুনিয়ে আমাদেরকেও তাদের মতো আদর্শবান হবার প্রেরণা যোগাতেন।

অন্যদিকে আল্লাহ তা'আলা হযরত আব্বাজানকে অভাবনীয় ইলমি একাগ্রতা দান করেছিলেন। ফলে কোন অবস্থাতেই তিনি এই ব্যস্ততাকে ছেড়ে দেননি।

যদিও দীর্ঘকাল থেকে তিনি দারুল উলূম দেওবন্দের মুফতিয়ে আ'যম পদবী থেকে অবসরপ্রাপ্ত ছিলেন তথাপি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফিকহি প্রশ্নাবলী আসতেই থাকতো।

সে অবস্থায়ও তিনি এসব প্রশ্নের জবাব লিখতে থাকতেন। দেওবন্দ থেকে যদিও তিনি বেশি সামানাপত্র সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারেননি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি, হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি এবং বুযুর্গদের চিঠিপত্র ও বরকতপূর্ণ হাদিয়া ভাণ্ডার অত্যন্ত যত্নের সাথে সংঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন।

তিনি বলতেন-কাস্টমসের তল্লাশির সময় এসব কাগজপত্র নিয়ে আমার সবচে বেশি চিন্তা হচ্ছিলো। অথচ কাস্টমস কর্মীদের এদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই ছিলোনা।

তাদের ধান্দা তো শুধু এটাই ছিলো, কেউ যেনো স্বর্ণ, রুপা এবং সেলাইবিহীন কাপড় নিয়ে যেতে না পারে। এভাবে আব্বাজানের ইলমের একটি বিশাল ভাণ্ডার সঙ্গে এসেছে। এমনকি হযরত শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাব্বির আহমাদ উসমানি সাহেব রহ. ও নিজের সাথে এতো কিতাবপত্র আনতে পারেননি। ফলে তার কখনো কোন মাস'আলা তাহকিকের প্রয়োজন হলে তিনি চারতলা বেয়ে আমাদের ঘরে চলে আসতেন এবং মুতালা'আ করতেন।

ধীরেধীরে আল্লাহ তা'আলার মেহেরবানিতে এসব সমস্যার সমাধান বেরিয়ে আসতে শুরু করলো। হযরত আব্বাজানের কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে করাচিতেই একটি প্রকাশনী প্রতিষ্ঠা করলেন।

সেখানে আব্বাজানও শরীক ছিলেন। অন্যদিকে ভাইজান যিনি দেওবন্দে কুতুবখানা চালাচ্ছিলেন, কিভাবে যেনো তিনিও ওখান থেকে সেটা গুছিয়ে পাকিস্তান চলে এসেছিলেন। আমাদের দাদি সাহেবাকেও তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। দাদির জন্য রেলের লম্বা সফর ছিলো অসহনীয়।

তাই ভাইজান তাকে দিল্লি থেকে বিমানযোগে নিয়ে এসেছিলেন। সেদিন আমাদের ঘরে যেনো আনন্দের বন্যা বইছিলো। আমরা তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে ডার্ক রোডের বিমানবন্দরে ছুটে গিয়েছিলাম। ডার্ক রোডের বিমানবন্দর তখন শহর থেকে যথেষ্ট দূরে মনে হতো। মাঝে একটি বনভূমি আড়াল ছিলো।

সেসময় অওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ নামে কেবল একটিমাত্র এয়ারলাইন্স পাক-ভারত যাতায়াত করতো। বিমান রানওয়ে স্পর্শ করতেই আমার কচিমন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছে। এটাই ছিলো আমার জীবনে প্রথম বিমান দর্শন। আমাদের সবার দৃষ্টি বিমানের ফটকে গিয়ে মিশে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পর ভাইজানকে দরজায় দেখা গেলো।

তিনি মুচকি হেসে, হাত নাড়িয়ে ফের ভেতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফের তিনি আমাদের দাদি সাহেবাকে বাহুডোরে বহনকরে এগিয়ে আসলেন। এভাবেই আব্বাজানের একটি বড় পেরেশানীর ইতি ঘটলো।

ভাইজান সাধ্যমতো নিজের সাথে করে কিতাবাদি নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু অবশিষ্ট বিশাল ভাণ্ডার জাহাজ ছাড়া আনা সম্ভব ছিলোনা। আল্লাহ তা'আলা এর জন্য একটি সমাধান বের করে দিলেন। মাওলানা নূর আহমাদ সাহেব রহ. নামে আব্বাজানের একজন প্রিয়ো শিষ্য ছিলেন। তিনি ছিলেন বার্মার আকিয়াব জেলার অধিবাসী।

শিক্ষাদীক্ষার মানসে দারুল উলূম দেওবন্দে এসেছিলেন। সেভাবেই আব্বাজানের সাথে তার গভীর সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো। আব্বাজান পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার ফলে দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে ইস্তফা নিয়ে নিয়েছিলেন। কারণ,দারুল উলূম দেওবন্দে থাকাকালীন কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অনুমতি ছিলোনা। এবং এই ইস্তফাপত্র তিনি নিজ শায়েখ হযরত হাকিমুল উম্মত থানবী রহ. এর ইশারায় জমা দিয়েছিলেন।

হযরত মাওলানা নূর আহমাদ সাহেব রহ. এর আব্বাজানের সাথে চমৎকার সম্পর্কের ফলে তিনি দরসের বাইরেও আব্বাজানের কাছে কিছু কিতাবাদি পড়েছেন। তিনি বেশিরভাগ সময় তার খেদমত এবং সোহবতেই ব্যয় করতেন। আব্বাজান পাকিস্তান চলে যাবার পর তিনি মানুষিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন।

এবং নিজেও পাকিস্তান হিজরত করতে উদগ্রীব ছিলেন। আল্লাহ তা'আলা তাকে পাহাড়সম হিম্মত দান করেছিলেন। দুঃসাধ্য কাজ তিনি নিমিষেই করে ফেলতে পারতেন। আব্বাজানের অবশিষ্ট কিতাবাদি দেওবন্দ থেকে পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব সানন্দে তিনি নিজ কাঁধে তুলে নিলেন।

সুতরাং এমনটাই হলো। এবং তাঁর হাত ধরেই এই বিশাল কুতুবখানা পাকিস্তান পৌছে গেলো। আব্বাজান রহ. তার সাথে স্বীয় ভাগিনা জনাব ফখরে আলম সাহেব রহ. কেও একই জাহাজে ডেকে পাঠিয়েছেন। সুতরাং উভয়ে সামুদ্রিক জাহাজে পাকিস্তান চলে আসলেন। চলবে ইনশাআল্লাহ......

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ