মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ।।
এই যমানায় দ্বীন শেখার জন্য মাদরাসায় আসা বিরাট বড় কুরবানী। এত বড় কোরবানীর পর কোনো তালিবুল ইলমের মাহরূম হওয়ার কথা নয়। যে যমানায় দ্বীনী ইলমের কোনো কদর নেই, না পরিবারে, না সমাজে তখন যদি কোনো একজন মানুষ ইলমের জন্য আগ্রহী হয় এবং তা গ্রহণ করতে চায় তার তো মাহরূম হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
অথচ বাস্তবতা এই যে, ইলমের তলবে এসেও অধিকাংশ মানুষ ইলম থেকে মাহরূম হয়ে যাচ্ছে। কী এর কারণ? কেন সে মাহরূম হচ্ছে? সে দুনিয়াও ছেড়ে দিল, আবার ইলম থেকেও মাহরূম হল। এর চে’ মর্মান্তিক বিষয় আর কী হতে পারে? যে যমানায় সামান্য মেহনতের অনেক আজর দেয়ার ওয়াদা করা হয়েছে, তখন মানুষ কেন ইলম থেকে মাহরূম হয় তা চিন্তা করা দরকার।
আমাদের পূর্ববর্তীগণ এর কারণগুলো সাফ সাফ বলে গিয়েছেন। এক দল তো মাহরূম হচ্ছে এই কারণে যে, তারা ইলম তলবই করেনি। তারা ইলম থেকে এমন মাহরূম হয়েছে যে, পঞ্চাশ বছর বয়সের মানুষ এমন মাসআলা জিজ্ঞাসা করে, যা আমাদের মাদরাসার ছোট একজন তালিবুল ইলম শুনলেও হেসে দেবে। অথচ সেটিই তার কাছে বিরাট বিষয়। কারণ সে যিন্দেগীতে দ্বীনের একটি মাসআলাও শিখেনি। কিন’ এই অল্প ক’জন মানুষ, যাদের ইলম তলব করার সুযোগ হয়েছে তারা কেন মাহরূম হচ্ছে?
এর কারণগুলো জানা দরকার এবং সেগুলো থেকে যথাসম্ভব নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। কিছু কারণ এমন আছে, যেগুলোর উপর তালিবুল ইলমের নিয়ন্ত্রণ নেই। যেমন গিযা (পানাহার) হালাল হওয়া। দ্বীনী ইলম হাসিল হওয়ার জন্য এটি একেবারে অপরিহার্য। অথচ তা তালিবুল ইলমের নিয়ন্ত্রণে নেই। তালিবুল ইলমের ভরণ-পোষণ যারা করে তাদের অনেকেই এ বিষয়ে উদাসীন। ব্যবসা-বাণিজ্য করছে অথচ মাসআলা জানে না এবং জানার চেষ্টাও করে না। কোন কারবার হালাল, কোন কারবার হারাম, অনেকেরই তা জানা নেই। অনেকে তো জেনে শুনেও হারাম পন্থা অবলম্বন করছে। অনেকে বলে যে, এই যমানায় এত বাছ-বিচার করে চলা সম্ভব নয়। তাহলে আর সংসার চালানো যাবে না।
তবে আলহামদুলিল্লাহ, অনেক মানুষ এমনও আছে, যারা হালাল হারাম বেছে চলার জন্য আমাদের চেয়েও বেশি ফিকির করছে। তো কোনো অভিভাবক যদি হারাম পথে উপার্জিত অর্থ তালিবুল ইলমের পিছনে ব্যয় করে আর তালিবুল ইলম তা ভোগ করে এবং তা দিয়ে তার শরীরের রক্ত-মাংস তৈরি হয় তাহলে চিরতরে তার ইলমের দরজা বন্ধ। সারা জীবন মাদরাসায় পড়ে থাকলেও তার ইলম হাসিল হবে না। এজন্য তাকে খোঁজখবর নিয়ে জানতে হবে, অভিভাবকের উপার্জন হালাল কি না। হালাল বলে নিশ্চিত হলে সে তা ব্যবহার করবে। আর হারাম হলে এর থেকে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। এর একটি ছুরত হল কোনোরকম জানটা বাঁচে-এ পরিমাণ গ্রহণ করা, এর বেশি গ্রহণ না করা। তারা দিতে চাইলেও তালিবে ইলমের কর্তব্য গ্রহণ না করা।
কিন্তু আমাদের অনেক তালিবুল ইলমের অবস্থা তো এই যে, তার ভাই ও আত্মীয়-স্বজন হারাম উপার্জন করে, ব্যাংকে চাকরি করে, সুদি লেনদেন করে এ কথা জেনেও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যায়, হারাম থেকে বাঁচার কোনো চেষ্টাই করে না। অথচ যারা হারাম উপার্জন করে বলে জানা আছে, তালিবুল ইলম তাদের বাড়িতে যেতে পারে না, তাদের বাড়ি থেকে কিছু খেতে পারে না। নতুবা ইলম থেকে মাহরূম হতে হবে। তবে আপনার উপার্জন হারাম, এই জন্য আপনারটা খাবো না-একথা বলার প্রয়োজন নেই।
প্রথম কাজ নিজে হারাম থেকে বেঁচে থাকা। যেখানে যেখানে হারাম গিযার সামান্য গন্ধ আছে তালিবুল ইলমের উচিত সেখান থেকে দূরে থাকা। তবে এমনভাবে যাতে ফেতনা না হয়। তাদের বিয়ে-শাদীতে না যাওয়া, তাদের হাদিয়া-তোহফার বিষয়ে সাবধান থাকা, ফিরিয়ে দিলে যদি ফেতনা হয় তাহলে রেখে দিবে, কিন্তু নিজেরা খাবে না, অন্তত নিজে খাবে না। গরীবকে দিয়ে দিবে। বাবার উপার্জন হারাম হলে কোনো রকম জান বাঁচে-এ পরিমাণ গ্রহণ করবে। আর ইসতেগফার করে আল্লাহর কাছে দোয়া করবে যে, আল্লাহ! আমার জন্য হালাল গিযার ব্যবস্থা করে দাও। আমার ইলমের পথের এই বাধা দূর করে দাও। আর যা উপায়হীন অবসস্থায় গ্রহণ করছি আমার জন্য তা হালাল করে দাও। বাবার জন্য দোয়া করবে যে, আল্লাহ তুমি তাঁকে হারাম উপার্জন থেকে ফিরিয়ে আন এবং হালাল উপার্জনের তাওফীক দাও।
এভাবে ভিতরে যদি তড়প ও অস্থিরতা আসে তাহলে আল্লাহ তাআলা অন্তত তার জন্য ঐ গিযাটা হালাল করে দিবেন। তারপর মা বাবাকে জানানো দরকার যে, সস্তানের ইলমের জন্য পিতামাতার হালাল-হারাম বেছে চলা জরুরি। যে ঘরের উপার্জন হালাল নয় সে ঘরে ইলম আসে না। সন্তানকে মাদরাসায় দিলেও তার যিন্দেগী কামিয়াব হয় না। না দুনিয়াতে, না আখিরাতে। বহু ছেলে এভাবে বরবাদ হচ্ছে। কেউ কারণ খুঁজে দেখার চেষ্টা করছে না। আমার মনে হয়, এর মূল কারণ হল, হারাম গিযা।
থানভী রাহ. বলেছেন মাদরাসায় কোনো তালিবুল ইলমকে দাখেল করার সময় খবর নাও যে, অভিভাবকের উপার্জন হালাল কি না। আমরা তো খবর নেই না, এমনকি এই প্রশ্নটাও করি না যে, আপনি কী চাকরি করেন, আপনার আয় কত? আপনার অন্যান্য উপার্জন কী? আমি একটা ভর্তি ফরম তৈরি করেছিলাম যাতে এই সব প্রশ্ন ছিল। কিন্তু তা চালু করতে পারিনি। আমার সঙ্গীরা বলল, এতে ফেতনা হবে। কিন্তু কী লাভ হয়েছে! যারা মাহরূম হওয়ার তারা তো মাহরূম হচ্ছেই।
অনেক ছেলেকে দেখি, সুন্দর লেখাপড়া করছে, হঠাৎ বলে যে, আমার লেখাপড়া করতে মন চায় না। পালিয়ে যায়। কোনো মারধর করা হয় না। আদর আপ্যায়নের সাথে পড়ানো হয়। পালিয়ে যাওয়ার বাহ্যিক কোনো কারণ নেই। তবুও পালিয়ে যায়। আমরা এর কারণ তলিয়ে দেখি না। এর প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল হারাম গিযা। এই হারাম গিযা থেকে তালিবুল ইলমের বাঁচার উপায় হল একেবারে যতটুকু না নিলে নয়, ততটুকু নেবে। অতিরিক্ত নেবে না। দিতে চাইলেও এই বলে ফিরিয়ে দেবে যে, আমার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এখন ফিরিয়ে দেওয়া তো দূরের কথা, জোর করে আরো বেশি আদায় করার চেষ্টা করে। অথচ এই অতিরিক্ত খরচটা তার ইলম থেকে মাহরূম হওয়ার কারণ। এটা খুব নাযুক এবং স্পর্শকাতর বিষয়, কিন’ না বলে তো উপায় নেই।
অভিভাবকদের মধ্য থেকে যাদের সাথে কথা হয় তাদেরকে বলা দরকার যে, আপনার উপার্জন হালাল করার চেষ্টা করুন। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে আল্লাহর ওয়াস্তে ছেলেকে মাদরাসায় দেবেন না। দিলে ছেলের ইলম শিক্ষা হবে না। দুনিয়াও বরবাদ হবে, আখেরাতও বরবাদ হবে।
কাবা ঘর নির্মাণের সময় কাফের-মুশরিকরা পর্যন্ত হালাল উপার্জন দ্বারা আল্লাহর ঘর নির্মাণ করার চেষ্টা করেছে। তারা ভেবেছিল আল্লাহর ঘর নির্মাণের সময় হারাম মাল ব্যবহার করলে আল্লাহর কাছে রেহাই পাব না। হালাল উপার্জন দ্বারা নির্মাণের চেষ্টা করেছিল বলেই একটি অংশ তারা নির্মাণ করতে পারেনি, ছোট করে নির্মাণ করতে হয়েছে।
এখন মুসলমানদের দেশে সরকারী পয়সা ব্যয় করে স্কুল-কলেজ, ইউনিভার্সিটি তৈরি হচ্ছে। সরকারী পয়সায় হালাল-হারামের কোনো বাছ-বিচার নেই। প্রকাশ্যে হারাম রাজস্ব সরকারী তহবিলে জমা হচ্ছে। সুতরাং ঐ সকল স্থান থেকে যারা লেখাপড়া করে বের হবে তারা কিছু শব্দ ও বাক্য শিখতে পারে, কিন্তু মানুষ হতে পারে না। কাফেরদের দেশে হবে, কিন্তু মুসলমানদের সন্তান হারাম পয়সায় লেখাপড়া করে মানুষ হবে না।
এই জন্য মাদারেসে কাওমিয়্যা সব সময় সরকারী সাহায্য থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখছে। একইভাবে ব্যক্তিগতভাবে যাদের ঘরে হারাম উপার্জন হয় তাদের ঘরে ইলম আসার কথা নয়। হাঁ, ঘরে হারাম উপার্জন হওয়া সত্ত্বেও তালিবুল ইলম যদি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে তাহলে আল্লাহ তাআলা হিফাযত করবেন। বেঁচে থাকার উপায় কী? যতটুকু না খেলে আমি বাঁচতে পারব না, যতটুকু কাপড় না হলে আমার সতর ঢাকবে না, এ পরিমাণ নেওয়া, এর বেশি না নেওয়া। আর হারাম উপার্জনকারী আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে না খাওয়া এবং তাদের হাদিয়া গ্রহণ না করা।
ইলম থেকে মাহরূমীর দ্বিতীয় কারণ হল বাড়িতে আল্লাহর নাফরমানী হওয়া। যে বাড়িতে আল্লাহ তাআলার নাফরমানী হয়, নাচ গান হয়, পর্দা-পুশিদা নেই, মা পর্দা করে না, বোন পর্দা করে না, বাবা পর্দা করে না সে বাড়িতে ইলম আসবে না। এগুলোর উপর যদিও তালিবুল ইলমের নিয়ন্ত্রণ নেই তবুও এগুলো তার ইলম থেকে মাহরূম হওয়ার অনেক বড় কারণ। এটা থেকে সে বাঁচবে কীভাবে? সে নিজে পর্দা করবে।
এই মাদরাসার একজন তালিবুল ইলমকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার ভাবী আছে? সে বলল, আছে। ভাবীর সাথে দেখা দাও? বলল, জ্বী। ভাবীর সাথে পর্দা করা যে জরুরি তা কি জানো? বলল, না। তোমার আব্বা কোথায়? বলল, হজ্বে গেছেন। হজ্ব থেকে আসলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবে। তার পিতা এলে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, সে কি ঘরে ভাবীর সাথে পর্দা করে? তিনি বলেন কি, এক ছাদের নিচে থাকলে পর্দা করা কি সম্ভব? আমি বললাম, আপনি যদি ঘরে পর্দা রক্ষা করতে না পারেন তাহলে আপনার ছেলের ইলম থেকে মাহরূম হওয়ার আশঙ্কা আছে। কোনো গুরুত্ব দিল না। এমনকি ছেলেটাও না।
এরপর বছরখানেকের মধ্যেই লেখাপড়া থেকে তার মন উঠে গেল। সে আর পড়ল না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাড়িতে পর্দা না থাকার কারণে ছেলেটা ইলম থেকে মাহরূম হল। এজন্য তালিবুল ইলমের বাবা-মার উচিত পর্দা করা, তালিবুল ইলম চেষ্টা করে যদি বাড়িতে পর্দা না আনতে পারে তাহলে অন্তত নিজের পর্দাটা রক্ষা করা কর্তব্য। যাদের সাথে পর্দা করা জরুরি সে যদি তাদের সাথে পর্দা করে তাহলে ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তাকে ইলম দান করবেন, তাকে মাহরূম করবেন না। বাড়িতে নাচগানের ব্যবস্থা আছে কিন্তু সে ঐগুলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে মাফ করে দিবেন।
আর এখন তো তালিবুল ইলম-আল্লাহ তাআলা হিফাযত করুন-নিজেই মাদরাসায় নাচগানের ব্যবস্থা করে নেয়। মাদরাসায় যন্ত্র নিয়ে আসে! ইলম থেকে মাহরূম হওয়ার এর চেয়ে ভালো উপায় আর কী হতে পারে? যার মা বাবা বাড়িতে নাচগানের ব্যবস্থা করে ঐ ছেলের ইলম হাসিলের কোনো সম্ভাবনা নেই, তার মাহরূম হওয়া নিশ্চিত। আল্লাহ তাআলা যদি তাঁর দ্বীনকে হিফাযত করতে চান তাহলে ঐ ছেলেকে আলিম বানাবেন না। কোনো না কোনো ভাবে সে ইলম থেকে মাহরূম হয়েই যাবে। আজ হোক কিংবা আগামী কাল।
এখন বাঁচার একমাত্র উপায় হল ঐগুলোকে অন্তর থেকে ঘৃণা করা এবং তাতে শরীক না হওয়া। তাহলে আল্লাহ মেহেরবানী করে তাকে ইলম দিয়ে দিবেন। মোটকথা, প্রতিকূল পরিসি’তিতেও তালিবুল ইলম যদি হারাম গিযা থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে, পর্দার উপর পুরা মযবুতীর সঙ্গে আমল করে এবং নাচগান ইত্যাদি গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকে তাহলে ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তাআলা তাকে ইলম দান করবেন।
এ ধরনের আরো কিছু কারণ আছে, যেগুলোর উপর তালিবুল ইলমের নিয়ন্ত্রণ নেই, কিন্তু সেগুলো থেকে বাঁচার উপায় আল্লাহ তাআলা রেখেছেন। পক্ষান্তরে কিছু কারণ আছে যেগুলোর উপর তালিবুল ইলমের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে, কিন্তু তালিবুল ইলম তা থেকে বেঁচে থাকে না। এটা তো আরও মারাত্মক। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইলমের পথের সকল বাধা থেকে বেঁচে থাকার এবং ইলম হাসিল হওয়ার যাবতীয় আসবাব ইখতিয়ার করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
এনটি