মেহেদী হাসান সাকিফ।।
বর্তমানে আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে ফসলি জমি বন্ধক রাখার এবং শহরে ফ্ল্যাট বন্ধক রাখার বিষয়টি খুবই প্রচলিত। বন্ধক রাখার পরে সাধারণত বন্ধকগ্রহীতা (যিনি টাকা ধার দিয়েছেন) টাকা পাওয়ার আগ পর্যন্ত নিদিষ্ট সময় অবধি চুক্তি অনুযায়ী সেই জমি, ফ্ল্যাট ভোগ করে থাকেন। এরপর চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে যে পরিমাণ টাকা দিয়েছিলেন তার সমস্তটাই ফেরত নিয়ে জমি ফেরত দেন।
অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে ঋণদাতা তার প্রদত্ত ঋণ পরিমাণ অর্থ/সম্পদ ছাড়া ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে বাড়তি কোন সম্পদ বা সুবিধা গ্রহন করা নিষিদ্ধ।
তাই উল্লিখিত পরিস্থিতিতে যত টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে তত টাকা ফেরত নেয়ার পাশপাশি অতিরিক্ত সুবিধা হিসেবে জমি বা ফ্ল্যাট ভোগ করাটা নিশ্চিতভাবেই সুদের অন্তর্ভুক্ত এবং অকাট্যভাবে হারাম। এমনকি বন্ধকদাতা (যিনি জমি/ফ্ল্যাট জমা রেখে ঋণ নিয়েছেন) ভোগের অনুমতি দিলেও ঋণদাতা সেটা ভোগ করতে পারবে না। কারণ বন্ধকি জমি থেকে বন্ধকগ্রহীতা কোনো ধরনের সুবিধা গ্রহন করাটাই ইসলামের দৃষ্টিতে সুদী কারবারের অন্তর্ভুক্ত। (বাদায়েউস সানায়ে)
তাই এক্ষেত্রে সবচেয়ে সুন্দর নিয়ম হচ্ছে বন্ধকদাতা জমি/ফ্ল্যাট এর দলিল বন্ধক দিয়ে টাকা গ্রহণ করবেন সরাসরি জমি/ফ্ল্যাট নয়।
বিশিষ্ট তাবেয়ী আল্লামা ইবনে সিরিন (রহ.) এর সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি বিশিষ্ট সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর কাছে জিজ্ঞেস করল, এক ব্যক্তি আমার কাছে একটি ঘোড়া বন্ধক রেখেছে এবং তা আমি আরোহণের কাজে ব্যবহার করেছি। ইবনে মাসউদ (রা.) বললেন, তুমি আরোহণের মাধ্যমে এর থেকে যে উপকার লাভ করেছ তা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস : ১৫০৭১)
বিখ্যাত তাবেয়ি ইমাম কাজি শুরাইহ (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সুদ কিভাবে পান করা হয়ে থাকে? তিনি বলেন, বন্ধকগ্রহীতা বন্ধকি গাভির দুধ পান করা সুদ পানের অন্তর্ভুক্ত। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস : ১৫০৬৯)
গতানুগতিক বন্ধকী জমি/ফ্ল্যাট হালাল পদ্ধতিতে ভোগ করার উপায়
বন্ধকি জমি থেকে বন্ধকগ্রহীতা উপকৃত হতে চাইলে বন্ধক চুক্তির বাইরে আলাদাভাবে ঋণগ্রহীতার সাথে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা চুক্তিতে আবদ্ধ পারে। অর্থাৎ যত দিন পর্যন্ত ঋণের টাকা শোধ না হয় তার অনুমান করে সেই মেয়াদে (অথবা সে যতদিন ভোগ করতে চায় ততদিনের মেয়াদে) ঋণদাতা জমিটি ইজারা(অথাৎ ভাড়া) পদ্ধতিতে তা ভোগ করবে এবং তার ন্যায্য ভাড়াও মালিককে আদায় করবে।
(তবে ঋণগ্রহীতাকে ইজারা চুক্তিতে আবদ্ধ হতে চাপ প্রয়োগ বা বাধ্য করা যাবেনা) এ ক্ষেত্রে ঋণ ও ইজারাচুক্তি দুটি ভিন্ন ভিন্ন হতে হবে, দুটি চুক্তিকে মিলিয়ে একটি অপরটির ওপর শর্তযুক্ত হতে পারবে না। অর্থাৎ বন্ধক রেখে ঋণ নিতে হলে জমি/ফ্ল্যাটটা ইজারায় দিতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যাবেনা। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ৫/৪৬৫, ইমদাদুল আহকাম ৩/৫১৮)
এবার উল্লিখিত পদ্ধতি অনুসরণের জন্য একটা উদাহরণ পেশ করছি। মনে করুন, একজন ব্যক্তি তার ফ্ল্যাট বন্ধক দিয়ে একলক্ষ টাকা গ্রহণ করলেন। তার সেই ফ্লাটের স্বাভাবিক প্রচলিত ভাড়া আছে প্রতিমাসে দশহাজার টাকা। বন্ধকগ্রহিতা (ঋণদাতা) ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিতে চাইলে বন্ধকদাতার সাথে আলাদাভাবে দশমাসের জন্য ভাড়ার একটি চুক্তি করতে পারেন।
দশমাস শেষ হওয়ার পর ভাড়াবাবদ একলক্ষ টাকা কেটে যাবে এবং দুইজনের চুক্তির সমাপ্তি ঘটবে। এখানে যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয় তা হচ্ছে, ভাড়ার পরিমাণ অবশ্যই বাস্তবসম্মত ও প্রচলিত পরিমাণে হতে হবে। হিলা বাহানাস্বরূপ অস্বাভাবিক কমিয়ে নামমাত্র মূল্যে ইজারা চুক্তি হলে জায়েজ হবে না। কারন এক্ষেত্রে অতিরিক্ত মাত্রায় ভাড়া কমানোটাও ঋণের বিনিময়ে নেয়া অতিরিক্ত সুবিধা বলে বিবেচিত হবে।
লেখক: মেহেদী হাসান সাকিফ লেখক, প্রাবন্ধিক
-এটি