জহির উদ্দিন বাবর।।
গত বছর দেশে করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব শুরুর পর অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কওমি মাদরাসাগুলোও। মাস-তিনেক বন্ধ থাকার পর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বিবেচনায় খুলে দেওয়া হয় কওমি মাদরাসা। দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সুযোগ না পেলেও কওমি মাদরাসা ইতোমধ্যে একটি শিক্ষাবর্ষ সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। তবে রমজানের আগে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের কওমি মাদরাসাগুলোও। দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানোর পাশাপাশি আলাদা প্রজ্ঞাপনে সরকার কওমি মাদরাসা বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছে।
প্রতি বছর রমজানের সপ্তাহখানেক পর কওমি মাদরাসাগুলোর শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়। ছাত্র-শিক্ষকের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে প্রতিটি মাদরাসার আঙিনা। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। সরকারি নির্দেশনা মেনে দেশের কওমি মাদরাসাগুলো ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রেখেছে। ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করে ক্লাস শুরুর জন্য মাদরাসা কর্তৃপক্ষ এখন সরকারের অনুমতির অপেক্ষায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ডেটলাইন ঘোষণা করা হয়েছে ১৩ জুন। তবে শিক্ষামন্ত্রী শর্ত আরোপ করে দিয়েছেন, যদি করোনা সংক্রমণের হার ৫ শতাংশে নেমে আসে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ঝুঁকি নেবেন না বলে মন্ত্রী সাফ জানিয়েছেন। এ হিসেবে ১৩ জুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ ইতোমধ্যে সংক্রমণ হার বেড়ে ১০ শতাংশের উপরে চলে গেছে। এছাড়া দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর অবস্থা করুণ আকার ধারণ করেছে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের কারণে করোনা অসম্ভব দ্রুত ছড়াচ্ছে। এই অবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে খুলবে সেটা কেউ বলতে পারছে না।
গতবার যখন কওমি মাদরাসা খুলে দেওয়া হয় তখনও দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল বলা যাবে না। হজরতুল আল্লাম শাহ আহমদ শফী রহ. সরকারপ্রধানের কাছে মাদরাসাগুলো খুলে দেওয়ার ব্যাপারে বিশেষ আবেদন জানিয়েছিলেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকটা তার একক সিদ্ধান্তে মাদরাসাগুলো খুলে দেওয়ার ব্যাপারে সায় দিয়েছিলেন। কওমি মাদরাসার লাখ লাখ ছাত্র-শিক্ষককে অবশ্যই এরজন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ সেই সময় প্রধানমন্ত্রী একক সিদ্ধান্তে অনুমতি না দিলে কওমি মাদরাসাকেও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাগ্য বরণ করে নিতে হতো। আজ কান পাতলেই কওমি মাদরাসাসংশ্লিষ্টদের মধ্যে যে হাহাকার শোনা যায়, সেটা আরও প্রকট হতো।
গত বছর কওমি মাদরাসা যখন খুলে দেওয়া হয় তখন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এর বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের আশঙ্কা ছিল, কওমি মাদরাসা খুলে দেওয়ার দ্বারা করোনা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তাদের এই আশঙ্কার কোনোকিছু ঘটেনি। প্রায় আট/নয় মাস মাদরাসাগুলো তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়েছে। কোথাও কওমি মাদরাসায় করোনার ব্যাপক সংক্রমণ ঘটেছে এমন একটা খবরও পাওয়া যায়নি। এটা স্বীকার করতেই হবে, কওমি মাদরাসাগুলোতে সার্বক্ষণিক কুরআন-হাদিস ও দীনি ইলমের চর্চা হয়। আল্লাহর বিশেষ রহমত ও অনুগ্রহের কারণে সেই পরিবেশ যাবতীয় বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা পাবে, এটাই স্বাভাবিক।
দুই মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকা কওমি মাদরাসাগুলো গতবারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরে যেতে চায়। এজন্য তারা সরকারপ্রধানের বিশেষ বিবেচনা প্রত্যাশা করছে। কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ অথরিটি আল-হাইয়্যাতুল উলয়া সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। কর্তৃপক্ষ আশা করছে, সরকারপ্রধান গতবারের মতো এবারও বিশেষ নির্দেশনায় কওমি মাদরাসাগুলো খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। কারণ, প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করেন, করোনা মহামারি এটা আল্লাহর একটি গজব। শুধু বাহ্যিক উপকরণ ও প্রস্তুতি দিয়ে এই করোনা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করা। তার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা জানানো। আর সেটার জন্য কওমি মাদরাসার চেয়ে সেরা পরিবেশ কোনোটি হতে পারে না। সে কারণেই কওমি মাদরাসা সংশ্লিষ্ট পঁচিশ লক্ষাধিক ছাত্র-শিক্ষক আশায় বুক বেঁধে আছেন। তারা প্রত্যাশা করেন, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলুক আর না খুলুক প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বিবেচনায় অন্তত কওমি মাদরাসাগুলোর দুয়ার উন্মুক্ত হবে। কুরআন-হাদিসের চর্চায় মুখরিত হয়ে উঠবে সেখানকার পরিবেশ।
শুধু কওমি মাদরাসা নয়, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই পর্যায়ক্রমে খোলার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কারণ প্রায় দেড় বছর ধরে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম থমকে আছে। নিঃসন্দেহে মানুষের জীবনের মূল্য বেশি। তবে শিক্ষায় যে ধস নামছে সেটা ঠেকানোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এভাবে বছরের পর বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে একটি প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ করোনা মহামারির মধ্যেই তাদের শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা অন্যান্য অনেক অঙ্গন স্থবির রেখেও শিক্ষাঙ্গন সরব রাখছে। অথচ আমরা সবকিছু স্বাভাবিক রেখে শুধু শিক্ষাঙ্গনে করোনার জুজুর ভয় পেয়ে যাচ্ছি। হাট-বাজার ও যানবাহনে উপচেপড়া ভিড়; বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে ঠাঁই নেই তিল ধারণের; মার্কেটগুলো মানুষে ঠাসা; এই অবস্থায় শুধু শিক্ষাঙ্গন ফাঁকা রেখে কতটা লাভ হচ্ছে সেটা জোরালোভাবে ভাবার সময় এসেছে।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম
-এএ