শিক্ষা বর্ষের শুরুতেই কওমি শিক্ষার্থীদের জীবনের গতিপথ নির্ধারণ ও প্রায় হারাতে বসা এই অঙ্গনের চির ঐতিহ্য -‘শিক্ষকের প্রতি ছাত্রদের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা-ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন’ বিষয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের প্রথম দুই পর্বে আওয়ার ইসলামের সাথে কথা বলেছেন দেশের খ্যাতিমান আলেম ও জামিয়াতুল আবরার রাহমানিয়া মাদরাসার প্রধান মুফতি, শাইখুল হাদিস মুফতী মনসুরুল হক।
আজকের এই তৃতীয় পর্বে তিনি কথা বলেছেন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে দূরত্ব ও তার প্রতিকার নিয়ে। পাঠকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই সাক্ষাৎকারটি তুলে এনেছেন আওয়ার ইসলামের সাব- এডিটর নুরুদ্দীন তাসলিম।
আপনাদের ও বর্তমান ছাত্রদের জীবনে মৌলিকভাবে কি কি পরিবর্তন দেখেন?
পৃথিবী পরিবর্তনশীল। এই অল্প কয়েক দশকের মঝেই ছাত্রদের মাঝে বেশ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর কিছু বিবরণ তুলে ধরতে চাইলে বলতে হবে:-
১. উস্তাদ ও ছাত্রদের মাঝে সম্পর্কটা কেবল দরসের সীমায় আবদ্ধ। দরস শেষে দু‘জন যেন দু‘জগতের লোক। বরং কোন কোন নালায়েকের দেহ দরসে আটকা পড়লেও তার মন সারা দুনিয়ায় বিচরণ করে।
মূলকথা: উস্তাদ ও ছাত্রের সম্পর্ক এখন নিভু নিভু প্রদীপের মত। অনেক ছাত্র পড়া শেষ করার পরে জীবনেও উস্তাদের সাক্ষাতে আসে না। কোন খোঁজ খবর রাখে না। প্রসিদ্ধ আছে - ইলম বলে থাকে তুমি তোমার সবটুকু আমার জন্য বিলিয়ে দিলে আমি আমার কিছু অংশ তোমাকে দান করবো। এর দ্বারা স্পষ্ট বুঝা গেলো যে, অমনোযোগী ছাত্র ইলমের কিছুই পাবে না। কিছু মা‘লুমাত পেতে পারে. যা কোন উদ্দেশ্য নয়। ইলম ও মা‘লুমাতের মধ্যে আসমান যমীনের পার্থক্য। মা‘লুমাতকে ইলম করতে হলে মনোযোগ ও আল্লাহ ওয়ালাদের সোহবত জরুরি।
২. বর্তমানে ছাত্রদের বাইরের জগতের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে লেখা-পড়ায় মন বসে না। অথচ সফল ছাত্র হওয়ার পূর্বশর্ত হল সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে একাগ্রতার সাথে পড়া-লেখা করা।
৩. মোবাইল-ফোনের এ মরণব্যাধি ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে পড়া। এখন যে ছাত্র মোবাইল-ফোনে অভ্যস্ত সে একাগ্রতার সাথে মুতালাআ করার সেই সাধ ও আনন্দ কোথায় পাবে? আর বিতৃষ্ণা মনে মুতালায় মন না বসাটাই স্বাভাবিক।
বিশেষত অ্যানন্ড্রোয়েট ফোন দুশমনদের ইসলাম ধ্বংসের জন্য অনেক বড় হাতিয়ার। কারণ, এখন যদি আমরা কোন ছাত্রকে আলেম বানাতে চাই, তাহলে তা সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ, এ ছেলেটা বাড়ীতে থাকতেই মোবাইলের কারণে চরিত্র হারিয়ে ফেলছে। এখন তাকে মাদরাসায় ভর্তি করলে দেখা যাবে যে, সে মকতবে বা হিফজ বিভাগে পড়া অবস্থায় বহিস্কার হয়ে যাচ্ছে।
৪. মুতালাআ ও সবক ইয়াদ না করার রোগ ছাত্রদের মাঝে ধীরে ধীরে প্রসার ঘটার সাথে সাথে বর্তমানে মারাত্মকভাবে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে উপরের জামাআতে তাকরার না করাটাই এখন নিয়মের দাবী হয়ে পড়েছে! অথচ আমাদের যামানায় আমরা দাওরার বছরও সবিশেষ গুরুত্বে সাথে আহকামের হাদীসগুলোর তাকরার করেছি।
৫. মাদরাসা ও উস্তাদদের খেদমত করা ইলমের মধ্যে বরকত হওয়ার অন্যতম কারণ। আমদের যামানায় আমরা এটাকে বিশ্বাস করে আমলে এনেছি। আল-হাম্দুলিল্লাহ এর ফলাফলও পেয়েছি, পাচ্ছি। কিন্তু এখনকার তালেবে ইলমরা এটা বিশ্বাস না করায় আমলে আনে না। বরং এগুলো ঝামেলা ও নিজের আযাদির অন্তরায় মনে করে এর থেকে চালাকি করে এড়িয়ে থাকে।
আপনাদের ও বর্তমান ছাত্রদের শিক্ষা জীবনের মাঝে সময়ের ব্যবধান খুব বেশি নয়; কিন্তু এই সময়ের মধ্যে ছাত্রদের জীবনাচারের মাঝে বিশাল এই পরিবর্তনের ( আদব-কায়দার ঘাটতি) কারণ হিসাবে কোন বিষয়টি চিহ্নিত করতে চান আপনি?
এ কথার উত্তর আমি পূর্বেও দিয়েছি। বিভিন্ন কারণে আজ আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের এ দুরাবস্থা। নিম্নে তা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল:-
১. মাদরাসায় ছাত্র রাজনীতি করা।
২. তারবিয়াতী মজলিস না হওয়া।
৩. আদাবের কিতাব তালিম না হওয়া।
৪. আকাবির ও উস্তাদদের প্রতি অনাস্থা এবং তাদের পরীক্ষিত চিন্তাধারার বাইরে বিচ্ছিন্ন মতাদর্শ লালন করা।
৫. বেফাকে সিরিয়াল পাওয়াকে যে গুরুত্বে সাথে ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করা হয়, আদব-বিষয়টা সে পরিমাণ গুরুত্ব দিয়ে ছাত্রদের না বলা। অথচ আদব মেধাতালিকায় নাম আসার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।
৬. আমরা কিতাব ও হাশিয়া-শরাহ এর উপর নির্ভর করতাম, এখন এগুলো এক প্রকার বাদ পড়ে ছাত্ররা বেফাকের প্রশ্নসম্বলিত নোটের পিছে মেহনত করে, উস্তাদদের তাকরীরও মনোযোগসহকারে শুনে না। ফলে তাদের মধ্যে কিতাব ভালোমত বুঝা ও পড়ানোর মত যোগ্যতা পয়দা হয় না। কিতাব আয়ত্ব না করে মেধা তালিকাকে মাকসুদ বানানো চরম ভুল।
আদব-কায়দা বিষয়ে আপনাদের ছাত্র জীবনের বিশেষ কোন ঘটনা যার দ্বারা উদ্দীপ্ত হতে পারে বর্তমান শিক্ষার্থীরা?
আমি কাফিয়া থেকে জালালাইন পর্যন্ত গওহারডাঙ্গা মাদরাসায় পড়েছি। তারপর লালবাগ জামিয়া কুরআনিয়ায় পড়েছি। তো গওহারডাঙ্গায় পড়ার যামানায় আমরা দরসের মধ্যে উসুলুস শাশী কিতাবটা পুরাপুরি বুঝতে পারতাম না। তো ছাত্ররা পরামর্শ করলো যে, তা‘লীমাতকে দরখাস্ত দিবে যে, উস্তাদ পাল্টিয়ে দেয়া হোক। আমরা উনার কাছে কিতাব বুঝি না। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার মাথায় এলো, এতে তো ঐ উস্তাদের বদনাম হয়ে যাবে অথচ অন্য কিতাব উনি ভালো পড়াচ্ছেন।
তখন আমি ছাত্র ভাইদেরকে বললাম যে, তোমরা এটা করতে পারো কিনা যে, দরসে যতটুকু বুঝতে পারো তার উপর সন্তুষ্ট থাকো আর যেসব স্থানে অষ্পষ্টতা থাকে সেগুলি তাকরারের সময় আমি তোমাদেরকে বুঝিয়ে বলবো ইনশাআল্লাহ। আমার সাথীরা আমার উপর আস্থা রাখত। তাই কেউ দ্বিমত করলো না। বছর শেষ হয়ে গেলো আলহামদুলিল্লাহ। কোথাও সমস্যা হয় নাই। উস্তাদের সম্মান রক্ষা করাতে আল্লাহ আমি নগন্য বান্দার ইলমের মধ্যে বরকত দিয়েছেন। উস্তাদের নেক নজর পেয়েছি। এতে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। এটাই আমার জীবনের পুঁজি। আল্লাহ এই নিয়ামত জারি রাখেন। আমীন।
-কেএল