রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


আমরাহ বিনতে আবদুর রহমান: ইলমের অফুরন্ত দরিয়া

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।তাসনীম জান্নাত।।

সাহাবিদের পবিত্রময় সান্নিধ্যে যাদের জীবন কেটেছে তারা ছিলেন স্বর্ণযুগের মানুষ। অনুপম সান্নিধ্যের ছোঁয়ায় তারা হয়ে উঠেছিলেন ইলম-আমল ও তাকওয়া-পরহেযগারিতায় অনুসরণীয়। এ তালিকায় নারীরাও কিন্তু পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁরাও ছিলেন  নিবেদিত প্রাণ। ইলমে ওহীর সুবাস নিতে ছিলেন বেকারার। সেই স্বর্ণযুগের মহিয়সীদের অন্যতম একজন ‘হযরত আমরাহ বিনতে আব্দুর রাহমান রাহিমাহাল্লাহ।’

তখন তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান বিন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগ। ২৯ হিজরিতে মদিনায় হযরত আব্দুর রাহমান বিন সাদ বিন যুরারাহ ও সালিমা বিনতে হাকীম দম্পতির ঘর আলোকিত করে এক ফুটফুটে কন্যাসন্তান। নাম রাখা হয় ‘আমরাহ বিনতে আব্দুর রাহমান।’ দাদা সাদ বিন যুরারাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন একজন আনসারী সাহাবি। দাদার ভাই আসআদ বিন যুরারাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন বাইয়াতে আকাবায় অংশগ্রহণকারী আনসারী সাহাবিদের অন্যতম একজন। কেউ কেউ বলেছেন, বাবা আব্দুর রাহমান বিন সাদ বিন যুরারাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুও সাহাবি ছিলেন।

শৈশব থেকেই আমরাহ রাহিমাহাল্লাহ বেড়ে উঠতে থাকেন মোহনীয় এক পরিবেশে । সান্নিধ্য লাভ করেন উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহার। তাঁর পরশে ইলমুল হাদীসে তিনি পৌঁছে যান অনন্য উচ্চতায় । উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন সম্পর্কে অনেকের চেয়ে বেশি জানতেন। তিনি ছিলেন সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারীদের একজন। আর উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহার হাদীস সম্পর্কে অনেকের চেয়ে বেশি জানতেন আমরাহ বিনতে আব্দুর রাহমান রাহিমাহাল্লাহ।

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে হিব্বান রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আমরাহ রাহিমাহাল্লাহ উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহার হাদিস সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত। ন্যায়পরায়ণ খলিফা হযরত উমার বিন আবদুল আজিজ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আমরাহ রাহিমাহাল্লাহর চেয়ে আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহার হাদিস সম্পর্কে অধিক অবগত আর কেউ অবশিষ্ট নেই ।

মদিনার বড় বড় ফকীহ এবং মুহাদ্দিসদের অন্যতম একজন ছিলেন ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে শিহাব আয-যুহরি রাহিমাহুল্লাহ। যার সম্পর্কে আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, আমি একজন ছাড়া মদিনায় আর কোন ফকিহকে মুহাদ্দিস পাই নি। জিজ্ঞেস করা হল, তিনি কে? তিনি বললেন, ইবনে শিহাব আয-যুহরি।

ইমাম ইবনে শিহাব আয-যুহরি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, মহান তাবেয়ি কাসিম বিন মুহাম্মাদ রাহিমাহুল্লাহ যিনি ছিলেন মদিনার সাত ফকিহের একজন । তাকে বললেন, যদি তুমি আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহার হাদীস সম্পর্কে জানতে চাও; তাহলে আমরাহ রাহিমাহাল্লাহর কাছে যাও । কারণ, তিনি আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহার হাদীস সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত এবং তিনি তাঁর সান্নিধ্যে ছিলেন ।

মহান সাহাবি হারিসা বিন নুমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর নাতি আব্দুর রাহমান বিন আব্দুল্লাহ বিন হারিসা রাহিমাহুল্লাহর সাথে আমরাহ রাহিমাহাল্লাহর বিয়ে হয় । তাঁদের সন্তান মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রাহমান রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস। নির্ভরযোগ্য হাদিস বর্ণনাকারীদের একজন। ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ তাঁর সূত্রে হাদিস বর্ণনা করেছেন। মুয়াত্তা ইমাম মালিকে তাঁর বর্ণিত হাদিস রয়েছে। তাঁর কুনিয়াত ছিল আবু আব্দুর রাহমান। উপাধি আবুর রিজাল। কেননা তিনি দশজন পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন । আর আমরাহ রাহিমাহাল্লাহর কুনিয়াত ছিল উম্মে মুহাম্মাদ।

আমরাহ রাহিমাহাল্লাহ উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে সবচেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনা করেছেন। এছাড়া তিনি উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা, বোন উম্মে হিশাম রাদিয়াল্লাহু আনহা, হামনা বিনতে জাহাশ রাদিয়াল্লাহু আনহা,হাবিবা বিনতে সাহল রাদিয়াল্লাহু আনহা ও রাফে বিন খাদিজ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকেও হাদিস বর্ণনা করেছেন।

তিনি শুধু ইলম অর্জন করে বসে থাকেন নি, ইলমের আলো বিলিয়েছেনও অকাতরে। মদিনার বড় বড় তাবেয়িগণ তাঁর ছাত্র ছিলেন। ইলমুল হাদিসের সৌরভ তিনি ছড়িয়েছেন চারিদিক। অনেক বিখ্যাত মনীষী তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।

তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনাকারীদের মধ্যে অন্যতম হলেন, আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুর নাতি মহান তাবেয়ি উরওয়া বিন যুবাইর রাহিমাহুল্লাহ; যিনি ছিলেন মদিনার সাত ফকিহের একজন। তাঁর থেকে আরও হাদিস বর্ণনা করেছেন ইমাম ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল আনসারি রাহিমাহুল্লাহ; যিনি ছিলেন মদিনার একজন বড় আলিম , নিজ সন্তান আবুর রিজাল মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রাহমান রাহিমাহুল্লাহ, আমরাহ রাহিমাহুল্লাহর দুই নাতি মুহাম্মাদের দুই ছেলে হারিসা এবং মালিক রাহিমাহুমাল্লাহ, বোনের ছেলে কাযি আবু বকর বিন মুহম্মাদ বিন আমর বিন হাযম রাহিমাহুল্লাহ; যিনি হযরত উমার বিন আব্দুল আজিজ রাহিমাহুল্লাহর সময়ে মদিনার গভর্নর ছিলেন, তাঁর দুই ছেলে আব্দুল্লাহ ও মুহাম্মাদ রাহিমাহুমাল্লাহ, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে শিহাব আয-যুহরি রাহিমাহুল্লাহ প্রমুখ ।

হযরত কাসিম বিন মুহাম্মাদ রাহিমাহুল্লাহ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে শিহাব আয-যুহরি রাহিমাহুল্লাহকে লক্ষ্য করে বললেন, হে বালক ! আমি ইলমের প্রতি তোমার অনেক আগ্রহ লক্ষ্য করছি । আমি কি তোমাকে ইলমের খনির সন্ধান দেবো না? ইমাম যুহরি বলেন, আমি বললাম, অবশ্যই। তিনি বললেন, তুমি আমরাহ রাহিমাহাল্লাহর কাছে যাও। কেননা তিনি আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহার সান্নিধ্যে ছিলেন। অতপর আমি তাঁর কাছে গেলাম এবং তাকে ইলমের এক অফুরন্ত সমুদ্রের মতো পেলাম ।

ইবনে হিব্বান রাহিমাহুল্লাহ তাকে নির্ভরযোগ্য হাদিস বর্ণনাকারীদের মধ্যে গন্য করেছেন । ইমাম হাফেজ ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন রাহিমাহুল্লাহ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ছিকাহ ও হুজ্জাহ । ইমাম যাহাবি রাহিমাহুল্লাহ এই মহিয়সীর ব্যাপারে বলেন, তিনি ছিলেন আলিমা, ফাকিহা, হুজ্জাহ, অধিক ইলমের অধিকারী । হযরত ওমর বিন আব্দুল আজিজ রাহিমাহুল্লাহ যখন হাদিস সংকলন করতে চাইলেন তখন মদিনার গভর্নর আবু বকর বিন মুহাম্মাদ বিন হাযম রাহিমাহুল্লাহকে আমরাহ রাহিমাহাল্লাহর বর্ণিত হাদিসগুলো লিখে রাখতে আদেশ করেছিলেন। তিনি তাঁর কাছে এই মর্মে পত্র প্রেরণ করেছিলেন যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস, তাঁর বিগত সুন্নাহ অথবা আমরাহ রাহিমাহাল্লাহর বর্ণিত হাদিসের প্রতি দৃষ্টি দাও এবং তা লিখে রাখো । কেননা আমি ইলমের দারসসমূহের ( বিলুপ্তি ) এবং আলিমদের ইন্তেকালের আশঙ্কা করছি।

ইমাম বুখারি রাহিমাহুল্লাহর উস্তাদ ইমাম আলি ইবনুল মাদিনি রাহিমাহুল্লাহ আমরাহ রাহিমাহাল্লাহকে সম্মানের সাথে স্বরণ করে বলেন, আমরাহ রাহিমাহাল্লাহ হলেন আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহ আনহার বর্ণিত হাদিসের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য আলিমদের একজন । ইবনে আবি দাউদ বলেন, তাবিইয়াদের সর্দার হলেন হাফসা বিনতে সিরিন রাহিমাহাল্লাহ ও আমরাহ বিনতে আব্দুর রাহমান রাহিমাহাল্লাহ। এরপর হলেন উম্মুদ দারদা আস সুগরা রাহিমাহাল্লাহ।

জীবদ্দশায় আমরাহ রাহিমাহাল্লাহ তাঁর ভাইয়ের ছেলেদের ওয়াসিয়ত করে যান, তোমরা বাগানের মধ্যে আমার কবরের জায়গা দিও (বাকীর পাশে তাদের একটি বাগান ছিল )। কেননা আমি আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহ আনহাকে এই হাদিস বলতে শুনেছি যে, মৃতের হাড় ভেঙ্গে ফেলা জীবিত ব্যক্তির হাড় ভেঙ্গে ফেলার মতই (গুনাহের কাজ) । এই মহিয়সী নারী ৯৮ হিজরিতে মতান্তরে ১০৬ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন । রাহিমাহাল্লাহু তায়ালা।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর